• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে, ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২২, ২০১৯, ১১:৪৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২২, ২০১৯, ১২:০০ পিএম

সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঠেকাতে

রিটেস্টিং সনদ ব্যতীত গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ নিষিদ্ধ

রিটেস্টিং সনদ ব্যতীত গাড়িতে গ্যাস সরবরাহ নিষিদ্ধ


গাড়ি অথবা বাড়িতে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস (সিএনজি) কিংবা এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মৃত্যু যেন থামছেই না। দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার নিয়ে চলাচল করছে বেশিরভাগ যানবাহন। মাঝে মধ্যে বিস্ফোরণ ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে এসব গাড়িতে। সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহনকারী গাড়িতে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা। গাড়ির যাত্রী ছাড়াও আশপাশের মানুষের মৃত্যু ডেকে আনছে যানবাহনের এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ।

গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ প্রতিরোধে সিলিন্ডার রিটেস্টিং সনদ ছাড়া যানবাহনে গ্যাস সরবরাহ করবে না গ্যাস বা সিএনজি পাম্প। আগামী জুলাই মাসের প্রথম থেকে সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার সনদ ছাড়া গ্যাস পাবে না সিএনজি চালিত গাড়িগুলো। 

সারাদেশে বৈধ ও অবৈধ লাখ লাখ যানে সিএনজি ব্যবহৃত হয়। সিলিন্ডার রিটেস্ট না করায় এ গাড়িগুলো যেন এক একটি চলন্ত বোমা। তদারকি বাড়লে তবেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমবে বলে মনে করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বার্ন ইউনিটের প্রবীণ চিকিৎসক সার্জন পার্থ শঙকর পাল বলেন, সিলিন্ডার নামীয় মৃত্যুসঙ্গী বোমা ঘরে নিয়েই বসবাস করছেন মানুষ। শুধু তাই নয়, বাসাবাড়ি বা শিল্প–কারখানায় এবং যানবাহনে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অনেকে মারা যাচ্ছে। আবার অনেকে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। 

রাজধানীসহ সারাদেশের সিংহভাগ গাড়িতে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার  রয়েছে। একটি গ্যাস সিলিন্ডারের মেয়াদ ৫ বছর। এরপর নিরাপত্তার স্বার্থে মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার রিটেস্টিং করা উচিত। প্রয়োজন হলে সিলিন্ডার বদলে ফেলা উচিত। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকায় সংশ্লিষ্ট গাড়ির মালিক অনেক সময় রি–টেস্টিং করার তাগিদ দেখান না। গাড়িতে লাগানো গ্যাসের সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বিস্ফোরক অধিদফতরে রিপোর্ট জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না। প্রতিষ্ঠানটিতে মাত্র ১০ থেকে ১৫ হাজার গাড়ি পরীক্ষার হালনাগাদ রিপোর্ট জমা আছে। অন্য গাড়িগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে কি না বা সেগুলোর মেয়াদ আছে কি না এর কিছুই জানে না বিস্ফোরক অধিদফতর।

বাসাবাড়িতে এবং বিভিন্ন যানবাহনে যেসব গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে তারও একটি বড় অংশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় এগুলো বিস্ফোরিত হচ্ছে। প্রতিটি সিলিন্ডারের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। দশ থেকে ১৫ বছর। এরপর সেগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। বাংলাদেশে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যারা ব্যবসা করছেন তারাই আবার এই সিলিন্ডার পরীক্ষার সনদ দিয়ে থাকেন।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, সিলিন্ডারের সমস্যার কারণ থেকেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে সিলিন্ডার বিক্রিকারী কোম্পানিগুলো বলছে, অসচেতনতা ও অসতর্কতার কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারিভাবে সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। গ্রাহকদের সচেতন করার বিষয়েও নেই কোনো কিছু। এমনকি কোম্পানিগুলো যে এলপি গ্যাস সিলিন্ডারে ভরে বিক্রি করছে তারও যাচাই–বাছাই করার সুযোগ কম। এলপি গ্যাস ব্যবহারের নীতিমালা না থাকার কারণেই এই সমস্যার কোনো সমাধানও হচ্ছে না।

বিস্ফোরক অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক ব্যবহারে প্রায় ৯০ লাখ এলপিজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সিলিন্ডার রয়েছে। যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাস) সিলিন্ডার আছে প্রায় ৪ লাখ। রি–টেস্টের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত বাতিল হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার এলপিজি ও ২০০ থেকে ৩০০ সিএনজি সিলিন্ডার। তবে এ রি–টেস্ট সুবিধাও দেশে পর্যাপ্ত নয়। বিআরটিএ গাড়ির ফিটনেস ও আয়কর নিলেও তাদের নিজস্ব কোনও গ্যাস সিলিন্ডার রিটেস্টিং ল্যাব নেই। ব্যক্তিগত পর্যায়ে সারা দেশে মাত্র ১৫টি রি–টেস্ট সেন্টার রয়েছে। কয়েকজন গাড়ির মালিক জানান, অনেক গাড়ির মালিক চাইলেও সময়মত রি–টেস্ট করাতে পারেন না। সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানো হলে রি–টেস্টের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঝুঁকিও কমবে।

সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনা সম্পর্কে প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. শামসুল আলম বলেন, নিয়ম মেনে রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে ও যাচাই–বাছাই সাপেক্ষে প্রতিটি সিলিন্ডার ৪০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু দেশে সিলিন্ডারগুলো পরিবহন পর্যায়ে বিশেষ করে ডিলার পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এগুলোর স্বাভাবিক আয়ু কমে যায়।

তিনি জানান, ১০ বছর পর পর বিস্ফোরক অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সিলিন্ডার রি–টেস্ট (পরীক্ষণ) করাতে হয়। রি–টেস্টে উত্তীর্ণ হলে প্রতিটি সিলিন্ডার পরবর্তী ১০ বছর পর্যন্ত ব্যবহারের অনুমোদন পায় উৎপাদন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। গ্যাস সিলিন্ডার আইন ১৯৯১ –এ সিলিন্ডারের মান যাচাইয়ের জন্য প্রতি ৫ বছর পর সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইএসও) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, প্রতি ৫ বছর পর গ্যাস সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষা বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনো পুনঃপরীক্ষা ছাড়াই দেশের বাজারে ২৫ বছরের পুরনো সিলিন্ডারও ব্যবহার হচ্ছে। এ কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বাড়ছে। 

জানা গেছে, ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত প্রায় পাঁচ লাখ চার হাজার ৩শ’ গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়। ১৯ বছরে পুন:পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র বিরানব্বই হাজার সিলিন্ডার।

রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের এক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরণের সিলিন্ডারের কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। নিবন্ধিত গাড়ি বছরে একবার বিআরটিএতে আসতে বাধ্য হওয়ায় এগুলোর সিলিন্ডারের মেয়াদ সহজেই শনাক্ত করা যায়। তবে অবৈধ ও দুর্গম এলাকায় চলাচল করা গাড়িগুলো থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেবল ফিলিং স্টেশন থেকে গ্যাস নেয়ার সময় এগুলোকে শনাক্ত সম্ভব। 

তাই, বিস্ফোরক পরিদপ্তর সারা দেশের ৬০০ টি সিএনজি ফিলিং স্টেশনকে সম্প্রতি চিঠি দিয়েছে। প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক এম. শামসুল আলম বলেন, আমরা আশা করছি টেস্ট সম্পূণ রূপে করা সম্ভব হবে।
 
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মো. আলী বিশ্বাস বলেন, মনিটরিংয়ে আরও বেশি জোর দিলে এটা আরও বেশি সম্ভব। মান ও সনদের সত্যতা নিয়ে বিভ্রান্তি এড়াতে সবগুলো গাড়িতে একই রকম স্টিকার লাগানোর ব্যবস্থা নিয়েছে আরপিজিসিএল। সংস্থাটির মতে, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পরিবহন মালিক ও ব্যবহারকারীর সচেতনতা এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এইচএম/আরআই