• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯, ০৮:৩৫ এএম

পাঁচ বছরে রাজধানীতে অর্ধশতাধিক প্রবীণ খুন

পাঁচ বছরে রাজধানীতে অর্ধশতাধিক প্রবীণ খুন


একের পর দুর্বৃত্তের হামলায় রাজধানীতে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা। ঘরের ভেতরেই ঘটছে এ রকম ঘটনা। কখনো গলা কেটে অথবা শ্বাসরোধে হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি ছুরিকাঘাতে এবং মাথায় আঘাত করেও হত্যা করা হচ্ছে। বদ্ধ ঘর বা ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে হাত-পা বাঁধা মরদেহ। 
গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে নিজ ঘরে খুন হয়েছেন অর্ধশতাধিক প্রবীণ ব্যক্তি।

ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটের জন্যই প্রবীণদের হত্যা করা হচ্ছে। শুধু ডাকাতরাই নয়, পরিচিতরাও খুনির ভূমিকায় নেমেছেন। তবে বিশেষ করে গৃহকর্মী, গাড়ি চালক, নিরাপত্তাকর্মীদের হাতেও নির্মমতার শিকার হচ্ছেন প্রবীণরা।

রাজধানীতে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার। রাজধানীর সাইন্স ল্যাবরেটনি এলাকার সুকন্যা টাওয়ারের নিজ ফ্ল্যাটে খুন হন ইডেন মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাহফুজা চৌধুরী। এ হত্যা মামলায় তার দুই গৃহকর্মী রেশমা ও স্বপ্নাকে খুঁজছে গোয়েন্দারা। ঘটনার ২দিন পার হয়ে গেলেও পলাতক গৃহকর্মীদের  গ্রেফতার করতে পারে আইন-শৃংখলা বাহিনী। 

গোয়েন্দাদে ধারণা, ডাকাতির উদ্দেশে মাহফুজাকে হত্যা করা হয়েছে। গৃহকর্মীরা বিপুল পরিমাণের টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার দেখে লোভের বশবর্তী হয়েই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। তবে তাদেরকে বাইরে থেকে কেউ বা কোনও চক্র পরামর্শ দিয়েছে বলেও মন্তব্য করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।   

পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, ঘটনার পর থেকে দুই গৃহকর্মী রেশমা ও স্বপ্না পলাতক রয়েছে। দুই গৃহকর্মী সরবরাহকারী রুনু ওরফে রাকিবের মাও পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তারা পরিকল্পিতভাবে মাহফুজা চৌধুরীকে হত্যার পর স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়েছে। 
এ ঘটনায় নিহতের স্বামী ইসমত কাদির গামা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে। আমরা সন্দেহভাজন হিসেবে দুই গৃহকর্মীকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।

রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর কলাপট্টিতে নিজ বাসায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী রওশন আরাকে গলা কেটে হত্যা করে তারই বাসার গৃহকর্মী লাকি আক্তারের ছেলে সাঈদ হাওলাদার ও তার সহযোগী রিয়াজ। রওশনকে হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় নিজের বোন কল্পনাকেও হত্যা করে সাঈদ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, বাসা-বাড়িতে লুট ও প্রবীণদের হত্যার বেশিরভাগ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন তারা। তবে সন্দেহভাজনদের পরিচয় না পাওয়ায় অনেক সময় বিপত্তিতে পড়তে হয় তদন্তকারীদের। তাই প্রবীণদের নিরাপত্তার বিষয়ে পরিবারের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি ভৃত-কর্মচারী নিয়োগে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

গত বছর ১ মার্চ রাতে রামপুরার বাসায় অবসরপ্রাপ্ত কর কমিশনার আবু তাহেরকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পরে তার গাড়িচালক নাছির ও তার সহযোগী রাসেলকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। পুলিশ জানায়, আটজন মিলে নাছিরের স্ত্রীকে বেঁধে তাকে হত্যা করে। পরে বাসা থেকে ১২ ভরি সোনা ও ৪৫ হাজার টাকা নিয়ে যায়।

গত বছর ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার মহানগর আবাসিক এলাকার বাসায় খুন হন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সাবেক ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রয়াত আখতার-উল-আলমের মেয়ে ফাহমিদা আখতার বিথুন। নিজের ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন তিনি। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচিত কেউ টাকা ও সোনার অলংকার লুটের উদ্দেশে তাকে হত্যা করা হয়েছে।

গত বছরের ২৭ অক্টোবর মিরপুরে বাসায় ঢুকে হাত-পা বেঁধে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বৃদ্ধা হোসনে আরাকে। বাসা থেকে খোয়া যায় দুই লাখ টাকা। ঘটনার পর থেকে হোসনে আরার বড় ছেলে দেলোয়ার হোসেনের ওয়ার্কশপের কর্মচারী রাকিব ও তার দুই বন্ধু পলাতক। দেলোয়ার জানান, বাসায় সব সময় টাকা থাকত। মা বাসায় একা ছিলেন। তাই ঘটনা ঘটিয়ে ওরা (রাকিব ও তার বন্ধুরা) পালিয়ে যায়। আমি রাকিবের ঠিকানা রাখিনি। তাই মায়ের খুনিদের খুঁজে পাইনি। 
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার এসআই ইমানুর রহমান বলেন রাকিবকে ঘিরেই রহস্য দেখা দিয়েছে।

২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর রামপুরার ওয়াপদা রোডে নিজের বাসা থেকে উদ্ধার হয় প্রবীণ ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদের হাত-পা বাঁধা লাশ। তিনিও বাড়িতে একাই থাকতেন। ঘটনার পর তার গাড়িচালক হুমায়ুন কবিরকে গ্রেফতারের পর র‌্যাব জানান, টাকা লুটের জন্যই এ হত্যাকান্ড ঘটানো হয়। 

২০১৫ সালের ২৯ আগস্ট রামপুরার বাসায় গুলি করে হত্যা করা হয় সিআইডির অবসরপ্রাপ্ত এএসপি ফজলুল করিমকে। টাকা লুটের জন্যই দুর্বৃত্তরা তাকে খুন করেছে বলে জানায় পুলিশ।

২০১৩ সালের ৩১ জুলাই দক্ষিণখানের নিজ বাড়িতে সেনাবাহিনীর সাবেক ওয়ারেন্ট অফিসার নাছির উদ্দিনকে কুপিয়ে এবং তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মুক্তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিন বছরেও এই জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। ওই দম্পতির মেয়ে শাহনাজ বেগম কাকন বলেন, আমার বৃদ্ধ মা-বাবাই শুধু ওই বাড়িতে থাকতেন। তাদের সঙ্গে কারো বিরোধ থাকার কথা নয়। কেনো তারা খুন হলেন, তা আজো জানলাম না। বাসা থেকে তিন-চার ভরি স্বর্ণালংকার খোয়া গেছে। হয়তো কিছু টাকাও ছিল।

২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মিরপুরে বাসায় খুন হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব-ই-সাত্তারের স্ত্রী ও হাইকোর্টের প্রবীণ আইনজীবী রওশন আক্তার। বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী তাজুল ও রাসেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ জানায়, তারা টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের জন্যই হত্যা করে রওশনকে। দুইজন চাকরি করার জন্য ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেছিল।

ওই বছর ৯ জানুয়ারি রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ১৬/এফ নম্বর ভবনের নিজ ফ্ল্যাট থেকে বৃদ্ধা ভার্জিনিয়া রোজারিও এবং তার ছেলে ভ্যালেন্টাইন রোজারিও মিল্টনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনজনকে গ্রেফতারের পর পুলিশ জানায়, টাকার জন্যই ওই জোড়া খুন হয়। 
একই বছর ২৮ জানুয়ারি ৭৭ নয়াপল্টন মসজিদ গলির ভাড়া বাসা থেকে দৈনিক জনতার সিনিয়র সহ সম্পাদক ফরহাদ খাঁ ও তার স্ত্রী রহিমা খানমের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ফরহাদ খাঁর বোনের ছেলে নাজিমুজ্জামান ইয়নকে গ্রেফতা করে পুলিশ। জানা গেছে, টাকার জন্যই মামা ও মামীকে হত্যা করে ইয়ন।

২০০৪ সালে হত্যা করা হয় রাজধানীর লালমাটিয়া মহিলা কলেজের অধ্যাপক ও তার মেয়েকে। গৃহকর্মী রোমেনা ও তার সহযোগী ফুটপাতের সবজি ব্যবসায়ীর যোগ-সাজশে মা ও মেয়ে ধানমণ্ডির নিজ ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধ ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। মা-মেয়ে হত্যার পর খুনিরা বাসা থেকে নগদ টাকা ও গহনা লুট করে নিয়ে যায়। এ ঘটনার প্রায় এক বছর পর ডিবি পুলিশ গৃহকর্মীর গ্রামের বাড়ি থেকে রোমেনাকে গ্রেফতার করে। লুট করে নেয়া টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করেছে ডিবি। 

এমন বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের পর গৃহকর্মী ও গাড়িচালকদের জীবনবৃত্তান্ত সংগ্রহের পদক্ষেপ নেয় ডিএমপি। ২০১১ সালে এলাকার কমিউনিটি পুলিশ ও বিট পুলিশের মাধ্যমে তালিকা সংগ্রহ করতে বলা হয় স্থানীয় থানার ওসিকে। 
সূত্র জানায়, ২০০৭ সালেও ডিএমপি সদর দফতর থেকে ভাড়াটিয়াদের ছবি সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় ফরম পাঠানো হয়েছিলো সেটি ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হলেও রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষ তাদের গৃহকর্মী, গাড়ীচালক, কেয়াটেকারের ভোটার আইডি কার্ড ও চেয়ারম্যান অথবা কাউন্সিলরের সনদ নিয়ে রাখছেন না। এগুলো নিলেও ভুয়া না সত্যি তা যাচাই-বাছাই করছেন না। 

এ বিষয়ে রাজধানীবাসীকে সতর্কতার পাশাপাশি সচেতন হওয়ার আহবান জানান পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম। 

এইচএম/এসএমএম