• ঢাকা
  • সোমবার, ১৩ মে, ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০১৯, ০৫:৫৬ পিএম

দেশভাগের পর যারা ‘ভুল’ জায়গায় রয়ে গেছে

দেশভাগের পর যারা ‘ভুল’ জায়গায় রয়ে গেছে

 

গত সপ্তাহে লোকসভায় সিটিজেনশিপ বিলের সংশোধনী নিয়ে আসাম এবং গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে একটা ঝাকি লেগেছে। গোটা অঞ্চলে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বিজেপি দলের শরিক দল অসম গণপরিষদ আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়ালের অফিস থেকে বের হয়ে গেছে। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্র সরকারের প্রতি গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং আঞ্চলিক পরিচয় নিয়ে উদ্বেগ প্রশমনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু যদি আগামী মাসে বিলটি পাস হয় তাহলে ১৯৮৫ সালের আসাম চুক্তির এক প্রকার অস্বীকৃতি নিয়ে উদ্বেগের কারণ আছে।

বিলটি খতিয়ে দেখার জন্য জয়েন্ট কমিটির একজন সদস্য হিসেবে গোহাটি, শিলচর ও শিলং সফর করেছি। তাই জানি যে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগকালে রয়ে যাওয়া কিছু জটিলতার সমাধান করা কমিটির জন্য কত বড় কঠিন কাজ। এর জন্য কিছু কঠিন কাজে হাত দেওয়া দরকার।

প্রথমত, বিলটা এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে যে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা কার্যত সেসব দেশে অনাকাক্ষিত, যার ফলে ভারত তাদের জন্য আশ্রয়ের দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে দেশ ভাগের পরপরই হিন্দু ও শিখদের ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিতাড়নের কাজটি হয়েছে ধাপে ধাপে। এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে ১৯৪৭ সালে শুরু হলেও দেশটিতে এখনো ১১ শতাংশ হিন্দু রয়েছে। বাংলাদেশে নিজেদের বসবাসকে তারা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। তাদের ভারতে পালিয়ে আসার পেছনের কারণ প্রায় পুরোটাই ধর্মীয় নিপীড়ন, বিষয়টি শুধু তাদের নারীদের নিরাপত্তার নয়।

যারা ‘ভুল’ জায়গায় রয়ে গেছে, দেশভাগের সময় তাদের ফেরার অধিকারের ওপর বিলটিতে জোর দেওয়া হয়েছে। এ পদক্ষেপ ভারতকে ভাবতে বাধ্য করার ফল যে, একটি মুসলমানের দেশ বা ইসলামি দেশ হিসেবে তাদেরকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। কার্যত বিলটিতে বাস্তবতারই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। পূর্ব ইউরোপের জার্মান বংশোদ্ভূতদের প্রতি জার্মানির বাধ্যবাধকতার যে মূল্যবোধ, তার থেকে এটা ব্যতিক্রম নয়। অথবা ব্রিটেনের ব্রিটিশ দাদা-দাদির অধিকারবিষয়ক নিয়মের।

দ্বিতীয়ত, এটা অনস্বীকার্য যে, পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশ থেকে হিন্দু ও বৌদ্ধদের বিতাড়ন পশ্চিম বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের ঘটনার মধ্যে নিহিত আছে। নেহেরুর সময়ের পুনর্বাসনের অভিজ্ঞতা বাঙালিদের থাকলেও আসাম এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে এখন রয়েছে নানা জটিলতা।

ত্রিপুরায় জনসংখ্যা পরিবর্তনের ফলে সেখানে আদিবাসীরা শোচনীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। আসামে রাজনৈতিক প্রভাবে বাংলাদেশি মুসলমানদের প্রবেশে একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এর ফলে ১৯৮০’র দশকে আসামে বিদেশিবিরোধী ক্ষোভ সৃষ্টি হতে থাকে। এখন একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে যে, আসামে ২০১৪ সাল পর্যন্ত হিন্দু ও বৌদ্ধদের নাগরিকত্বের অনুমোদন দিলে জনসংখ্য ও রাজনৈতিক ভারসাম্য ক্ষুন্ন হবে এবং আদিবাসীদের অধিকার লঙ্ঘিত হবে। প্রকৃত অর্থে ২০১৬ সালে আসামে বিজেপি বিজয় লাভ করার পূর্বে এমন ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে আসামের মনোভাব হলো সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাংকের ভেটো ক্ষমতার কারণে তাদের স্থায়ীভাবে ছাড় দেওয়া।

জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধন নিয়ে যে শোরগোল শুরু হয়েছে এবং অ-ভারতীয়দের বাদ দেওয়া নিয়ে যে দ্বিধা তৈরি হয়েছে, তাতে আসামের মূল বাসিন্দাদের মধ্যে আশঙ্কা জেগে উঠেছে। জাতীয় পরিচয়বিষয়ক যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, তা নরেন্দ্র মোদি সরকারের এ অঞ্চলের উন্নতির যে বিশাল সদিচ্ছা দেখা দিয়েছিল তাকে ঢেকে ফেলার হুমকিতে ফেলেছে।

এ দুটি ভিন্ন নির্দেশনা একটি জাতীয় ঐক্য ছাড়া কী করে সফল হবে? অন্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, যেমন আসাম চুক্তিতে আসামের জনগণকে সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সব ধরনের নিরাপত্তা দিতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আজকের দিনের বিবেচনায় আদিবাসী আসামের জনগোষ্ঠীকে রাজনৈতিক প্রাধান্য এবং তাদেরকে ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া ঠেকানো নিশ্চিত করা।

এ জটিলতার মধ্যে নাগরিক এবং বসবাসকারীর পার্থক্যটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।   

লেখক: ভারতের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক