• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০, ০৯:৫১ এএম
সর্বশেষ আপডেট : সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২০, ০৯:৫৬ এএম

প্রাণিকল্যান বিল- ২০১৯ উপেক্ষিত

বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে বেপরোয়া ডিসিসি কর্তৃপক্ষ

বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে বেপরোয়া ডিসিসি কর্তৃপক্ষ
- ফাইল ফটো

প্রাণিপ্রেমীদের তীব্র আপত্তি আর প্রতিবাদেও হলো না শেষ রক্ষা। অবশেষে বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। যা দেশের প্রচলিত  রাষ্ট্রবিধানের সঙ্গে রীতিমত সাংঘর্ষিক। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ কথা সুস্পষ্টভাবেই দাবি করা যায় যে, এই কার্যক্রমের ক্ষেত্রে,  প্রত্যক্ষভাবে আইনের বিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে যেগুলো সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রবিধি বিরোধী পদক্ষেপ।

অনেকেই বিতর্কিত পদক্ষেপটির তীব্র সমালোচনা করে বলছেন, প্রাণি অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকর্তৃক আরোপিত সুনির্দিষ্ট আইনের বিধানের প্রতি রীতিমত বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেই নগরীর বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকা দক্ষিন সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। আর এক্ষেত্রে মানবিক বিষয়াদি বিবেচনা করাতো দূর, সচেতন সমাজ ও প্রাণিপ্রেমীদের আহ্বানও আমলে নেয়নি সংশ্লিষ্টরা।

তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়টি হচ্ছে, প্রাণি অধিকার সংরক্ষণে ২০১৯ সালে প্রণীত আইনের বিধান 'প্রাণিকল্যান বিল - ২০১৯'- এর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারা লঙ্ঘণ করেই বিতর্কিত এই বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে বেপরোয়াভাবে কাজ করছেন সিটি কর্তৃপক্ষ। অথচ এই আইনি বিধানের লঙ্ঘণ দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। যার প্রেক্ষিতে বিষয়টি বর্তমানে শুধু প্রাণি নিধনের মত অমানবিক কর্মকাণ্ডের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই।

বিশিষ্টজনদের মতে, সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় বিধান লঙ্ঘণের মাধ্যমে তা এখন সংবিধান ও প্রচলিত রাষ্ট্রবিধি অবমাননার মত ধৃষ্টতায় পর্যবসিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমনতর ধৃষ্টতা প্রদর্শনের পরেও এ প্রসঙ্গে যেমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাঝে কোনো কিছু পরোয়া করার মত মানসিকতা দেখা যায়নি, তেমনি প্রচলিত আইনের বিধি লঙ্ঘণ সত্ত্বেও কোনো প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণে অপ্রত্যাশিতভাবে নিরব ভুমিকায় রয়েছে  রাষ্ট্রব্যবস্থা!

২০১৯ সালে প্রাণি অধিকার সংরক্ষন ও প্রাণি কল্যার্থে 'THE CRUELTY to ANIMAL ACT 1920' বিধানটির সংশোধন ও সংস্কারের মাধ্যমে 'প্রাণিকল্যান বিল - ২০১৯'  প্রণীত হয়। প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত আইনটি মৌখিক অনুমোদনের পর ২০১৯ সালের ১০ জুলাই (বাংলা ২৬ আষাঢ়, ১৪২৬) রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে এটি গেজেটভুক্ত বিধি হিসেবে প্রকাশিত হয়। 

আইনটির ধারা-৭ (মালিকবিহীন প্রাণি নিধন বা অপসারণ)- এর উপ-ধারা ১ : এই আইনে উল্লেখিত কোনো কারণ ব্যতীত, মালিকবিহীন কোনো প্রাণি নিধন বা অপসারণ করা যাবে না এবং উপ-ধার ২ : কোনো ব্যক্তি মালিকবিহীন কোনো প্রাণি করলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

এই ধারার প্রেক্ষিতে ডিসিসি কর্তৃক বেওয়ারিশ কুকুর অপসারণের কাজটি বিধি বিরুদ্ধ। কারণ, এই কাজের ক্ষেত্রে যদিও ডিসিসি কর্তৃপক্ষ 'কারণ' উপস্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো যথেষ্ট বলে বিবেচনা করা যায় না বলেই মনে করছেন অনেকেই। এক্ষেত্রে যে কারণগুলোর উল্লেখ পাওয়া গেছে তার প্রধান কারণটি হচ্ছে, কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। অন্য কারণগুলো এর থেকে সৃষ্ট। 

মালিবাগ নিবাসী একটি প্রাণিপ্রেমীরা সংগঠনের সক্রিয় সদস্য বলেন,  এর দায়বদ্ধতা সিটি কর্তৃপক্ষের। কারণ, আসন্ন প্রজনন মৌসুমকে সামনে রেখে প্রতিবার বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে যে বন্ধাত্ব্যাকরণ টিকা প্রদান কার্যক্রম চালানো হয় তা এবার করা হয়নি যার ফলে বেড়েছে কুকুরের সংখ্যা। যাদের অপারগতা বা ব্যর্থতায় এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে অপসারণ করার হলে ন্যায্যত তাদের করা উচিত।

তবে, এক্ষেত্রে উল্লেখিত কারণগুলো যদি বিবেচনায় নেয়াও যায় তার পরেও অপরাধীর কাঠগড়াতে থাকছেন সংশ্লিষ্টরা। আর সেটা হচ্ছে,  কুকুরগুলোর শরীরে ঘুমের/চেতনানাশক ইঞ্জেকশন প্রয়োগের দায়ে।

উল্লেখিত আইনটির ধারা- ১১ এর উপ-ধারা : ১ অনুসারে, কোনাে ঔষধ বা খাবার বিষাক্ত বা অনিষ্টকর জানা সত্ত্বেও কোনাে ব্যক্তি যদি প্রাণিকে উক্ত বিষাক্ত বা অনিষ্টকর ঔষধ বা খাবার অথবা বিষ মিশ্রিত খাবার খাওয়ান বা বিষ প্রাণির দেহে প্রয়ােগ করেন অথবা অনুরূপ কাজ করার চেষ্টা করেন বা করতে সহায়তা করেন , যার ফলে প্রাণির মৃত্যু বা স্থায়ী অঙ্গহানি হয় অথবা স্বাভাবিক আকার ও কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় , তাহলে তা এই আইনের অধীন অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে । অথচ, সেই বিধি লঙ্ঘন করে কুরগুলোর শরীরে এ ধরণের ওষুধ প্রয়োগের প্রত্যক্ষ ঘটনা গণমাধ্যমেরনজরে এসেছে।

সম্প্রতি,  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় দেখা যায়, বেওয়ারিশ কুকুর ধরতে জাল দিয়ে বিশেষ ফাঁদ তৈরি করছেন সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা আর তাদের সঙ্গে অপর একটি দল সিরিঞ্জে চেতনানাশক ওষুধ নিয়ে প্রস্তুত করে রাখছে। জালের ফাঁদে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কুকুর আটকে  প্রয়োগ করা হয় সেই ইঞ্জেকশন। তবে এটি টিকা প্রয়োগ কিংবা বন্ধ্যাত্বকরণ নয়, চেতনানাশক ঘুমের ওষুধ কুকুরের শরীরের প্রয়োগে এ তৎপরতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, দুই রকমের ইনজেকশন আছে। এগুলো দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়, তারপর মাতুয়াইল ময়লার প্রজেক্টে ফেলে দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের উপস্থিতি টের পেয়ে এক পর্যায়ে সদলবলে এলাকা ছাড়েন দায়িত্বরতরা। তবে, রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী এমন খামখেয়ালি কর্মকাণ্ডে হতাশ প্রাণিপ্রেমীরা।

পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, সে কি বাঘ নাকি সিংহ যে তাকে এভাবে অপসারণ করাতে হবে। এই ধরনের কাজ একেবারে ঘৃণ্য। স্পর্শকাতর এই কার্যক্রমে কোনো পশু চিকিৎসক না থাকা অমানবিক বলছেন তারা।

তিনি আরো বলেন, অজ্ঞান করার জন্য একজন ভেট লাগবে। ভেট তাদের শারিরীক পরিস্থিতি দেখবে।

এদিকে, দক্ষিণ সিটির মেয়রের সম্মতি থাকলেও কুকুর অপসারণে আপত্তি খোদ ভেটেরিনারি কর্মকর্তার।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ভেটেরিনারি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, মেয়র বার বার বলেছেন কুকুর কমাতে হবে। কিন্তু আমি বলেছি এভাবে করা যাবে না।

কুকুর অপসারণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসলে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো।

এসকে