• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০১৯, ১২:১২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৭, ২০১৯, ১২:১৮ পিএম

জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেটের মৃত্যু: নেপথ্য ইতিহাস

জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেটের মৃত্যু: নেপথ্য ইতিহাস
আইসিসির নিষেধাজ্ঞা আপাতদৃষ্টিতে যতটা কঠিন বলে মনে হচ্ছে, জিম্বাবুয়ের জন্য সেই ক্ষতটা আরও গভীর। ফাইল ছবি

৩৬ বছর ১ মাস ১০ দিন পেরিয়ে অবশেষে হয়তো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেট শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল। আইসিসির দেয়া নিষেধাজ্ঞা শুরুতে যতটা কঠোর মনে হয়েছিল, আদতে আফ্রিকার দেশটির জন্য সেটা তার থেকে অনেক গুণ বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আগামী বছরের আইসিসি পুরুষ ও নারী টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেই অংশ নিতে পারবে না দেশটি। অর্থ সংকটে খেলতে পারবে না বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় টি-টুয়েন্টি সিরিজটাও। এফটিপিতেও তাদের কোনো খেলা থাকছে না।

জিম্বাবুয়ের মতো অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর একটি দেশ এসবের পর আর ক্রিকেটারদের জন্য আর্থিক বরাদ্দ জোগাড় করতে পারবে না বলেই সংশ্লিষ্ট সবাই মনে করছেন। যার মানে দাঁড়ায়, এক সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম প্রধান সদস্য দেশটির ক্রিকেটীয় মৃত্যু হয়ে গেছে আইসিসির নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পরই।

জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে না তাকালে এই নিষেধাজ্ঞার ভয়াবহতা অনুভব করা যাবে না। দেশটিতে সকালে একটি বেকারিতে রুটি প্রস্তুত করা হলে যে দামে বাজারে ছাড়া হয়, বিকালে সেই দাম হয়ে যায় তিন গুণ। নিরন্তর মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে জিম্বাবুইয়ানরা এখন প্রায় বিধ্বস্ত। লোডশেডিংয়ের কারণে দেশটির অতি গুরুত্বপূর্ণ কল-কারখানাগুলোও দিনে মাত্র ৬ ঘণ্টা চালু থাকে। প্রবল খরার কারণে দেশটির পানির উৎসগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। জরিপ বলছে, জিম্বাবুয়ের অনেক জনগণ এখন সপ্তাহে একবারের বেশি পরিস্কার পানি পান করার সুযোগ পান না! দেশটির ক্রিকেট যে ভেঙে পড়ছে তাতে এখন আর নিশ্চয় কাউকে আলাদা করে দোষারোপ করতে পারবেন না আপনি, কারণ দেশটির সবকিছুই যে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে মাটিতে মিশিয়ে যাচ্ছে!

খরার কারণে সুপেয় পানির সংকট জিম্বাবুইয়ানদের নিত্যসঙ্গী। ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

৮০ ও ৯০এর দশকে জিম্বাবুয়ে যখন তার 'রোডেশিয়া' পরিচয় ছেড়ে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে আসছে, তখনই মূলত তাদের ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয়। ১৯৮০ সালে ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে বেরনোর পর দেশটি স্বশক্তিতে ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়। এক ব্যর্থ নামমাত্র 'গণতান্ত্রিক' সরকার জিম্বাবুয়েকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকার এক গর্ভে। রবার্ট মুগাবের ৩৭ বছরের শাসনের প্রতিটি দিনই ধনীরা আরো সম্পদ বাড়িয়েছেন, দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়েছেন।

২০০৩ বিশ্বকাপে ওই সময়ের জিম্বাবুয়ের দুই ক্রিকেটার অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গা 'জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্রের মৃত্যুতে প্রতীকি শোক' হিসেবে কালো রঙের আর্মব্যান্ড পরিধান করে মাঠে নেমেছিলেন, যা ক্রিকেট ইতিহাসে 'ব্ল্যাক আর্মব্যান্ড প্রোটেস্ট' নামে পরিচিত। তবে বিশ্ব তাদের এই প্রতিবাদের ভাষাকে পাত্তা দেয়নি। পরের বছর জোর করে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিথ স্ট্রিককে অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হলে এর প্রতিবাদে দলের প্রধান ১৫ জন ক্রিকেটার অবসর নিয়ে নেন। মূলত জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের 'মহাপতন' তখনই শুরু।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার ও হেনরি ওলোঙ্গার কালো আর্মব্যান্ড। ফাইল ছবি

এরপর পিঠ বাঁচাতে টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জিম্বাবুয়ে। সাত বছর ক্রিকেটের এই অভিজাত ক্লাব থেকে দূরে থাকে তারা। মাঝের সময়টায় শুধুই ঘোর অন্ধকার, ২০০৭ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর মতো বিচ্ছিন্ন কিছু সাফল্য এলেও সেগুলো দেশটির ক্রিকেটে কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারেনি।

২০১০ সালে মার্কিন ডলারকে মুদ্রা হিসেবে নেয়ার পর কিছুটা উন্নতি দেখা দেয় জিম্বাবুয়ের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে। পরের বছর ২০১১ সালে আবার টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে আসে তারা। তবে খুব শীঘ্রই প্রতীয়মান হয়, ক্রিকেটটা চালিয়ে নেয়ার সক্ষমতায় বড়ই অভাব রয়েছে দেশটির। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজ আয়োজন করার পরই তারা ঘোষণা দেয়, আর কোনো সিরিজ আয়োজনের ব্যয় বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

জিম্বাবুয়ের সেরা পারফর্মার ব্রেন্ডন টেইলর দল ছেড়েছিলেন কোলপ্যাক চুক্তিতে। ফাইল ছবি

এরপরও জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট কিছুটা উত্থানের গল্প শোনায়। ২০০৩এ পদত্যাগ করা কিছু খেলোয়াড়ও কোচিং স্টাফের দায়িত্ব নিয়ে দলের সঙ্গে যোগ দেন। সব মিলিয়ে জোড়াতালি দিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটও চালিয়ে নিতে পারছিল দেশটি। বেশ কিছু ভালো ম্যাচও জিতছিল। তবে হরহামেশা খেলোয়াড়দের আন্দোলন, কোচিং স্টাফে পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ইত্যাদি লেগেই ছিল। ২০১৫ সালে ব্রেন্ডন টেইলর ও কাইল জারভিস কোলপ্যাক চুক্তি করে দেশ ছেড়ে গেলে দলটি আবার অন্ধকারে তলিয়ে যায়। তবে জারভিস ও টেইলর ২০১৮তে ফিরে এসে দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন, যাতে জিম্বাবুয়ে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে জায়গা পায়। তাতেও কাজ হয়নি, বিশ্বকাপে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন।

বিশ্বকাপে খেলতে না পারায় জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট চালানোর শেষ রসদটুকুও প্রায় শেষ হয়ে যায়। এত অবনমনের পর কোন কোম্পানিই বা দেশটির ক্রিকেটে অর্থ বিনিয়োগ করবে! আর সবশেষে তো বোর্ডের নির্বাচনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অজুহাতে তাদের আইসিসির সদস্যপদই বাতিল করা হলো।

সবকিছু বিচার বিশ্লেষণ করে একটি ব্যাপারই পরিস্কার হয়ে ওঠে, ক্রিকেটটা হয়তো জিম্বাবুয়ের মাটি থেকে পাকপাকিভাবেই বিদায় নিলো!

এমএইচএস  

আরও পড়ুন