• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ৬, ২০১৯, ১০:১২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৬, ২০১৯, ১০:১২ এএম

মহাসড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল  

মহাসড়কে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল  

 

দীর্ঘ হচ্ছে মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা সারা জীবনের জন্য একটি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চলন্ত গাড়িতে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে ঘটেছিল এসব দুর্ঘটনা। শুধু তাই নয়, চালকের খামখেয়ালির কারণে প্রতিদিনই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। বুয়েটের গবেষণা বলছে, ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।

এদিকে টানা ৭ দিন সড়ক, রেল ও নৌ পথের যাত্রার মাধ্যমে শেষ হল ঈদুল ফিতরের ঈদ যাত্রা। ঈদ যাত্রার শেষ দিকে এসে টাঙ্গাইল, যমুনা সেতু ও সিরাজগঞ্জে যাত্রীদের কিছুটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। তবে সার্বিক বিবেচনায় এবারের ঈদ যাত্রা অন্য যেকোনো বারের তুলনায় স্বস্তিদায়ক হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

কিন্তু ঈদ যাত্রা স্বস্তিদায়ক হলেও কমেনি সড়কের মৃত্যুর হার। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঈদের দিনসহ গত ৭ দিনে সারাদেশে ৭১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু ঈদের দিনই ১৯ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সূত্রে মতে জানা গেছে, ৩০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া ঈদ যাত্রায় এখন পর্যন্ত ৭১ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। তবে এই সংখ্যা এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট নয়। নিহতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এবারের ঈদ যাত্রায় ঢাকা বিভাগে ২১ জন, চট্টগ্রামে ৭ জন, রাজশাহীতে ১৯ জন, খুলনায় ৯ জন, সিলেটে ৮ জন, রংপুর ৫ জন, ময়মনসিংহে একজন এবং বরিশাল বিভাগে একজন নিহত হয়েছে।

জানা গেছে, এবারের ঈদ যাত্রায় ঢাকা বিভাগের সড়ক ও মহাসড়কে ২১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ফরিদপুরে ৬ জন, গোপালগঞ্জে ৩ জন, টাঙ্গাইলে ২ জন, রাজবাড়ীতে একজন, নরসিংদীতে একজন, কিশোরগঞ্জে একজন, মুন্সিগঞ্জে একজন, মাদারীপুরে দুইজন, নারায়ণগঞ্জে একজন, গাজীপুরে একজন, সাভারে একজন এবং ধামরাইয়ে একজন নিহত হয়েছেন।

মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনীর। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঘটে আরেক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা। সেদিন বঙ্গবন্ধু-বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা দেখে মিনিট্রাকে করে বাড়ি ফিরছিল স্কুলশিক্ষার্থীরা। মিরসরাইয়ের বড় তাকিয়া-আবু তোরাব সড়কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মিনিট্রাকটি পাশের ডোবায় পড়ে গেলে সেখানেই মারা যায় ৪৫ জন স্কুলছাত্র। 

এছাড়া বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক জগলুল আহমেদ চৌধুরী ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাসের চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মারা যান। এর পরের বছর রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে বেপরোয়া ট্রাকের ধাক্কায় মারা যান সিনিয়র সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ফারুক। ওই ৪টি দুর্ঘটনার জন্যই দায়ী ছিল গাড়িচালক। 

জরিপে জানা যায়, প্রতি বছরে সারাদেশে যত মানুষ আত্মহত্যা করে, পানিতে ডুবে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হয়ে এবং হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মারা যান। তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনায়। জাতিসংঘে বাংলাদেশ অঙ্গীকার করেছিল, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা কমছে না। মোবাইল কানে দিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় গাড়িচাপা পড়া এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। 

জানা গেছে, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণি, আগারগাঁও, কাকলী, জোয়ার সাহারা, উত্তরার জসীমউদ্দীন সড়ক মোড়। এ ছাড়া কাকলী, ধানমণ্ডি, টেকনিক্যাল মোড়ও দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। মেয়র হানিফ উড়াল সড়কেও দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে।

শুধু তাই নয়, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, পার্ক, জাদুঘর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কারণে রাজধানী ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত এলাকা শাহবাগ। ব্যস্ততম এই এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে প্রায় সময় দুর্ঘটনার শিকার হয় সাধারণ মানুষ। সর্বশেষ শিশু পার্কে ঘুরতে এসে শাহবাগে বাসচাপায় নিহত হয় খাদিজা নামের এক শিশু। শাহবাগে যাতে আর কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে, সে জন্য সেখানে একটি আন্ডারপাস নির্মাণে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে একনেক সভায় নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি আন্ডারপাসের। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এমআরআই) সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছে। দুর্ঘটনায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা নিয়ে বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনেক গবেষণা করেছে। এসব গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে ২১ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংকের হিসাবে এই সংখ্যা ১২ হাজার। বুয়েটের হিসাবেও এই সংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজারের মধ্যে। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা সাড়ে আট হাজার। 

আর পুলিশের তথ্য বলছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার মানুষ। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির এক থেকে দুই শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যান, তাদের ৬০ শতাংশই কর্মক্ষম। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। ফলে দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় অনিশ্চয়তা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো.মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, মহাসড়ক সুন্দর হয়েছে আগের তুলনায়। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। তাই গতি বেড়েছে গাড়ির, কিন্তু গতি নিরাপদ করা হয়নি। তাই রাস্তায় ঈদ যাত্রায় এতো প্রাণহানি হয়েছে। গতি বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে গতিকে নিরাপদে রাখতে হবে। না হলে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো কঠিন।

এইচ এম/টিএফ