খালেদার সঙ্গে সাক্ষাত নিয়ে গণফোরামে বিদ্রোহ

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: অক্টোবর ২৩, ২০১৯, ১০:১৬ পিএম খালেদার সঙ্গে সাক্ষাত নিয়ে গণফোরামে বিদ্রোহ

● নতুন করে কাউন্সিল দাবি ৫ প্রেসিডিয়াম সদস্যর

● সাড়া না দিলে অচিরেই নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ

● বিএনপির সঙ্গে জোট মেনে নেয়া যায় না

● খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবির বিরোধিতা

● সরকারের সঙ্গে আঁতাতের কথা নাকচ

বিএনপির সঙ্গে ঐক্য করে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া, কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলন ও ড. কামাল হোসেনের কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে দেখতে যাওয়ার আগ্রহকে কোনওভাবেই মেনে নিতে পারছেন না গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন ৫ প্রেসিডিয়াম সদস্য। তাদের একজন দলটির স্থায়ী সদস্য।  সারাদেশে দলটির একটি শাখাও নেই দাবি করে দলটির এসব নেতা অভিযোগ করেন, গত ৫ মে গণফোরাম যে কাউন্সিলটি করেছে তা অবৈধ। যেহেতু কোনও কমিটি নেই, তাই কাউন্সিলরও নেই। কাউন্সিলর ছাড়া কাউন্সিল গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বৈধ নয়। অভিযোগের মধ্যে আরও আছে, আওয়ামী লীগের আজীবন সুবিধাভোগী বিতর্কিত নেতা যিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে ড. কামাল হোসেনের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং বিএনপির সহযোগিতায় জোটের মনোনয়ন পান, তাকে দলের দ্বিতীয় নেতার পদ দেয়া হয়েছে। এটা ন্যায়-নীতি, দলীয় আনুগত্য এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত।

সারাদেশে গণফোরামের একটিও কমিটি নেই দাবি করে গত ৫ মে গঠিত গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি স্বেচ্ছাচারী কায়দায় করা হয়েছে অভিযোগ করে অবিলম্বে এ কমিটি ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন ওই ৫ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। তারা গেল সপ্তাহে এসব অভিযোগ লিখিত আকারে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের কাছে দাখিল করেছেন।

অভিযোগকারী নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোনওভাবেই তারা জামায়াত ঘনিষ্ঠ বিএনপির সঙ্গে গণফোরামের জোট ও ড. কামাল হোসেনের মুখে বর্তমানে কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি এবং তার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করতে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছেন না।

দলের নেতাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ লিখিত আকারে পেয়েছেন বলে স্বীকার করে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া। তিনি দৈনিক জাগরণকে বলেন, এ ধরনের একটি চিঠি আমি দেখেছি। এ নিয়ে দলের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে আমার আলোচনা হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই মত-পার্থক্য থাকে এবং তা থাকতেই পারে। এটা নিয়ে তেমন ভাবনার কিছু নেই। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য বর্তমান সরকার কত ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে এবং নিচ্ছে। তাই গণফোরামের মধ্যেও কিছু একটা করতে সরকার সবসময় চেষ্টায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।   

গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বরাবর দুই পৃষ্ঠার লিখিত ওই চিঠিতে দলটির ৫ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য সই করেছেন। এর মধ্যে একজন স্থায়ী সদস্য। তারা জানান, তাদের অভিযোগ আমলে নিয়ে শিগগিরই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা সারাদেশের কর্মী ও কাউন্সিলরদের ডেকে নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেবেন।

অভিযোগপত্র সূত্রে দেখা যায়, অভিযোগকারীরা লিখিত এ অভিযোগে ‘দলীয় গঠনতন্ত্রবিরোধী স্বেচ্ছাচারী কায়দায় কতিপয় ব্যক্তির স্বার্থে অগণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন এবং দলীয় আদর্শ ও লক্ষ্য জলাঞ্জলি দিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করাকে ‘বিষয়’ নির্ধারণ করেছেন।

অভিযোগকারীরা বলছেন, দলীয় গঠনতন্ত্রে উপদেষ্টামণ্ডলির কোনও বিধান নাই। অথচ গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও সভাপতিমণ্ডলির সদস্য জামাল উদ্দিন আহম্মেদ, এস এম আলতাফ হোসেন, তোবারক হোসেন এবং প্রকৌশলী সিরাজুল হককে উপদেষ্টামণ্ডলির সদস্য করে কার্যত নিষ্ক্রিয় করে দলের বাইরে রাখা হয়েছে।

গণফোরামের বর্তমান কমিটির ১ নং নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক আবু সাইয়িদের দিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘‘আজীবন বিশেষ সুবিধাভোগী আওয়ামী লীগের বিতর্কিত নেতা মনোনয়ন না পেয়ে ওই রাতেই ড. কামাল হোসেনের নিকট আশ্রয় নেন এবং বিএনপির সহযোগিতায় মনোনয়ন পান। তিনি পাঁচ মাস আগে দলে যোগদান করেন এবং দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তির মর্যাদার আসীন হন যা ন্যায়-নীতি, দলীয় আনুগত্য এবং রাজনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। অথচ প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা মোস্তফা মহসিন মন্টুর মত নেতাকে দলের বাইরে রাখা হয়েছে।’’

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘‘দলের বহু পরীক্ষিত নেতাদের কমিটি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। অথচ বগত পাঁচ বছরে কোনও সভায় যোগদান না করেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান দেয়া হয়েছে।’’

এ অবস্থায় সংগঠনের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ জানিয়ে ড. কামাল হোসেনকে তারা বলেন, ‘‘বৃহত্তর স্বার্থে অবিলম্বে তথাকথিত অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিকভাবে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিন। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বৃহত্তর কর্মিসভা (কনভেনশন) আহবান করে দলে গণতন্ত্রের ধারা এবং আদর্শ সমুন্নত রাখুন।’’

অভিযোগপত্রে যারা স্বাক্ষর করেন প্রেসিডিয়াম সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল, জামাল উদ্দিন আহমেদ, এস এম আলতাফ হোসেন, তোবারক হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলাম ও স্থায়ী সদস্য অধ্যাপক ডা. এ এ মাহমুদ বীর প্রতীক।

মফিজুল ইসলাম খান কামাল অভিযোগ দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে দৈনিক জাগরণকে বলেন, চিঠির মধ্যে দিয়ে সব কথা বলা হয়েছে। রাজনৈতিক দূর্বৃতায়নের বিরুদ্ধে দেশকে আমরা একটি সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি উপহার দিতে গণফোরাম সৃষ্টি করেছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় আজ কিছু রাজনৈতিক দূর্বৃত্বই গণফোরামে জেঁকে বসেছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

এ ধরনের অভিযোগের সঙ্গে সরকারের কোনও ষড়যন্ত্র জড়িত নেই দাবি করে মফিজুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সঙ্গে আজকে গণফোরামকে ঐক্য করতে হবে কোন দুঃখে? এটার পেছনে অন্য কারণ আছে। না লেখার শর্তে তিনি কিছু কারণ উল্লেখ করে বলেন, ড. কামাল হোসেন অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ। তিনি কোনও ঘোর-প্যাঁচ বুঝতে পারেন না। তাকে কিছু রাজনৈতিক টাউট অন্য দল থেকে টাকা খেয়ে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে।

সভাপতি বরাবর দেয়া এ চিঠির যথাযথ মূল্যায়ণ না হলে আগামীতে প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে সব বিষয় ফাঁস করে দেবেন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন এ নেতা জানান। তিনি গণফোরামের কিছু নেতা ড. কামাল হোসেনকে চাপে রেখে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করাচ্ছেন বলেও দৈনিক জাগরণ এর এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন।

অধ্যাপক ডা. এ এ মাহমুদ বীর প্রতীক দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমরা গত ১২ অক্টোবর দলের সভাপতি বরাবরে অভিযোগপত্রটি দিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোনও সারা না পেলেও তারা আমাদের কারও কারও সঙ্গে যোগাযোগ করে দলে পদ দেয়ার কথা বলছেন। তবে আমরা পদ-পদবির জন্য রাজনীতি করি না। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গণফোরাম গঠিত হয়েছিল অর্থাৎ দুই দুর্বৃত্বায়িত রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে দেশে একটি সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের জন্য যে রাজনীতির কথা গণফোরামের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, আমরা সেই রাজনীতির চর্চা করতে চাই। অন্য কিছু নয়। তিনি বলেন, এখন আর রাজনীতি নাই। সবাই ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে চলে।

গণফোরামের যে কমিটি করা হয়েছে তা কেউ মানে না দাবি করে ডা. মাহমুদ বলেন, আমরা বলেছি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলাই গণফোরামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। গণফোরাম যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল তাতে বিএনপির সঙ্গে জোট করার কথা না।

তিনি বলেন, আমাকে কোট করে লিখুন, কেমন করে গণফোরাম বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করতে পারে? ড. কামাল হোসেন কিভাবে খালেদা জিয়াকে জেলখানায় দেখতে যাওয়ার কথা বলতে পারেন? এটা কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ডা. মাহমুদ অভিযোগ করেন, আমাদের দলের কয়েকজন নেতা গত নির্বাচনে প্রচুর টাকা নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিল। আমরা এ ধরনের রাজনীতিতে বিশ্বাসী না।

এ সব বিষয়ে গণফোরাম সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া বলেন, একটি গণতান্ত্রিক দলে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ থাকে। সবাইতো আর একমত হবেন না। মতের ভিন্নতা থাকতেই পারে।

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীদের সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট করার বিষয়ে ড. রেজা বলেন, এই বিষয়ে তাদের অভিযোগের সঙ্গে আমি একমত নই। ওনারা যে ভাষা ব্যবহার করেছেন সেটা নিয়ে ওনাদের আরও চিন্তা করা উচিত। ঐক্যফ্রন্টে কোনও স্বাধীনতা-বিরোধী নেই বরং অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পক্ষের লোক আছেন।

গণফোরামের বিদ্রোহের বিষয়ে দলটির সাবেক প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম পথিক দৈনিক জাগরণকে বলেন, ড. কামাল হোসেন দলের মধ্যে কারও কথা শোনেন না, আমলেও নেন না। যে পাঁচ নেতা লিখিত চিঠি দিয়েছেন, তাদের বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। আমি মনে করি আজ হোক কাল হোক কিছু সুবিধাবাদী নেতার জন্য পুরান ও সিনিয়র নেতারা বর্তমানে গণফোরামের কাজ করতে পারছেন না, নিষ্ক্রিয় আছেন; তারা ভেবে-চিন্তে ভাল কোনও সিদ্ধান্তই নেবেন।

টিএস/এসএমএম

আরও সংবাদ