• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২, ২০২০, ০৪:৩৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২, ২০২০, ০৪:৩৭ পিএম

জামায়াতের কি রাজনীতি করার প্রয়োজন আছে?

জামায়াতের কি রাজনীতি করার প্রয়োজন আছে?

স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। যুদ্ধাপরাধী রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন। জামায়াত যে রাজনৈতিক মিশন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এসেছিল তার মিশন কি ব্যর্থ হয়ে গেছে? জামায়াতের রাজনীতি রাজনৈতিক অঙ্গনে না থাকলেও জামায়াত যে আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল তা পরোক্ষভাবে বাস্তবায়িত হয়েই যাচ্ছে। তাই জামায়াত নামে রাজনৈতিক দলটি না থাকলেও তাদের মিশন যে ব্যর্থ হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশকেও একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করা। বর্তমানে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের কার্যক্রমে দিন দিন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদিত্বের অস্তিত্ব। সুতরাং জামায়াত না থাকলেও তাদের মিশন এদেশে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে যদি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চলতে থাকে। 

১৯৭৫ সারে পটপরিবর্তনের পর মৌলবাদী রাজনীতির উত্থান ঘটে। মৌলবাদী বা ধর্মাশ্রিত রাজনীতির ধারাটি দিন দিন বেড়েই চলছে দেশের রাজনীতির অঙ্গনে। ধর্মাশ্রিত রাজনীতির বলয়ে দেশের শাসনযন্ত্রটিও এখন পরিচালিত হচ্ছে। তাই মৌলবাদীদের অস্তিত্ব দেখা যায় প্রশাসনিক কার্যক্রমে। সম্প্রতি সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের একটি নোটিশ জারি করা হয়, এই নোটিশে জারিকৃত নিয়মাবলিতে দেখা যায়, ব্যক্তির মৌলিক স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। আর এই নোটিশটির বিষবস্তুগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই বিজ্ঞপ্তিতেই নিহিত আছে জামায়াতে ইসলামীর শাসনের প্রতিচ্ছবি। মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং উদ্দেশ্যের সাথে সাংঘর্ষিক নোটিশ কি করে বাংলাদেশে জারি করা হয় তা ভেবে দেখার প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশের শাসনযন্ত্রে ’৭১-এর পাক হায়েনার দোসররা নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে এ রকম নোটিশ জারির মাধ্যমে। বিষয়টি সারা জাতির জন্য পীড়াদায়ক ঘটনা।

জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশাসনযন্ত্রে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তাদের কর্মীরা। প্রশাসন, মিডিয়া ও রাজনৈতিক দলে জামায়াতের কর্মীরা ঢুকে পড়েছে। আর সুযোগ পেলেই তারা জামায়াতী আদর্শ বাস্তবায়নে চেষ্টা চালায়। এক সময়ের শিবিরকর্মী ছিল এক ব্যক্তি তার হাতে প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির কর্মীরা নির্যাতিত হয়েছে বহুবার। সেই শিবির কর্মীটি স্বাধীনতার পক্ষের একটি ইলেট্রনিকস মিডিয়ার কর্মী হিসেবে ময়মনসিংহে দায়িত্ব পালন করছে। ময়মনসিংহের গণমাধ্যমকর্মীদের সমাজে গড়ে তুলেছে নিজস্ব অবস্থান। ১৯৮৪ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজে ছাত্রলীগের নবীনবরণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রে হামলা চালায়। সেই হামলার মূল হোতা ছিল একজন কুখ্যাত রাজাকার। যে হামলাকারীরা ওইদিন ছাত্রলীগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দিয়েছিল, তাদের অনেকেই এখন দেখা যায় আওয়ামী রাজনীতিতে। জামায়াতের রাজনীতি মাঠে না থাকলেও তার আদর্শিকরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চাদর ঘায়ে জড়িয়ে জামায়াতের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে। যার ফলে দেখা যায় মাঠপর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধর্মাশ্রিত হওয়ার নীতি। 
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে বিভিন্ন সময় জানা যায়, দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক জামায়াত-শিবিরকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে। এখানে প্রশ্নটা চলে আসে, এরা কি আওয়ামী লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যে উদ্ধুদ্ধ হয়ে এসেছে , নাকি নিজেদের আদর্শিক লক্ষ্যগুলো আওয়ামী লীগে অবস্থান করে বাস্তবায়ন করবে? 

জামায়াতে ইসলামী দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে যে কাজগুলো করত, তা পরোক্ষভাবে আজ বাস্তবায়িত হয়ে যাচ্ছে। দেশের কিছু রাজনীতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পাকিস্তানি প্রভাবে প্রভাবিত। জামায়াত চেয়েছিল বাংলাদেশের রাজনীতি, সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হবে পাকিস্তানের মতো। বর্তমানে রাজনৈতিক অঙ্গনে জামায়াতে ইসলামী নামে রাজনৈতিক দলটি না থাকলেও তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি কিন্তু থেমে নেই। দেশের ব্যাকিং ব্যবস্থাটা এখন মৌলবাদী অর্থনীতির আবর্তে চলছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো পাকিস্তানি কায়দায় শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু করছে। দেশের কিছু ব্যাংকের কথিত শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাটি ইসলামিক অর্থনীতির সাথে মেলে না। কারণ মূল ইসলামি অর্থনীতিতে বলা আছে, কোনো ব্যক্তি ব্যবসার উদ্দেশ্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণগ্রহণ করলে, ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তিটির ব্যবসায় কি পরিমাণে লাভ হয়েছে তার ওপর নির্ভর করে ঋণ প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ওই ঋণগ্রহণকারীর কাছ থেকে সুদ নির্ধারণ করে লাভ্যাংশ দাবি করবেন। আবার এ কথাও বলা আছে, যদি ঋণগ্রহণকারী ব্যক্তিটি তার ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হন, তা হলে ঋণ প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সেই ক্ষতির হিসাব করে ক্ষতির অংশটার দায়ভারও নিতে হবে। বর্তমানে শরিয়ার নামে যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে; ওই ব্যাংকগুলোর ঋণ কার্যক্রমে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা দেখা যায় না। সুতরাং শরিয়ার নামে যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে তা হলো পাকিস্তানি কায়দারই একটি ব্যাংক ব্যবস্থা। ব্যাংক বিমা, ইনস্যুরেন্স, লিজিং প্রতিটি আর্থিক সেক্টরে ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে সুনিপুণভাবে। 

জামায়াত নামে রাজনৈতিক দলটি না থাকলেও তাদের মিশন যে ব্যর্থ হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। বর্তমানে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের কার্যক্রমে দিন দিন স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে মৌলবাদিত্বের অস্তিত্ব। সুতরাং জামায়াত না থাকলেও তাদের মিশন এদেশে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে যদি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার চলতে থাকে। 

সামাজিক ব্যবস্থায়ও পাকিস্তানি আদলে ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোও বাঙালি সংস্কৃতির ধারার মধ্যে আর থাকছে না। এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোকেও ইসলামের নামে নতুনভাবে সংস্কার করা হচ্ছে। সামাজিক বিচার-সালিশেও ইসলামের নামে নতুন একটি প্রক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সামাজিক বিচারের নামে ছোট ছোট শিশু-কিশোরকে চুরি করার অপরাধে হাত-পা বেঁধে করা হয় অমানবিক নির্যাতন। বাঙালি সংস্কৃতির সামাজিক আবহকে পরিবর্তন করে তাতে ইসলামিকরণ করার উদ্দেশ্যে দেয়া হচ্ছে পাকিস্তানি ধরনের একটি রূপ। ধর্ষণ ও বলাৎকারের মতো ঘটনাকেও সামাজিক সালিশে করা হচ্ছে নিষ্পত্তি করার চেষ্টা চলে। ফলে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা। সামাজিক অনুষ্ঠানের বিষয়গুলোকে সাম্প্রদায়িক করার ফলে বাঙালি সংস্কৃতির ধারাটি একদিন হারিয়ে যেতে পারে। 

’৭৫-এর পটপরির্বতনের পর সেনাশাসকদের শুরু করা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার অক্ষুণ্ন রাখে ৯০-পরবর্তী সরকারগুলো। ধর্মীয় মৌলবাদ বিষয়টি তারা সরাসরি চর্চা না করলেও ধর্মীয় প্রলেপে রাজনীতি করছে। তাই ১৯৯১ সালের পর থেকে বেড়েই চলেছে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার। নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার এক মোক্ষম হাতিয়ার হলো ধর্ম। দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কতিপয় বাম দলও এখন ধর্মকে ব্যবহার করছে রাজনীতিতে। এ বিষয়টি তাদের নীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার পর তারা ক্ষমতার লোভে তারা ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন হবে অসাম্প্রদায়িক। জামায়াতের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক অঙ্গন হবে সাম্প্রদায়িক ইসলামভিত্তিক। আর এই উদ্দেশ্যেই তখন জামায়াত মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। বর্তমানে ছোট ছোট কয়েক বাম দল বাদে রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রিয়াশীল প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছে প্রকাশ্যে। 

’৬৯ সালে ছাত্র আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হবে অসাম্প্রদায়িক। দেশে অসাম্প্রদায়িক বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ার লক্ষ্যে এ দেশের ছাত্র-জনতা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আর এ ব্যবস্থার বিরোধিতা করে জামায়াত। গত ৩০ বছরে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই দেওবন্দের কারিকুলামের প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কওমি মাদ্রাসা । দেশের প্রায় অঞ্চলের শিশুদের বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা না দিয়ে দেয়া হচ্ছে দেওবন্দের স্টাইলের শিশুশিক্ষা। 
উপজেলা, জেলাভিত্তিক বাঙালি ও বাংলাদেশের সংস্কৃতির ধারায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন না হলেও কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে ইসলামের নামে কিছু সংস্কৃতি কেন্দ্র। গড়ে ওঠা এ কেন্দ্রগুলোতে ইসলামের চাইতে বেশি হচ্ছে মৌলবাদ চর্চা। যার ফলে একদিন এ দেশটিও পূর্ণাঙ্গ মৌলবাদী দেশে পরিণত হয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। 


১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং অর্থনীতিসহ সবকিছু হবে অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িক প্রবাহ ধারাটি পরিচালিত হবে বাংলাদেশের মূল সংস্কৃতির আবহে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে দেশের প্রতিটি সেক্টরে, যা ’৭১-এর মূল চেতনার পরিপন্থি। 

তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তির উচিত ’৭১-এর চেতনায় সরকারব্যবস্থার কাঠামোটি তৈরি করা। নইলে লুকিয়ে থাকা জামায়াত-শিবিরের শ্বেতকর্মীরা পুনরায় ছোবল দেবে। আর এই ছোবলে যে ভয়াবহ রূপ নেবে তখন ’৭১-এর চেতনাটি যাবে হারিয়ে। তাই যার যার অবস্থান থেকে ’৭১-এর চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে কাজ করা উচিত। নইলে লুকিয়ে থাকা জামায়াত-শিবিরের ভয়াল ছোবল থেকে কেউ রক্ষা পাবে না। 

লেখক : কলামিস্ট 

জাগরণ/এমইউ