• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০১৯, ০৮:৫১ এএম

কমলাপুর আইসিডিতে পণ্য খালাসে ভয়াবহ জালিয়াতি 

কমলাপুর আইসিডিতে পণ্য খালাসে ভয়াবহ জালিয়াতি 

 

রাজধানীর কমলাপুর আইসিডিতে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। পূর্ব পরিকল্পিতভাবে চালান খালাস নিতে প্রথমে ভুয়া বিল অফ এন্ট্রি, অ্যাসেসমেন্ট অর্ডার, শুল্ক পরিশোধের কাগজপত্র বানায় সিএন্ডএফ এজেন্ট। সেগুলো ডেলিভারি অর্ডার দেয়ার জন্য শিপিং এজেন্টের কাছে পাঠানো হয়। শিপিং এজেন্টকে সেই জাল কাগজপত্রের ভিত্তিতে ডেলিভারি অর্ডার দিতে দেয়। এই ডেলিভারি অর্ডার দিয়েই বন্দর থেকে পণ্য বের করে নেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, পণ্য বিহীন খালি কন্টেইনার বন্দরে পড়ে থাকলেও পণ্য যে উধাও হয়েছে তা প্রথমে টের পায়নি কাস্টমস বা বন্দর কর্তৃপক্ষ। শিপিং এজেন্ট যখন খালি কন্টেইনার রফতানির জন্য অন্য সিএন্ডএফ এজেন্টকে দায়িত্ব দেয় তখন বিষয়টি সবার নজরে আসে। শিপিং এজেন্টের মনোনীত সিএন্ডএফ এজেন্ট খালি কন্টেইনার বুঝে নিতে বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে বন্দর থেকে বলা হয় কন্টেইনার খালি হয়নি, মালামাল আছে। সিএন্ডএফ এজেন্ট শিপিং এজেন্টের কাজগপত্র দেখালে বন্দরের লোকজন সরেজমিনে গিয়ে কন্টেইনার ফাঁকা পড়ে থাকতে দেখেন। 

ঘটনা জানাজানির হওয়ার পর বন্দরের ওয়ান স্টপ সার্ভিস শাখায় কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। নিয়ম অনুযায়ী, চালান খালাসে পণ্যের বর্ণনা উল্লেখ করে বিল অফ এন্ট্রি জমা দিতে হয়। সে অনুযায়ী পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট হয়। পরে শুল্ক দিয়ে কন্টেইনার থেকে মালামাল বের করতে সব কাগজপত্র শিপিং এজেন্টকে পাঠাতে হয়, ডেলিভারি অর্ডারের জন্য। এই ডেলিভারি অর্ডারসহ আনুষাঙ্গিক কাগজপত্রের ভিত্তিতে বন্দর থেকে পণ্য খালাস হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ঘটেছে বড় ধরণের জালিয়াতি। ভুয়া কাগজপত্রে পণ্য উধাও।

অভিযুক্ত সিএন্ডএফ এজেন্ট করোনা এ্যাসোসিয়েটসের স্বত্বাধিকারী সাইফুল ইসলাম সোহেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগরণের সঙ্গে এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সাইফুল ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের দফতর সম্পাদক হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি বলেছেন, থানায় মামলা হয়েছে। বর্তমানে জামিনে আছি। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমলাপুর আইসিডির কমিশনার আনোয়ার হোসাইন বলেন, কাস্টমসের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম। সিএন্ডএফ এজেন্ট জাল কাগজপত্র বানিয়ে রাতের আঁধারে পণ্য নিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে কাস্টমসের গাফিলতি নেই। বন্দর কর্তৃপক্ষের কাজ বন্দর এলাকায় আমদানি পণ্যের সুরক্ষা দেয়া। আর কাস্টমসের কাজ হচ্ছে আমদানি পণ্যের শুল্ক আদায় ও অবৈধ পণ্য দেশে ঢুকছে কিনা তার দেখভাল করা। জালিয়াতির ঘটনার জানার সঙ্গে সঙ্গে ওই সিএন্ডএফ এজেন্টের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এছাড়াও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

কমলাপুর আইসিডির ডেপুটি টার্মিনাল ম্যানেজার আহমেদুল করিম চৌধুরী বলেন, বন্দরের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

এ বিষেয় ঢাকা কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফরিদ উদ্দিন বলেন, গঠনতন্ত্রে এ ধরনের বিষয় না থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। অ্যাসোসিয়েশন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে অ্যাসোসিয়েশর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। 

সূত্র আরো জানায়, এই ঘটনায় কাস্টমস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ একে অন্যের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। কাস্টমস বলছে, বন্দরের কন্টেইনার দেখভালের দায়িত্ব বন্দর কর্তৃপক্ষের। শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব কাস্টমসের। যেহেতু কাস্টমসের কাগজ জাল-জালিয়াতি করা হয়েছে তাই এ ঘটনার পুরো দায়ভার কাস্টমসের নয়। আর বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কাস্টমস দায় এড়াতে পারে না। একা সিএন্ডএফের পক্ষে এতো বড় জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। কাস্টমসের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে সিএন্ডএফ এজেন্টরা বিল অফ এন্ট্রি দিতে পারলেও বন্দর কর্তৃপক্ষকে সেই অ্যাকসেস দেয়া হয়নি। ফলে আগের মতো ম্যানুয়ালি কাগজপত্র যাচাই করা হয়। তাই অনিয়মের সুযোগ থেকে যায়। 

জানা গেছে, আলোচিত এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গত ১২ জানুয়ারি শাহজাহানপুর থানায় কমলাপুর আইসিডির নিরাপত্তা পরিদর্শক সৈয়দ হোসাইন আহাম্মদ বাদি হয়ে সিএন্ডএফ এজেন্টের মালিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে চুরির মামলা (মামলা নং-০৯, তাং-১২/০১/১৯ইং) করেন। আসামিরা হচ্ছেন জেটি সরকার করোনা অ্যাসোসিয়েটসের সাইদুর রহমান চৌধুরী, করোনা অ্যাসোসিয়েটসের মালিক কাজী সাইফুল ইসলাম ও দুই কর্মচারি ইয়াসিন ও আমিনুল। 

মামলার এজাহারে বলা হয়, সিএন্ডএফ এজেন্ট করোনা অ্যাসোসিয়েটসের ব্যক্তিরা জালিয়াতির মাধ্যমে ভুয়া বিল অফ এন্ট্রি বানিয়ে শিপিং এজেন্টের কাছ থেকে ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে ২৭ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় সাইফ পাওয়ারটেকের পার্কিং এলাকা থেকে ১ হাজার ৩৮ কার্টুন অ্যাসর্টেড গুডস পণ্যবাহী কন্টেইনারের মালামাল শুল্ক ও বন্দরের চার্জ পরিশোধ ছাড়া চুরি করে নিয়ে যায়।
  
বর্তমানে মামলাটি সিআইডিতে তদন্তাধীন আছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এসআই শ্যামল কুমার বিশ্বাস বলেন, আসামি জামিনে আছে। মামলার তদন্ত চলছে। যাচাই-বাচাই শেষে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে। 

তবে কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে পণ্য গোডাউনে নেয়ায়, এটি চোরাচালান হিসেবে গণ্য করা উচিত। সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘটনার পর কাস্টমসের তদন্ত দল আমদানিকারকের গোডাউন অভিযান চালায় এবং এলসি তথ্য অনুযায়ী পণ্য পায়। এরপর গোডাউন সিলগালা করে তদন্ত দল। একইসঙ্গে আমদানি পণ্যের শুল্ক ১১ লাখ ৬৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করে। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সামান্য টাকার শুল্ক ফাঁকি দিতে এতো পরিকল্পিত ভাবে ঘটনা ঘটানো হয়নি। এর পেছনে অন্য ঘটনা থাকতে পারে।   

এ বিষয়ে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান জান্নাত এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মিজানুর রহমান মজুমদার বলেন, সিএন্ডএফ হয়তো কিছু ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে, তাই ঝামেলা হয়েছিল। পরে সিএন্ডএফও টাকা জমা দিয়ে ঝামেলা শেষ করে দিয়েছে বলে জানি। মালামাল আমার কাছে আছে। এদিকে আমদানিকারক মিজানুর রহমান কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান।

এএস