• ঢাকা
  • শনিবার, ০৪ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯, ০৯:২৫ এএম

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও অবহেলায় মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো 

স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও অবহেলায় মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো 
অবহেলায় মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমি


স্বাধীনতার ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সংরক্ষণের অভাবে অযত্নে অবহেলায় পড়ে আছে মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমিগুলো। এমনকি অনেক বধ্যভূমি শনাক্ত করাও সম্ভব হয়নি। জেলার কেন্দ্রীয় বধ্যভূমিসহ মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পাসের দক্ষিণে অবস্থিত বধ্যভূমিটি জেলার কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি। এছাড়া সদর উপজেলার পাঁচঘড়িয়াকান্দি, সাতানিখীল, কেওয়ার, টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর, গজারিয়া উপজেলার নয়ানগর, গোসাইরচর, বালুরচর, নাগেরচর, কাজিপুরা, প্রধানেরচর, বাশঁগাও, সোনাইরকান্দি, দক্ষিণ ফুলদি গ্রামসহ অনেক জায়গাতেই হানাদার বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু এ বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি আজও।

নামাঙ্কিত হয়নি এমন বধ্যভূমি:-
২০০৬ সালে সরকারি হরগঙ্গা কলেজের দেয়া ২০ শতাংশ জায়গার উপর ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় জেলার কেন্দ্রীয় বধ্যভূমি যেখানে ৩৬ জনের লাশ পাওয়া যায়, যখন পরাজিত পাকিস্তানিবাহিনী মুন্সীগঞ্জ ত্যাগ করে। ১৯৭১ সালের ৯ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহরে প্রবেশ করে হরগঙ্গা কলেজে ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযোদ্ধা বা স্বাধীনতাকামী মানুষদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন চালাতো। নির্যাতন শেষে তাদের গুলি করে হত্যা করার পর কলেজ ক্যাম্পাসের দক্ষিণ পূর্ব একটি গর্তের মধ্যে লাশগুলো ফেলা হতো।

প্রত্যক্ষদর্শী সরকারি হরগঙ্গা কলেজের প্রবীণ শিক্ষকরা বলেন, ‘একাত্তরে পাকিস্থানি সৈন্যরা যখন ক্যাম্প স্থাপন করতে এই কলেজে আসে তখন আমি এই কলেজের ছাত্রাবাসে থাকতাম। তখন এসব দৃশ্য দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। নিরুপায় ছিলাম।
প্রতিবছর এখানে প্রশাসনের লোক দেখানোর নামে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করা হলেও বছরের বাকি সময়টা পড়ে থাকে অবহেলায়। দুই পাশে সীমানা দেয়াল নেই, প্রধান ফটকও সবসময় খোলা থাকে। রাতের অন্ধকারে এখানে চলে মাদক সেবন। শ্রদ্ধার কোনো লেশ নেই।

সাতানিখীল ও পাঁচঘড়িয়াকান্দি বধ্যভূমি:-
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার পাঁচঘড়িয়াকান্দি ও কেওয়ার সাতানিখীল গ্রামের বধ্যভূমি দুটি এখনও শনাক্ত করা হয়নি। এখানে এখন আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন না থাকায় শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে এখন পর্যন্ত সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। 

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার কেওয়ার চৌধুরী বাড়ি পাকিস্তানি সেনারা ১৯৭১ সালের ১৩ মে দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় ঘেরাও করে। ওই বাড়ি থেকে ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা ও তার দুই ছেলে শিক্ষক সুনিল কুমার সাহা, দ্বিজেন্দ্র লাল সাহা এবং অধ্যাপক সুরেশ ভট্টাচার্য, শিক্ষক দেব প্রসাদ ভট্টাচার্য, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর শচীন্দ্র নাথ মুখার্জীসহ ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে আসে এবং ১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখীল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে চোখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়।

আর ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহাকে ধরে নিয়ে যায় শহরের হরগঙ্গা কলেজের পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে। সেখানে নির্যাতনের পর কলেজের পিছনে পাঁচঘড়িয়াকান্দি গ্রামের একটি আম বাগানে গাছে ঝুলিয়ে ব্রাশফায়ার করে তাকে হত্যা করে পাকিস্তানি-নরপশুরা। এরপর ওখানে আরো জানা-অজানা বুদ্ধিজীবীকে এনে হত্যা করে বলে জানা গেছে।



                                 অবহেলায় মুন্সীগঞ্জের বধ্যভূমি

নামাঙ্কিত হয়নি বধ্যভূমি:-
শহীদ ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহার ছোট ছেলে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সাহা বলেন,‘মনে বড় কষ্ট। স্বাধীনতার ৪৮ বছরে একটি ইটও গাঁথা হয়নি ওই বধ্যভূমিগুলোতে। এটা আমাদের জেলাবাসীর চরম ব্যর্থতা।’

জেলা সদরের পাঁচঘড়িয়াকান্দির একটি আম বাগানে প্রায় ২৫-৩০ জনকে হানাদার বাহিনী মেরে ফেলে রাখে। সাতানিখীলেও তারা হত্যাযজ্ঞ চালায়। ১৯৭১ সালের সেই সব শহীদদের নামাঙ্কিত একটি স্মৃতিফলক অন্তত থাকা উচিত এবং বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা উচিত।’

আব্দুল্লাপুরের পালবাড়ি বধ্যভূমি:-
আব্দুল্লাপুরের পালবাড়ি বধ্যভূমিটিও সংরক্ষিত নয়। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের রক্তাক্ত চিহ্ন বহন করছে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাপুরের বাড়িটি। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাপুরের পালবাড়ি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ চালিয়ে ওই বাড়ির মালিক ও আশ্রিতসহ ১৯ জনকে হত্যা করে।

বর্তমানে শহীদ অমূল্যধন পালদের নাতিসহ তার আত্মীয় স্বজনরা ওই বাড়িতে বসবাস করছেন। দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর পর আব্দুল্লাপুর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান শহীদ মোল্লা একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণ করেন পালবাড়ির পুকুর পারে। ১৯৯৮ সালে এই স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মুক্তিযোদ্ধা মো. লুৎফর রহমান। এর পর থেকে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে ওই এলাকার স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, স্থানীয় নেতাকর্মী ও জনগণ এই স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন শহীদদের স্মরণে। 

গজারিয়া বধ্যভূমি:-
১৯৭১ সালের ৯ মে ভোরে পাকিস্তানি সেনারা মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় আক্রমণ চালিয়ে নৃশংসভাবে ৩৬০ জন নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। গজারিয়া, নয়ানগর, গোসাইরচর, বালুর চর, নাগেরচর, কাজিপুরা, প্রধানেরচর, বাশঁগাও, সোনাইরকান্দি, দক্ষিণ ফুলদিগ্রামের লোকজনকে পাকিস্তানিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করে। উপজেলার মোট ১০টি বধ্যভূমি অরক্ষিত ও অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। কেবলমাত্র একটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাকি বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও। কালের আবর্তে এসব বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে নিহত ৩৬০ জনের মধ্যে ১০৩ জনের নাম পরিচয় পাওয়া গেলেও স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ২৫৭ জনের নাম পরিচয় পাওয়ার কোনো উদ্যোগ নেয়নি বর্তমান ও বিগত কোনো সরকার।

গজারিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান বলেন, ‘গোসাইরচর বধ্যভূমি সংরক্ষিত আছে। শহীদ নজরুলের কবরও সংরক্ষণ করা হয়েছে। তবে ঐরকমভাবে কেউ কাজ করে নাই। তাই সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় নাই।’

সংস্কারের অভাবে বিধ্বস্ত শহীদদের নামফলক:-
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান বলেন,  ‘আগে কে কী করেছে সেটা জানিনা। তবে আমি আজ থেকে শহীদ পরিবারদের স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালাবো।’

তবে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিসুজ্জামান আনিস বলেন, ‘মোটামুটি সবগুলো বধ্যভূমি চিহ্নিত করা আছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তেমন কোনো আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি যেন বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বিএস