• ঢাকা
  • শনিবার, ১১ মে, ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৯, ২০২১, ১২:৩৬ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৯, ২০২১, ১২:৩৬ এএম

ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-৩৬

নাচে নটরাজ-০১

নাচে নটরাজ-০১

বাংলাদেশের ক্ষমতার মঞ্চে নতুন নাটকের পর্দা উন্মোচিত হলো।
তারিখ : ২৩ শে মার্চ ১৯৮২ সন। সময় : রাত্রি সাড়ে আটটা। স্থান : ঢাকা সেনাসদর। 

উপস্থিত : মেজর জেনারেল আব্দুর রহমান, মেজর জেনারেল নুর উদ্দিন, ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার আমছা আমিন এবং ঢাকা ও অন্যান্য সেনানিবাসের কয়েকজন ব্যাটেলিয়ন ও ব্রিগেড কমান্ডার।

মঞ্চে পদার্পণ করলেন সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ। মুখমণ্ডল অত্যন্ত গম্ভীর, শরীর ঘর্মাক্ত, চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ। দেখেই বোঝা যায় তিনি ভীষণভাবে উত্তেজিত। এ নিয়ে উপস্থিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হলো। যেন বিশাল একটা কিছু ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে। এরশাদ সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাব দিলেন উত্তেজিতভাবেই।

‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আমিই এই দেশটাকে গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়েছি। আমিই সেনাবাহিনীকে সংহত করেছি, আত্মনিয়োগ করেছি দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ভাবনায়। অথচ প্রেসিডেন্ট সাত্তার, যাকে আমি মৃত্যুশয্যা থেকে তুলে এনে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছিলাম এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার জন্যে তাকেই রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, আজ তিনিই আমাকে পুরস্কৃত করতে চলেছেন। এই পুরস্কারের সুস্পষ্ট অর্থ হচ্ছে আমাকে দায়িত্ব থেকে হটিয়ে দেয়া।’

আপনারা শুনুন, ‘তিনি আমাকে বরখাস্তই করতে চলেছেন।’

কেন?

‘কারণ আমার অপরাধ আমি সৈনিকদের স্বার্থের কথা বলি, আমার অপরাধ আমি তাদের প্রশাসনের অংশীদারিত্বের কথা বলি, আমার অপরাধ আমি দেশ এবং মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসি।’

বলতে বলতে তার গলাটা একটু ধরে এলো। কিছুক্ষণ সময় স্তব্ধ হয়ে থেকে তিনি এদিক ওদিক তাকালেন। তার বসার আসনের পাশেই ছিল একখানি পবিত্র কোরআন শরীফ। তিনি তা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে আমি শপথ করছি— কোনো লোভ, কোনো ধরনের মোহ আমাকে রাজনীতিতে জড়িয়ে ফেলতে পারবে না।       
আমি সৈনিক। একজন সৈনিকের দায়িত্ব হলো দেশকে রক্ষা করা, দেশের কল্যাণ সাধন করা। আমি সেই পথেই পা রাখতে চাই।’—বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এরশাদ।
তারপর গভীর কণ্ঠে বললেন, ‘দেশ আজ রসাতলে যেতে বসেছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি গোল্লায় যাচ্ছে। চারিদিকে শুরু হয়েছে অরাজকতা।’
এরপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, ‘আপনারাই বলুন, একজন সৈনিক এই অবস্থায় কি চুপ করে বসে থাকতে পারে? সে কি নীরব দর্শক হয়েই থাকবে? কোনো ব্যবস্থাই কি সে নিতে পারবে না?’  
‘সাথীরা, তাই আমি দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, দেশের সামরিক আইন জারি করতে চলেছি। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমার নিজের কোনোই স্বার্থ জড়িত নেই। এ আমি আপনাদের সামনে হলফ করে বলছি।’   
উপস্থিত সামরিক নেতৃবৃন্দ স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন একটি আকর্ষণীয় নাটকের একাংশ। প্রত্যক্ষ করলেন নটরাজের এক আবেগময় অভিনয়। নাটকের এই পর্যায়ে নটগুরু বেরিয়ে গেলেন বঙ্গভবনের দিকে। বৃদ্ধ এবং অথর্ব প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুর সাত্তারকে এক রকম বগলদাবা করেই চলে এলেন ঢাকা বেতারকেন্দ্রে। তখন রাত্রির শেষ প্রহর। 
২৪ শে মার্চ-এর প্রত্যূষে ঢাকা বেতারকেন্দ্র থেকে উচ্চারিত হলো জেনারেল এরশাদের কণ্ঠস্বর : ‘বাংলাদেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।’ শুধু সেখানেই তিনি থেমে রইলেন না। সামরিক আইন জারি করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলে ঘোষণা করলেন এবং দুজন উপমুখ্য সামরিক আইন প্রশাসকের নামও ঘোষণা করলেন। তাদের মধ্যে একজন নৌবাহিনীর প্রধান রিয়াল অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খান এবং অন্যজন বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ। এছাড়া তিনি ছয় সদস্যের একটা উপদেষ্টা পরিষদও গঠন করলেন। তারমধ্যে চারজনই সামরিক বাহিনীর লোক। বাকি দুজন অসামরিক ব্যক্তি। কিন্তু এই অসামরিক ব্যক্তি দুজনের একজন হলেন এটর্নি জেনারেল কে এম বাকের এবং অন্যজন কুখ্যাত রাজাকার এবং প্রেসিডেন্ট জিয়া ও সাত্তারের উপদেষ্টা শফিউল আজম। এই উপদেষ্টা পরিষদের মধ্যে সুলতান মাহমুদ বাদে বাকি সবাই ছিলেন ঘোরতর পাকিস্তানপন্থী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রচণ্ড বিরোধী।

অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এরশাদ সাহেব তার প্রশাসন যন্ত্রকে সাজাতে শুরু করলেন। পাঁচ ভাগে বিভক্ত করে প্রশাসনকে বিন্যস্ত করা হলো এবং প্রত্যেক অংশের শীর্ষস্থানে বসিয়ে দেয়া হলো সামরিক বাহিনীর অফিসারকে। লক্ষ্য ছিল একটাই, এলোমেলো প্রশাসনকে পরিপূর্ণভাবে নিজের কব্জায় নিয়ে আসা। সঙ্গে সঙ্গে বেআইনি ঘোষণা করা হলো সমস্ত রাজনৈতিক দলকে এবং বন্ধ করে দেয়া হলো সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপও। এরশাদের এই নির্দেশ অনেকে মাথা নুইয়ে মেনে নিলেও মানলো না কেবল আওয়ামী লীগ। ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে এরশাদের ক্ষমতা দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাভারের জাতীয় শহিদ মিনারের চত্বরে আওয়ামী লীগের বিশাল জনসভা হলো এবং সেই জনসভায় জাতীয় শহিদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, ‘আমরা এ সামরিক শাসন মানি না এবং মানবো না।’ 
এটাই ছিল এরশাদ ও সামরিক শাসনবিরোধী প্রথম জনসভা।

এরশাদ এরপর শুরু করলেন তার নতুন নাটক। তিনি ক্ষমতার দণ্ডটি তখনই হাতে ধরলেন না বটে, কিন্তু ধূর্ততার সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি আহসান উদ্দিন চৌধুরীকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবেই ঘোষণা করলেন।

এখানে একটা জিনিস গভীরভাবে ভেবে দেখাবার মতো। জিয়াউর রহমান মার্শাল ল জারি করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদটিতে বসিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতিকে। এভাবে সুকৌশলে বিচার ব্যবস্থাকে শাসন ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করার চক্রান্ত শুরু হলো। কেউ কেউ বলতে পারেন রাষ্ট্রপতির পদটিকে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কাজটি বাংলাদেশে প্রথম তো শুরু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

কিন্তু এখানে একটি কথা মনে রাখা দরকার, মুক্তিযুদ্ধকালে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীর অসাধারণ ভূমিকা, প্রবাসে স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা প্রভৃতি অবদানের জন্যে তিনি ছিলেন অনবদ্য ও অসাধারণ। প্রকৃতপক্ষে, দেশে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার প্রবর্তনের প্রয়োজনেই বঙ্গবন্ধু নিজে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে গিয়ে সেখানে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং বিচক্ষণ বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। সেটি ছিল কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্যে অত্যন্ত স্বল্পকালীন ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্যই ছিল পার্লামেন্টারি ব্যবস্থার মাধ্যমে সমগ্র শাসন কাঠামোকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে গড়ে তোলা। কাজেই একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগের সংযুক্তি আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে প্রশাসন যন্ত্রকে কুক্ষিগত করার মধ্যে মৌলিক তফাৎ তো রয়েছেই।

এবার আমরা আর একটি নাটকের একটি দৃশ্য দেখি। 
সেদিন ছিল রবিবার। ১৯৮৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদের গাড়ি চলছে বঙ্গভবনের দিকে। মাত্র কুড়ি মাস আগে পাঠক একই ধরনের দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন। তখন অবশ্য তার সঙ্গে ছিলেন কতিপয় সামরিক কর্তাব্যক্তি। আর এই বিশ মাস পরে এরশাদ সাহেব একা। অবশ্য কয়েকটা সামরিক গাড়ি তাকে অনুসরণ করছিল তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রয়োজনে। তখন তার সঙ্গে কোনো উচ্চপদস্থ ব্যক্তি নেই। আগেরবার তিনি এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে সরাতে। আর এবারে তিনি এসেছেন তার নিজের মনোনীত প্রেসিডেন্টকে অপসারণ করতে। এই মনোনীত প্রেসিডেন্ট হলেন বিচারপতি আহসান উদ্দিন। একেবারেই এরশাদের পুতুল। আহসান উদ্দিন নিজেও জানতেন তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এবার সরে যেতেই হবে। তাই তিনি কোনো রকমের উচ্চবাচ্য না করেই পদত্যাগপত্রে সই করে দিলেন। আর তখনই জেনারেল এরশাদ নিজেই নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণাও করে দিলেন। আর এ কথাও বললেন যে, তিনি নিজেই এই দায়িত্ব নিচ্ছেন কেবল সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে অতি দ্রুত গণতন্ত্রে ফিরে যাবার জন্যে।

এবার তিনি জিয়াউর রহমানের কৌশলটি গ্রহণ করলেন। তবে একটু অন্যরকম পদ্ধতিতে। জিয়াউর রহমান তার নিজস্ব ভঙ্গিতে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছিলেন যার নাম দিয়েছিলেন ‘জাগদল’। তিনি দিয়েছিলেন ১৯ দফা কর্মসূচি আর এরশাদ গঠন করলেন ‘জনদল’। সঙ্গে রইলো ১৮ দফা কর্মসূচি। ঐ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে একটা কেন্দ্রীয় পরিষদও গঠিত হলো আর এরশাদ হলেন তার প্রধান। এই কর্মসূচির আড়ালে এরশাদ তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার প্রস্তুতি নিলেন। যেহেতু ক্ষমতা দখলের সময় তিনি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ স্পর্শ করে বলেছিলেন যে,  তিনি নিজেকে কখনই রাজনীতিতে জড়াবেন না, তাই তিনি ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার আরও চতুর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। জিয়ার রাজনৈতিক দলের অনেকেই তখন অতি দ্রুত এরশাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা পরিষ্কার ধরিয়ে দিলেন এরশাদের চালাকি। ১৯৮৩ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক বিবৃতিতে তিনি বলেই দিলেন, ‘এরশাদ ক্রমশই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন এবং ইচ্ছে করেই দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করে নিজেই রাজনীতির সাইনবোর্ড তুলে ধরতে যাচ্ছেন।’ শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা প্রমাণিত হলো যখন পরবর্তী সময়ে এই প্লাটফর্মই জাতীয় পার্টির রূপ পরিগ্রহ করলো।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ