গায়ে কেরোসিন জাতীয় দাহ্য তরল পদার্থ নিক্ষেপ ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে মানুষ হত্যার মত নৃশংস ঘটনা ঠেকানো যাচ্ছে না।দেশের আলোচিত ফেনী জেলার সোনাগাজী এলাকায় মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর পর একে একে দেশের কয়েকটি স্থানে একটি চক্র একই কৌশলে শিক্ষার্থী অথবা গৃহবধূর গায়ে কেরোসিন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন ধরিয়ে মানুষ হত্যা করছে। গত এক সপ্তাহে দেশের নরসিংদী, রাজবাড়ী ও ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে এ ধরনের মার্মন্তিক ঘটনা ঘটছে। এসকল ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন। পাশাপাশি ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং ভিকটিমকে হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ সহযোগিতা করছেন। মামলার পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা ও চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন। তারপরও ঠেকানো যাচ্ছে না নরপশুদের এমন নিছক কাণ্ড।
জানা গেছে, শনিবার (৬ এপ্রিল) সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। ওই সময় তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের উপর কেউ মারধর করেছে এক ছাত্রীর এমন সংবাদে ভবনের চারতলায় যান তিনি। সেখানে মুখোশ পরা চার-পাঁচ ছাত্রী তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। এতে অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায় তারা। বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাত জাহান রাফি মারা যান। এ ঘটনায় পিবিআই তদন্ত পূর্বক সর্বমোট ২১ জনকে আটকের পর ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।
এ ঘটনার রেস না কাটতেই নরসিংদীতে এক ছাত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে তার শরীরের ২০ ভাগ পুড়ে গেছে বলে জানায় চিকিৎসকরা। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জুন) রাত সাড়ে ৮টায় নরসিংদী পৌর এলাকার বীরপুর মহল্লায় এ ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ ওই মেয়ে নরসিংদীর উদয়ন কলেজ থেকে গত বছর এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানায়, বাড়ির পাশে একটি দোকানে মোবাইল ফোনে টাকা রিচার্জ শেষে বাসায় ফিরছিলেন ওই ছাত্রী। এ সময় দুইজন দুর্বৃত্ত তার হাত-মুখ চেপে ধরে পাশের একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে কেরোসিন ঢেলে তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
নরসিংদী শহর ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক মিজানুর রহমান জানান, খবর পেয়ে হাসপাতালে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলাসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। তদন্তের পর আগুন লাগানোর কারণ ও কারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তা বলা যাবে।
অপরদিকে রাজবাড়ীতে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইলের পর টাকা আদায় করতে না পেরে স্কুলছাত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ কয়েকটি ধারায় মামলা হয়েছে। পুলিশ বলেছে, গত শনিবার ভোরে রাজবাড়ী সদর থানায় স্কুলছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে শিল্পী বেগম নামে এক নারীসহ অজ্ঞাত পরিচয় ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। অভিযুক্ত শিল্পী রাজবাড়ী সদর উপজেলার খোলাবাড়িয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর মিজির স্ত্রী।
এ বিষয়ে ছাত্রীর বাবা মামলায় অভিযোগ করেন, ১২ এপ্রিল স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অজ্ঞাত পরিচয় কয়েকজন লোক তার মেয়েকে রাস্তার পাশে জঙ্গলে নিয়ে হত্যার ভয় দেখিয়ে আপত্তিকর ছবি তোলে। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে শিল্পী বেগম দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। কিন্তু পরিবার টাকা দেয়নি। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তার মেয়ে বাড়ির বারান্দায় বসে জাম খাচ্ছিল। এ সময় বোরকা পরা দু’জন লোক এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়। বাড়ির পেছনে একটি পাট ক্ষেতে নিয়ে ওড়না দিয়ে তার হাত-পা ও মুখ বেঁধে গায়ের কাপড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখানে আগে থেকে আরও দু’জন বোরকা পরা লোক ছিল। এ সময় তার মেয়ে মাটিতে গড়াগড়ি করে আগুন নিভিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়। পরে মেয়ের মাসহ অন্যরা গিয়ে তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠায়।
সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্বপন কুমার মজুমদার জানান, মেয়েটির আংশিক পোড়া কামিজ ও পায়জামা উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ ব্যাপারে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনসহ কয়েকটি ধারায় মামলা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে পুলিশের দুটি টিম মাঠে কাজ করছে। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
দগ্ধ স্কুলছাত্রী বলেন, পাশের গ্রামের একটি ছেলে আমাকে পছন্দ করত। বিষয়টি স্থানীয় শিল্পী বেগম জানত। আর এটাকে কাজে লাগিয়ে সে আমার কাছে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় তারা আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়।
অপরদিকে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে যৌতুকের টাকা না পেয়ে গৃহবধূর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে গত শুক্রবার (৮ মে) রাতে থানায় মামলা হয়েছে। মামলার আসামিরা হলেন- স্বামী শরিফ মিয়া (২৪), শ্বশুর সাহাব উদ্দিন (৫৫), শাশুড়ি হাছেনা খাতুন (৪৫), দেবর মিজানুর রহমান (১৮) ও হোমিও ডাক্তার ফারুক মিয়া (৪৫)। এদের মধ্যে ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের কুমারখালী গ্রামের আব্দুল হাইয়ের মেয়ে শিরিনা আক্তারের সঙ্গে ৮ মাস পূর্বে কুর্শিপাড়া গ্রামের সাহাব উদ্দিনের পুত্র শরিফ মিয়ার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও দেবর যৌতুকের টাকা এনে দেয়ার জন্য শিরিনাকে চাপ প্রয়োগ করে আসছিল। দরিদ্র পিতার কাছ থেকে টাকা এনে দিতে অপারগতা জানালে স্বামী শরিফ নানাভাবে শিরিনাকে মারপিট ও মানসিক নির্যাতন করত।
সর্বশেষ ১ জুন সকালে শরিফ শিরিনাকে যৌতুক বাবদ ১ লাখ টাকা এনে দেয়ার জন্য চাপ দেয়। পিতার কাছ থেকে টাকা আনা সম্ভব নয় বলে জানালে ওই দিন বেলা সাড়ে ১২টার দিকে স্বামী শরিফ মিয়া ঘরে শিরিনাকে আটকে ব্যাপক মারধর করে। এক পর্যায়ে শিরিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় শরিফ। এতে শিরিনার শরীর ঝলসে যায়। পরে বাড়ির লোকজন শিরিনার বাবাকে খবর না দিয়ে ৫ দিন বাড়িতে রেখে হোমিও চিকিৎসা দেয়। শিরিনার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে দিনমজুর বাবা আব্দুল হাই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মেয়েকে উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মমেক) বার্ন ইউনিটে ভর্তি করেন। কর্তব্যরত ডাক্তার জানিয়েছেন, শিরিনার শরীরের প্রায় ৭০ ভাগ ঝলসে গেছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় রায়েরবাজার তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর আব্দুল মোতালিব চৌধুরী বলেন, হাসপাতালে একজন উপ-পরিদর্শক শিরিনার জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন। এ ঘটনায় ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
ময়মনসিংহ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাখের আহম্মেদ সিদ্দিকী জানান, ঘটনার খবর পেয়ে তিনি শিরিনাকে দেখতে মমেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যান এবং শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
গায়ে কেরোসিন ঢেলে পুড়িয়ে মানুষ মারার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি মিডিয়া সোহেল রানা বলেন, সমাজে বিকৃত রুচির মানুষ রয়েছে। যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত। এদের মতো লোকজনই এ ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ করতে পারে। তিনি বলেন, এ ধরনের অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করানো হচ্ছে। বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হচ্ছে। এ বিষয়ে কোন রকম ছাড় দেয়া হচ্ছে না বলে তিনি জানান।
এইচ এম/টিএফ