• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৯, ০২:৫৮ পিএম

মশা আমাদের ভালোবাসা

মশা আমাদের ভালোবাসা
আলমগীর ছাত্তার

 

টেলিভিশনের টকশোতে হাজার বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি এবং আলোচনা হয়, কিন্তু মশার উপদ্রব নিয়ে কোনো প্রকার আলোচনা হয় না। এমনকি পত্রপত্রিকায়ও এ বিষয়ে তেমন কোনো লেখা সাম্প্রতিককালে আমার দৃষ্টিপথে আসেনি। কিন্তু সেই বহু বছর আগে অন্নদাশঙ্কর রায় মশা নিয়ে কত সুন্দর একটি কবিতা লিখেছিলেন,আজও সে কবিতা ভুলতে পারিনি। ওই কবিতা থেকে কয়েকটি লাইন  তুলে দিচ্ছি :

‘মশায়!/দেশান্তরী করলো আমায়-/কেশনগরের মশায়!...মশা!/ক্ষুদ্র মশা!/মশার কামড় খেয়ে আমার-/স্বর্গে যাবার দশা!.../একাই যুদ্ধ করি/এ-হাতে ও-হাতে/দু'হাতেরই চাপড় বাজে/নাকের ডগাতে।/একাই/মশার কামড় নিজের চাপড়/কেমন করে ঠেকাই।.../ কোন নগরের মশার সাথে/তুলনা কার চালাই?

ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠে দেখি দু'পায়ের গোড়ালি এবং বাম হাতের কব্জির কাছে ছোট ছোট লাল বিন্দু বিন্দু আকারের সুন্দর ডিজাইন করা মশার কামড়ের দাগ। রাতের বেলায় মনে হয় একটু বেশি পানীয় পান করেছিলাম। তাই গভীর ঘুমে অচেতন ছিলাম।ওই অবস্থায় মশার-অরি মশারির বাইরে হাত-পা বেরিয়েছিল। মশাগুলো তখন ভালো সুযোগ পেয়েছিল।

কিটি হক দ্বীপে গ্লাইডার এবং অ্যারোপ্লেন উড্ডয়ন প্র্যাকটিস করতে গিয়ে রাইট ভ্রাতৃদ্বয় যে মশার আক্রমণ সহ্য করেছিলেন, সে ঘটনা খুবই চমকপ্রদ। রাইট ভাইয়েরা শুধু অ্যারোপ্লেনই আবিষ্কার করেননি। তার ওপর কিটি হকে মশার আক্রমণের এমন রসাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন, সে অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতার চেয়ে তা কম কৌতুকপ্রদ নয়। বড় ভাই উইলবার রাইট এবং ছোট ভাই অরভিল রাইট দুজনেই সুরসিক ছিলেন। রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে একাত্তর সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের একটি অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল।

একাত্তর সালের ১২ ডিসেম্বর। জেনারেল ওসমানীকে নিয়ে কোচবিহারের বাঘডোগরা বিমান ঘাঁটি থেকে রওনা করে সন্ধ্যাবেলায় গৌহাটি বিমানবন্দরে গিয়ে পৌঁছলাম।ওখানে পৌঁছানোর পর জেনারেল ওসমানী এবং তার এডিসি শেখ কামালকে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর বড় কর্মকর্তারা অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। প্লেনে রয়ে গেলাম ক্যাপ্টেন খালেক,ক্যাপ্টেন মুকিত এবং আমি।প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন মেজর প্লেনে অপেক্ষা করতে বলে আমাদের থাকার জন্য বাসস্থান ঠিক করতে চলে গেলেন।বলে গেলেন ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে তিনি এসে আমাদের নিয়ে যাবেন।

যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের সময় তখন। ভারতের অভ্যন্তরীণ সেনাবাহিনীর ঘাঁটিগুলো থেকে অনেক সেনা এবং সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার গৌহাটির মতো সীমান্তের সম্মুখবর্তী ঘাঁটিগুলোতে চলে এসেছিলেন। তাই গৌহাটির বিমানবাহিনীর এবং আর্মির অফিসার মেসে কোনো জায়গা খালি ছিল না। অনেক সেনা কর্মকর্তা অফিসার মেসের বাইরে তাঁবু খাটিয়ে তার অভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন। ডিসেম্বর মাসে গৌহাটিতে সূর্যডুবি হয় বিকেল ৫টায়। আমরা প্লেন নিয়ে ওখানে অবতরণ করেছিলাম গোধূলিবেলায়, সন্ধ্যা সাড়ে ৫টায়। মেজর সাহেব তখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছিলেন। আমরা বলতে ক্যাপ্টেন খালেক, মুকিত ও আমি।

রাত ৯টা বাজল, মেজর সাহেব এলেন না। তার আগমনের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। অপেক্ষা করতে যত কষ্ট, তার চেয়ে মশার কামড় সহ্য করা ছিল অনেক গুণ বেশি কষ্টকর। মশার আকার-আকৃতির বিচারে গৌহাটির মশাগুলো অনেক বড়। মশার কামড় অসহ্য হওয়ায় আমরা একবার প্লেনের ভেতরে এসে বসছি, আবার প্লেনের বাইরে গিয়ে মশার কামড়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছিল। মশককুল ঠিকই খুঁজে পাচ্ছিল আমাদের। অন্ধকারেই মশারা ভালো দেখতে পায়। ওই সময় মশার কামড় খেয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা কবিতার কথা খুব মনে পড়ছিল। 'মশার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করি-/এ-হাতে ও-হাতে/দু'হাতেই চাপড় বাজে/নাকের ডগাতে।'

যুদ্ধের সময় অ্যারোপ্লেন চালিয়েছি। কোনো কারণে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফোর্সল্যান্ড করতে বাধ্য হলে এবং তারপর শত্রুপক্ষের সম্মুখীন হতে হলে, নিজেদের বাঁচানোর জন্য আমাদের প্রত্যেককে একটি করে স্টেনগান দেওয়া হয়েছিল। আমাদের তিনটি স্টেনগানই প্লেনের ককপিটে রাখা ছিল। কিন্তু স্টেনগান দিয়ে তো পাকিস্তানি বাহিনীর লোক মারা সম্ভব, কিন্তু মশা মারা যায় না। আমাদের মতোই অন্য মুক্তিযোদ্ধারা যারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনী এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে অপারেশনে নিয়োজিত ছিল, তাদের কাছেও স্টেনগান, হ্যান্ড গ্রেনেড থাকত। কিন্তু ওসব অস্ত্রশস্ত্র মশার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেত না। একাত্তর সালে অন্য মুক্তিযোদ্ধারাও আমাদের মতো মশককুল দ্বারা প্রচুর দংশিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা রাতের অন্ধকারে যখন পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগীদের অ্যামবুশ করার জন্য ঘাপটি মেরে থাকত,তখন মশারা মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যামবুশ করত। উপায়হীন মুক্তিযোদ্ধারা তখন 'এ-হাতে ও-হাতে/দু'হাতে/চাপড় মারতো/নিজেদের নাকের ডগাতে।'

দুই.

গত ১০ বছরে দেশের সব ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে, এ বিষয় কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি বেশি লেখা হচ্ছে। কিন্তু মশক নিধনের ব্যাপারে যে কোনো প্রকার উন্নতি হয়নি, এ বিষয়ে পত্রপত্রিকাগুলো একদম নিশ্চুপ।

ঢাকা শহরে আমি যে এলাকায় বাস করি, গত ১০ বছরে ওই এলাকায় একবারের জন্যও মশা মারার ওষুধ কাউকে ছিটাতে দেখিনি। ভুল বলেছি, আমি যে গলিতে বাস করি তার পাশের গলিতে বাস করেন বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি যদিও বর্তমানে থাকেন ধানমণ্ডিতে, কিন্তু তার স্থায়ী বাসা আমার বাসার পাশের গলিতে। ওই পাশের গলিতে মাঝেমধ্যে মশা মারার ওষুধ ছিটানোর শব্দ পাই বটে! ওই পর্যন্ত। মশক নিধন বাহিনী আর আমাদের গলিতে আসে না।

আমার বাসাটা বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের একেবারে দেয়ালসংলগ্ন। নভোথিয়েটার সংলগ্ন পূর্ব পাশের খোলা জায়গায় খুব সুন্দর একটি ফুলের বাগান করা হয়েছে। বেশ বড় সে বাগান। ওটাকে একটা পার্কও বলা যায়। অনেক লোকই তো নভোথিয়েটারে বিশ্বজগতের দৃশ্য দেখতে আসেন। সংলগ্ন ফুলের বাগানে অনেক ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়ায় অথবা বসে বসে গল্প করে। এসব ছেলেমেয়ের অনেকে বিবাহিত, আবার অনেকে অবিবাহিত। আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দৃশ্য দেখি। প্রেমিক-প্রেমিকাদের বসে গল্পসল্প করতে দেখতে ভালোই লাগে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। প্রেমিক-প্রেমিকারা তখন আরও ঘনিষ্ঠতর হয়ে বসে। সন্ধ্যায় অন্ধকার যখন একটু গাঢ় হয়ে আসে, প্রেমিক-প্রেমিকার প্রেমও গাঢ়তর হয়ে ওঠে। আর মশারা তখনই প্রেমিক-প্রেমিকার রক্ত শোষণ শুরু করে। সন্ধ্যার পর নভোথিয়েটারের সিকিউরিটি গার্ডরা কাউকে বাগানে থাকতে দেয় না। কিন্তু গার্ডদের পাঁচ-দশ টাকা বকশিশ দিলে থাকতে দেয়। তখন সিকিউরিটি গার্ডদের দায়িত্বভার গ্রহণ করে মশক বাহিনী। মশারা বুঝতে চায় না কারা বিবাহিত যুগল অথবা অবিবাহিত যুগল। ম্যারেজ সার্টিফিকেট সঙ্গে নিয়ে গেলেও সন্ধ্যার পর মশকরা ওই সার্টিফিকেটের কোনো মূল্যই দেয় না। দংশন তারা করবেই।

ঢাকা উত্তরের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। একদিন তাকে বললাম,  আনিস ভাই, আপনি ঢাকার মানুষকে ভালোবাসেন। আপনি কি একই সঙ্গে ঢাকার মশাদেরও ভালোবাসেন?

বন্ধুবর আনিসুল হক একটু হাসলেন। তারপর বললেন, মশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তিনি চিন্তা করছেন। তিনি যা বলতেন, তা তিনি করতেন। সবার প্রিয়জন মানুষটি বলতে গেলে অকালে অচিন জগতে পাড়ি দিলেন।

এখন ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের বলব, মশার প্রতি আপনাদের ভালোবাসা অক্ষুণ্ণ থাকুক। এ কথা বলা ছাড়া আর বলার কিইবা আছে? আমার এই ক্ষুদ্র লেখা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের দৃষ্টিপথেই আসবে না। যদি কারও দৃষ্টিপথে আসেও,তবে এক অখ্যাত লোকের লেখা পড়ে অবশ্যই সেটা তারা উপেক্ষা করবেন। এর চেয়ে ভালো অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা থেকে আরও দুটি লাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখাটা শেষ করি।

'পলাশীর সেই লড়াই যদি-/কেশনগরে ঘটতো/ কেশনগরের মশার ঠেলায়/ক্লাইভ সেদিন হটতো।'


লেখক: সাবেক বৈমানিক