• ঢাকা
  • শুক্রবার, ০৩ মে, ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০১৯, ০৯:৩০ পিএম

বই বিক্রি ৮০ কোটি টাকা

ভাঙল প্রাণের মেলা, বিক্রিতে রেকর্ড

ভাঙল প্রাণের মেলা, বিক্রিতে রেকর্ড
নতুন বই নেড়েচেড়ে দেখছেন পাঠক- ছবি : কাশেম হারুন

 

--------------------
‘‘প্রতিপাদ্য ছিল : বিজয় ৫২ থেকে ৭১, নব পর্যায়’’
--------------------

ভাঙল প্রাণের মেলা। শনিবার (২ মার্চ) রাত ৯টায় নিভল ভাষা আন্দোলনের স্মরণে আয়োজিত মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলার সব আলো। এবারের গ্রন্থমেলায় বিক্রি গতবারের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এ বছর বিক্রি হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বই। গতবারের চেয়ে সাড়ে ৯ কোটি টাকা বেশি। এর আগের বছর (২০১৭) মেলার মোট বিক্রি ছিল ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। 

একাডেমির সাধারণ জরিপ থেকে জানা গেছে, নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে এবারের মেলা। এ বছর প্রকাশিত হয়েছে ৪ হাজার ৮৩৪টি নতুন বই। এর মধ্যে মানসম্পন্ন বই ১ হাজার ১৫১। গতবার নতুন বই বের হয়েছিলো ৪ হাজার ৫৯০টি। তার মধ্যে মান সম্পন্ন বই ছিল ৮৫০।

১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ পর্যন্ত (বর্ধিত সময়সহ ৩০দিন)  শুধু বাংলা একাডেমিই ২ কোটি ৩০ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। গত বছর বিক্রি হয় ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা (২৮ দিনে)। মাসজুড়ে এবার প্রাঙ্গণে এসেছিলেন প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ। ৮দিন ছিল মেলার শিশুপ্রহর।

প্রকাশে কবিতা শীর্ষে, বিক্রিতে উপন্যাস
মেলা প্রকাশের দিক থেকে এবারও এগিয়ে ছিল কবিতা। প্রবীণ-নবীন কবি মিলিয়ে কবিতার বই এসেছে ১ হাজার ৬০৯টি। দ্বিতীয় অবস্থানে ছোটগল্প ৭৫৭টি। তৃতীয় অবস্থানে উপন্যাস ৬৯৮টি। চতুর্থ অবস্থানে প্রবন্ধ ২৭২টি। পঞ্চম অবস্থানে জীবনী ১৬৭। ষষ্ঠ শিশুতোষ ১৫০টি। সপ্তম অবস্থানে ছড়া ১৪৮টি। অষ্টমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই ১১০টি। নবম অবস্থানে ভ্রমণ ৮৫টি এবং দশম অবস্থানে যৌথভাবে ইতিহাস ও বিজ্ঞান ৭৭টি।

বিষয়ভিত্তিক অন্যান্য বইয়ের মধ্যে সায়েন্স ফিকশন ৪৫,  নাটক ৪৩, অনুবাদ ৩৮, রম্য/ধাঁধা ৩৭, রাজনীতি ৩৩, ধর্মীয় ২৫, রচনাবলী ১৫, অভিধান ৬ কম্পিউটার ৫ এবং অন্যান্য ৩৩০টি নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে। 

মোড়ক উন্মোচন
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে এবার নতুন বইয়ের উন্মোচন হয়েছে ৮২৫টি। এসব বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রায় দুই হাজার ৫৭৫ জন ব্যক্তিবর্গ। লেখক বলছি অনুষ্ঠানে যোগ দেন ১৩৪ জন লেখক-কবি-সাহিত্যিক।

শেষ দিনের মেলার চিত্র 
ঘঁড়ির কাঁটা বেলা ১১টা ছুঁতেই শনিবার (২ মার্চ) খুলে দেওয়া হয় মেলা গেট। মুর্হূতেই মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠে পাঠক-ক্রেতার পদচারণায়। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লোক সমাগম হয়েছে মেলার শেষ দিন শনিবার। দুপুরের পর থেকে তালিকা হাতে নিয়ে পছন্দের বইটির খোঁজে ব্যতিব্যস্ত হাজারো পাঠক-ক্রেতা। সন্ধ্যায় জনারণ্যে পরিণত হয় মেলা।

শেষ দিনেও প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ছিল প্রচণ্ড ব্যস্ততা। বিক্রয়কর্মীদের গলদঘর্ম পরিশ্রম করতে দেখা গেছে ক্রেতাদের চাহিদামাফিক বইয়ের যোগান দিতে গিয়ে। বাংলা একাডেমি, অন্যপ্রকাশ, পাঞ্জেরী, আগামী, ঐতিহ্য, সময়, ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ, তাম্রলিপি, আদর্শ, অবসর, প্রথমা, ইউপিএল, ইত্যাদি, অনুপম, সাহিত্যপ্রকাশ, কথা প্রকাশ, বিদ্যাপ্রকাশ, পাঠক সমাবেশ, কাকলী, অনন্যা, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, উৎস, অ্যাডর্ন, শ্রাবণসহ বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ছিল ক্রেতায় ঠাসা।

মেলা নিয়ে বিশিষ্টজনের অভিমত 
একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন বলেন, মেলার শেষ দিকে এসে মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার এমন একটি প্রাণোচ্ছ্বল মেলার জন্য সারাবছরই অপেক্ষায় থাকব। জ্ঞান ও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমদ বলেন, এবারের মেলার আয়োজন চমৎকার ছিল। যদিও দুইদিন বৃষ্টি বাগড়া দিয়েছে। তারপরেও মেলা হয়েছে জমজমাট।

পাঞ্জেরী প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী কামরুল হাসান শায়ক বলেন, একুশে গ্রন্থমেলা এ দেশের সাংস্কৃতিক জাগরণকে ক্রমাগত সংহত ও শাণিত করে তুলছে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিশাল পাঠক সমাজ। সাহিত্য ও সৃজনশীল চিন্তা-চেতনার যারা নিরন্তর সাধক, তাদেরও সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।

একাডেমির মহাপরিচালক ও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বলেন, মেলার সাফল্য নিয়ে আমরা অভিভূত। সবার সহযোগিতায়ই এমন সফল সমাপ্তি ঘটেছে। বইমেলাকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য সব মহলের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে।

উদ্বোধন ও অন্যান্য তথ্য 
১ ফেব্রুয়ারি মেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একাডেমির রবীন্দ্র চত্বরে মেলা মঞ্চে প্রতি সন্ধ্যায় পরিবেশিত হয় নানা বিষয়ের সংযোজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ২৫টি বিষয়ে প্রায় শতাধিক প্রাবন্ধিক ও আলোচক অংশ নেন সেমিনারে। ছিল শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সঙ্গীত প্রতিযোগিতা। 

বইমেলার উদ্বোধন ঘোষণার আগে প্রধানমন্ত্রী এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া চারজনের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এবার কবিতায় কবি কাজী রোজী, কথাসাহিত্যে মনোরোগ চিকিৎসক মোহিত কামাল, প্রবন্ধ ও গবেষণায় বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের জন্য গবেষক-কলামিস্ট আফসান চৌধুরী এ পুরস্কার পেয়েছেন। 

এবারের একুশে গ্রন্থমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশকে ১২টি চত্বরে সজ্জিত করা হয়। একাডেমি প্রাঙ্গণে ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে ১১৪টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৫৪৯টি ইউনিট; মোট ৪০৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৬৩টি ইউনিট এবং বাংলা একাডেমিসহ ১৫টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে মোট ৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১৫টি প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় লিটল ম্যাগাজিন চত্বর ছিল বর্ধমান হাউসের পেছনে।

যা কিছু নতুন ছিল এবারের মেলায়
এবারই প্রথম গুগল ম্যাপের মাধ্যমে মেলার যেকোনো স্টল খুঁজে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। দোয়েল চত্বর ও টিএসসিতে দুটি বড়পর্দা স্থাপন করে সেখান থেকে মেলায় প্রবেশের তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল ‘নতুন বইয়ের প্রদর্শনশালা’। এতে প্রতিদিন প্রকাশিত নতুন বই দিনভিত্তিক সাজানো ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে পর্যটন করপোরেশনের ১টি ক্যান্টিন এবং বাংলা একাডেমি অংশে পর্যটন করপোরেশনের ১টিসহ ২টি ক্যান্টিন ছিল মেলায় আগতদের জন্য। এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে স্টলগুলোতে টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পর্যাপ্ত মাটি ফেলে জমি ভরাট করা হয়। প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট এলাকায় ইট ও বালু দিয়ে অস্থায়ী রাস্তা ও উন্মুক্ত প্রান্ত বানানো হয়। মেলার ব্যবস্থাপনা সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল নিরাপদ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন লিমিটেড। কবি-সাহিত্যিক-মনীষীসহ বিশিষ্টজনদের নামাঙ্কিত প্রতিটি চত্বরেই আলাদা রঙের এলইডি বাতির সাহায্যে বর্ণিল রূপ দেওয়া হয়। চত্বরগুলোর স্বতন্ত্র রঙিন বাতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেসব চত্বরের অন্তর্ভুক্ত প্রকাশনা সংস্থাগুলোর স্টলসজ্জায়ও সেই বিশেষ রঙের প্রাধান্য দেওয়া হয়। শিশুদের জন্য মাতৃদুগ্ধ পানের আলাদা একটি স্টল ছিল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরের অংশে ব্রেস্ট ফিডিংয়ের জন্য আলাদা স্টল করে দেওয়া হয়। 

ইতিহাস রচিত
এক রকম ইতিহাস রচনা করেছে এবারের গ্রন্থমেলা। অতীত বলছে, ১৯৯৫ সালে বিশেষ কারণে কয়েকদিন মেলার সময় বর্ধিত করা হয়। কিন্তু এবার বৃষ্টির কারণে প্রকাশকদের দাবির মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুই দিন সময় বাড়ানো হয়। শনিবার (২ মার্চ) ছিল মেলার শেষ দিন।

এসএমএম