• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ২৫, ২০১৯, ০৩:১৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ২৯, ২০১৯, ১২:৪২ এএম

রানা প্লাজা: বিচারহীনতা এবং অনিরাপত্তার বসতি

রানা প্লাজা: বিচারহীনতা এবং অনিরাপত্তার বসতি

    স্বল্প সময়ে দোষীদের বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিতকরণই খুবই জরুরি। কর্মক্ষেত্রের ভবন কিংবা যন্ত্রপাতির নিরাপত্তার পাশাপাশি ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি, শ্রমিকের মর্যাদা, যৌন হয়রানি মুক্ত কাজের পরিবেশসহ সব কিছুর নিশ্চয়তাই আমাদের হওয়া উচিত রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় শপথ।

দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা, সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শ্রমিক হত্যার ঘটনা ঘটেছিল বাংলাদেশে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সে দিন রানা প্লাজার আটতলা ভবন ধসে পড়ে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিকের। ৩০০ জন নিখোঁজ হয়েছেন এবং ২৫০০ জন আহত হয়েছিলেন। রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর হলেও এখনো সম্পাদিত হয়নি বিচারকার্য। এর আগের বছরই অর্থাৎ ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ১১৩ জন শ্রমিক এবং আহত হয়েছিলেন তিন শতাধিক শ্রমিক। কারখানার মালিকসহ অন্য দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেলে অন্য কারখানা মালিক এবং কারখানা পরিদর্শকসহ সব সরকারি কর্মকর্তা মনোযোগী হতেন এবং শ্রমিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতেন। কিন্তু শাস্তি না হওয়ার ফলে শ্রমিকদের বিষয়ে মালিকদের অমনোযোগিতা, অবহেলা কমার জায়গা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। দোষীদের শাস্তির প্রক্রিয়ার ঝুলন্ত অবস্থা এবং দীর্ঘসূত্রতা স্পষ্টভাবেই রাষ্ট্রের কাছে শ্রমিকদের গুরুত্ব প্রমাণ করে।

অ্যাকশন এইডের গবেষণার তথ্যানুযায়ী রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ এখনো কোনো কাজ করতে পারছেন না এবং ১২ শতাংশের শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। ২২ শতাংশ শ্রমিক এখনো মানসিকভাবে চরম বিধ্বস্ত। সেই ঘটনার ট্রমা থেকে নিজেদের সরাতে পারছেন না। অন্যদিকে ২১ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক আবারো পোশাক কারখানায় কাজে যুক্ত হতে পেরেছেন। ২০১৪ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে রানা প্লাজায় নিহত, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে সরকারি উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী প্রত্যেক নিহত, নিখোঁজ শ্রমিকের পরিবার এবং স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া শ্রমিক ১৪ লাখ ৫১ হাজার ৩০০ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আহত হওয়ার ধরন অনুযায়ী, শ্রমিকদের পাওয়ার কথা দেড় লাখ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত লাখ টাকা। কিন্তু ওই টাকা দিতে রাজি হননি পোশাক শিল্পের মালিকরা। আহত শ্রমিকদের ভেঙে ভেঙে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে, যেটা তাদেরও কাজে আসেনি। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে যে অর্থ শ্রমিকদের দেয়া হয়েছে সেটি ছিল অনুদান, ক্ষতিপূরণ নয়। যে হিসাব করে শ্রমিকদের টাকা দেয়া হয়েছে তা খুবই সামান্য। আহত শ্রমিকদের শারীরিক, মানসিক ক্ষতির পরিমাণ ঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি।

রানা প্লাজার ঘটনার পর বাংলাদেশের কারখানার পরিবেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের মধ্যে যে উদ্বেগ তৈরি হয়, তার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষে কারখানার বিদ্যুৎ ও অগ্নিনিরাপত্তা, অবকাঠামো ঝুঁকি, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় উন্নয়নে কার্যক্রম শুরু করে ক্রেতাদের দুটি জোট অ্যাকর্ড ও এলায়েন্স। রানা প্লাজার পর পরিবেশ ও কারখানা ভবনের উন্নতি হয়েছে। ভবনের ভেতরে আতঙ্ক কমেছে। তবে কাজ এখনো শেষ হয়নি। সংস্থা দুটির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, তাদের আওতায় থাকা দুই হাজার ৪১৬টির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশ কারখানাতেই নিরাপত্তা ও অন্যান্য ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রেড ই?উনিয়নের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি খুব বেশি নেই। গবেষকরা বলছেন, পাঁচ হাজারের বেশি পোশাক কারখানা, কিন্তু মাত্র ৬৬১টি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আছে। প্রতিটি কারখানায় পার্টিসিপেশন কমিটি থাকার কথা। কিন্তু আছে মাত্র ৮৯১টি কমিটি। ৮৯ ভাগ পোশাক কারখানায় সঠিক ট্রেড ইউনিয়নই নেই, যা আছে তারও একটি অংশ মালিকরা তাদের নিজেদের লোক দিয়ে তৈরি করিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়ন করলে শ্রমিকদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এমনকি, অনেক ক্ষেত্রে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেয়া হয়। তবে শ্রমিকের নিরাপত্তা শুধু কারখানা ভবন ও কারখানার নিরাপত্তা দিয়ে নিশ্চিত করা যায় না। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, আবাসন এবং পরিবহন সুবিধা- সবই শ্রমিকের নিরাপত্তা প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিকে উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনার কথা এখনো শোনা যায়নি। এমনকি প্রশ্ন উঠেছে শ্রমিককে কম মজুরি দিয়ে আধুনিক ভবন করে শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। নিরাপদ ভবন হচ্ছে হয়তো কিন্তু শ্রমিক ভবনের বাইরে বের হলে তার জীবনযাপনের নিরাপত্তা নেই। আর্থিক নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশের পোশাক কর্মীদের বেতন এখন পর্যন্ত পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম।

জীবনের দাবি অনেক বেশি। তবু সামান্যটুকু মেটাতে ন্যূনতম শ্রম মজুরি ১৬ হাজার টাকার দাবিতে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরেই লড়ছেন এ দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু মজুরিতে অবহেলিত পোশাক শ্রমিকরা। সব দিক বিবেচনায় এই শ্রম মজুরির দাবিও নিতান্তই কম। তবুও দফায় দফায় আন্দোলন, হামলা-মামলা, শ্রমিক নেতৃত্বের অনেক লড়াই, জেল ইত্যাদির পর মজুরি বাড়ার ঘোষণা আসে ২০১৮ সালের নভেম্বরে। না, ১৬ হাজার তো নয়ই বরং ৮ হাজার টাকা করতে মালিকপক্ষকে ‘গাই-গুই’ করতে হয়েছে। প্রতিবারই তা-ই হয়। নানা বাহানা, মালিকদের নানা ধরনের ‘এপাশ-ওপাশ’-এর মধ্য দিয়ে বাড়ে হয়তো কয়েকশ টাকা, কোনো কোনো মালিকের এক বেলার চা-কফির দাম, কিংবা তারও কম। ন্যূনতম মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকরা স্বচ্ছন্দ তো নয়ই বরং একটু মর্যাদা, নিরাপত্তা আর অধিকার নিয়ে কাজ করার দাবি করেছেন। তাও বারবার উপেক্ষিত হয়েছে, হচ্ছে। এরপর শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি কাঠামোর ছয়টি গ্রেড সংশোধন করে মোট বেতন ১৫ থেকে ৭৮৬ টাকা বাড়িয়ে সরকার সপ্তম গ্রেডের মজুরি। সব মিলিয়ে আট হাজার টাকাই রাখা হয়েছে।

২০০৬ সালের শ্রম আইনের ধারায় ২৮৯ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ করা আছে, কোনো মালিক একাদশ অধ্যায়ের অধীন ঘোষিত নিম্নতম মজুরি হারের কম হারে কোনো শ্রমিককে মজুরি প্রদান করলে, তিনি এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থ দণ্ডে, অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। সরকার যখন শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে ষড়যন্ত্র খুঁজে তখন কী একবারের জন্য যে মালিক শ্রমিককে কম মজুরি দিতে চান তার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন? দেশের জিডিপি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও সরকারের কাছে সবচেয়ে ‘বেয়াড়া’ এই শ্রমিকরা। কারণ তারা ‘যখন-তখন’ রাস্তায় নেমে আসেন। বাংলাদেশে যে খাতে সবচেয়ে বেশি আন্দোলন হয় সেটি হলো গার্মেন্টস। আন্দোলন হলেই পোশাক কারখানার মালিকরা তোতা পাখি হয়ে যান, বলতে থাকেন, ‘দেশকে অস্থিতিশীল করতে শ্রমিকদের উসকানো হচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে সরকারের চোখ আরেক কাঠি এগিয়ে থেকে নতুন নতুন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করে। রানা প্লাজার মতো হৃদয় বিদীর্ণ করা ঘটনাকেও ‘ঝাঁকুনি’ তত্ত্ব দিয়ে মোড়কবদ্ধ করতে চায়।

নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার আরেকটি বড় দিক কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি। নিরাপদ কাজের অধিকার এবং অনিরাপদ কাজকে না বলার অধিকার শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিকদের শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ ভাগ। মানসিক নির্যাতনের শিকার ৭১ ভাগেরও বেশি। আরো দেখা যায় যে, ৩১ দশমিক ৩ ভাগ নারী শ্রমিকের কোনো নিয়োগপত্র নেই। ৫৩ দশমিক ৩ ভাগের নেই সার্ভিসবুক। তবে ৯৮ দশমিক ৭ ভাগের হাজিরা কার্ড আছে। শ্রম আইনের লঙ্ঘন করে শতকরা ৫০ ভাগকে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয়। আর ৫০ ভাগ ১০ ঘণ্টারও বেশি। ওভারটাইম করা বাধ্যতামূলক এবং তা দিনে দুই ঘণ্টারও বেশি। বিশ্রামের কোনো সুযোগ পান না ৭০ ভাগ শ্রমিক। ২৫ দশমিক ৩ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত না হওয়ায় বাড়ছে কর্মক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা। বিলসের জরিপে বলা হয় রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরের বছর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে ৬০৩ শ্রমিক নিহত হন। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা কমে যায় প্রায় অর্ধেক। ওই বছর ৩৬৩ শ্রমিক নিহত হন। তবে ২০১৬-তে এসে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়। মারা যান ৬৯৯ জন শ্রমিক। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে শ্রমিকদের নিহত বা আহত হওয়ার এসব ঘটনা ঘটছে।

গার্মেন্টস খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে হয়তো। তবে স্বীকার করতেই হবে যে এর পেছনে বিদেশি চাপ একটা বড় কারণ ছিল। স্বল্প সময়ে দোষীদের বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিতকরণই খুবই জরুরি। কর্মক্ষেত্রের ভবন কিংবা যন্ত্রপাতির নিরাপত্তার পাশাপাশি ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি, শ্রমিকের মর্যাদা, যৌন হয়রানি মুক্ত কাজের পরিবেশসহ সব কিছুর নিশ্চয়তাই আমাদের হওয়া উচিত রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় শপথ।

 লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।