• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১, ২০১৯, ০৪:০৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১, ২০১৯, ১০:১৭ পিএম

মে দিবস

কাজের সন্ধানে শহরমুখী অভাবী মানুষ 

কাজের সন্ধানে শহরমুখী অভাবী মানুষ 
বালি আনা-নেওয়া কাজ করছেন শ্রমিকরা-ছবি : কাশেম হারুন

সুদে ধার-দেনা করে বড় ছেলেকে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিলেন বাবুল হাওলাদার। মালয়েশিয়ায় গিয়ে তেমন কোনো কাজ পায়নি ছেলে। ভিসায় ত্রুটি থাকায় কয়েক মাস জেল খেটে ফিরে আসে। একদিকে পাওনাদারের চাপ অন্যদিকে অভাব। এলাকাতেও তেমন কোনো কাজ নেই। তাই কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে সপ্তাহখানেক আগে ঢাকায় আসেন তিনি। পরিচিত দু’একজনের কাছে কাজের জন্য ধর্ণা দেন। কোনো বাড়ির দারোয়ান বা দোকানের পাহারাদার যে কোনো একটি কাজ হলেই তার হয়। কেউ কেউ আশ্বাসও দিয়েছেন। তার ওপর হাতে কোনো টাকা-কড়ি নেই। তাই গতর খাটিয়ে কিছু রোজগার করে ঢাকায় অন্তত থাকার খরচটা যোগাড়ের আশায় রাজধানীর খিলগাঁও-শাহজাহানপুর রেলগেটে ভাসমান শ্রমিক বাজারে এসেছেন তিনি। গত এক সপ্তাহ থেকে আসছেন। তার দুই দিন আগে ৩০০ টাকা হাজিরায় ছাদ পেটায়ের কাজ করেছেন। সোমবার (২৯ এপ্রিল) কোনো কাজ জুটেনি। সকাল সাড়ে ১০টার পরও অপেক্ষায় আছেন কোনো কাজ মিলে কিনা।

বাবুল হাওলাদারের মতো ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রতিদিন কাজের আশায় জড়ো হন হাজারো মানুষ। তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যাও কম নয়। ঢাকায় কাজের সন্ধানে অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কয়েক বছর ধরে। এখন সেই সংখ্যা আরও বেড়েছে। কাজের খোঁজে হতদরিদ্র এসব মানুষ লঞ্চ, বাস, ট্রেন বোঝাই হয়ে ভিড় করছেন ঢাকায় কাজের আশায়। 

রাজধানীর কয়েকটি ভাসমান শ্রমের বাজারে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুগ যুগ ধরে ভাসমান শ্রমিকদের এই বাজার চলতে থাকলেও এত ভিড় আর কোনো সময় ছিল না। ভিড়ের পাশাপাশি কাজেরও চলছে আকাল।

একাধিক শ্রমিক জানান, এখন অল্প সময়ে কাজ শেষ করার জন্য মেশিনে ইট ভাঙা, সিমেন্ট-বালু-খোয়া মিশ্রণ, রড কাটা ইত্যাদি মেশিনে করা হয়। এতে শ্রমিক সংখ্যায় কম লাগে। 

ঢাকা নগরীতে অন্তত শতাধিক পয়েন্টে বসে ভাসমান শ্রমবাজার বা শ্রম হাট। এ পয়েন্টে প্রতিদিন গতর খাটিয়ে কাজের আশায় ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের কর্মসংস্থান করে এই শ্রম হাটগুলো। হাটে আসার আগেও তারা জানেন না দিনের কাজ মিলবে কিনা। জানেন না তাকে কোথায় কি ধরনের কাজ করতে হবে। ইট ভাঙা, নির্মাণ কাজ, রং মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, যোগালি, কাঠ মিস্ত্রী, বস্তা টানা, মাটি কাটা, ড্রেন পরিষ্কার থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই, যা তারা করছেন না। 

শ্রমবাজারগুলো কর্মসংস্থান করে চলছে অসংখ্য মানুষের। দারিদ্র্য যাদের নিত্যসঙ্গী তারাই মূলত রোজ হিসেবে শ্রম বিক্রির উদ্দেশে এখানে আসেন এসব বাজারে। শ্রমবাজারকে আবার কেউ কেউ বলেন ‘মানুষ বেচা-কেনার হাট’।

মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও-শাহজাহানপুর রেলগেট,  মহাখালী বাসস্ট্যান্ড মোড়, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির সামনে, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর গোলচক্কর, উত্তরা আজমপুর বাসস্ট্যান্ড, খিলক্ষেত, নতুন বাজার, বাড্ডাসহ নানা এলাকায় বসে এসব হাট। প্রতিটি হাটে আসেন কয়েকশ’ করে দিনমজুর। 

সরজমিনে কয়েকটি শ্রমবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কোদাল, টুকরি, হাতুড়ি, বাটাল, করাত ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকেন। পথচারীরা তাদের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ঘিরে ধরেন কাজ পাওয়ার আশায়। অবশেষে ঘণ্টা বা দিন হিসেবে কাজে চলে যান। আর যারা কাজ পান না তারা ভাবেন কিভাবে কাটবে বেকার একটি দিন। এভাবেই দিন চলে যায়। 

শাহজাহানপুর রেলগেট। ফলের দোকানগুলোর সামনের ফুটপাতে ভিড় জমিয়েছেন বেশকিছু লোক। তখন ভোর সাড়ে ৬টা। ধীরে ধীরে ভিড় বাড়ছে সেখানে। তাদের কারো হাতে কোদাল-টুকরি, খুন্তি, কারো হাতে হাতুড়ি-বাটাল, করাত, কনি ইত্যাদি সরঞ্জাম। কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে। কি যেন খুঁজছেন সবাই। পাশ দিয়ে যেতেই ঘিরে ধরল কয়েকজন ‘ভাই কামলা লাগব? কয়জন লাগব? কি কাম ইত্যাদি প্রশ্ন। কোনো কামলা (কাজের লোক বা দিনমজুর) লাগবে না বলতেই সবাই চলে গেলেন। অন্যদিকে দু’জন লোক এসেছে তাদের ঘিরে ভিড় জমিয়েছেন। সবাই অন্যদিকে চলে যাওয়ার পরও একজন তখনও দাঁড়িয়ে আছেন। মাথার চুল সব সাদা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। পরনে ময়লা-শীর্ণ কাপড়। তার কাছে জানতে চাইলাম কি কাজ করেন? তার উত্তরটা ছিল এই রকম, ‘চুরি আর ময়লার কাম ছাড়া সবি করি।’ ষার্টোর্ধ্ব বয়সী দিনমজুর জয়নাল মোল্লা কিশোরগঞ্জের কৈলাগ ইউনিয়নের। গত চার বছর ধরে এখানে নিয়মিত আসছেন। আগে বাড্ডার একটি বেসরকারি অফিসে পিয়নের কাজ করতেন। বেতন-ভাতা পেতেন মাসে ৮ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে ভালোই যাচ্ছিল দিন। তিন মেয়েকে লেখাপড়া করাচ্ছিলেন। কিন্ত বয়স হওয়ার কারণে তার চাকরি চলে যায়। দেন-দরবার ও অনেক ঘুরাঘুরি করেছেন নতুন একটি চাকরির জন্য, কিন্তু পাননি।

তিনি বলেন ‘ঝড়-বৃষ্টি যাই থাকুক না কেন তাকে এখানে আসতেই হয়। প্রতিদিন কাজ পান না। গত দুই সপ্তাহে দিনে কাজ করেছেন মাত্র ৬ দিন। বাড়িতে জমি-জমা না থাকায় কৃষিকাজও করতে পারেন না। জয়নাল মোল্লার মতো সেখানে এসেছিলেন পাবনার সুরুজ আলী, যশোরের কলিম শেখ, জামালপুরের হাসু মিয়া, শ্রীপুরের মিরাজ, মাদারীপুরের মোহাম্মদ মনির, গাইবান্ধার ফারুক, মুন্সীগঞ্জের কামাল, মেহের আলী, সালামসহ অনেকে। 

ঢাকার শ্রমবাজারগুলোতে দেখা গেছে, পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি রয়েছে ব্যাপক নারী শ্রমিক। মোট শ্রমিকের ৪০ শতাংশের বেশি হচ্ছেন নারী। পুরুষদের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও মাটিকাটা, রাজমিস্ত্রীর যোগালির কাজ, ছাদ ঢালাই, ইট ভাঙা, রংয়ের  কাজে সহযোগিতা করা ইত্যাদি কাজ করছেন মহিলারা।

একাধিক দিনমজুরে জানান, তাদের অনেকেই এই কাজের পাশাপাশি নাইট গার্ডের কাজ করেন বিভিন্ন বাসায় বা অফিসে। কেউ আবার কাজ না পেলে রিকশা বা ভ্যান গাড়ি চালান। এসব শ্রমিকের অনেকেই দালালদের হাতে প্রতারিত হন। এক শ্রেণীর দালাল তাদের দিয়ে কাজ করিয়ে মজুরি কম দেন। অনেক সময় তাদের মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করেন।

ছবি কাশেম হারুন

এসএমএম