• ঢাকা
  • বুধবার, ০৮ মে, ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০১৮, ০৭:১৯ এএম

প্রাচীন ভারতের স্বত্ত্বা-সন্ধানী এক মুক্তবুদ্ধির বাঙালি

প্রাচীন ভারতের স্বত্ত্বা-সন্ধানী এক মুক্তবুদ্ধির বাঙালি
ভাষাতাত্ত্বিক ও গবেষক মাসুম খান (প্রকাশিত গ্রন্থ `বৈদিক ভারত`)

আধুনিক বিশ্বের যে চিত্র আজ আমাদের সামনে প্রত্যক্ষ হয় তার গোড়াপত্তন হয়েছিলো সুপ্রাচীন কালের সেই অমিত লগ্নে যখন থেকে মানব সভ্যতার সূচনা হয়। সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনের মধ্য দিয়ে মানুষ যখন তার বর্তমানে উপস্থিত ঠিক সে সময় সভ্য পৃথিবীর কিছু মানুষ তার সভ্য-বিশ্বায়নের পূর্বশ্বরীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের লক্ষে অতীত ইতিহাসের পাতায় মনোনিবেশ করে, খুঁজি নিতে চেষ্টা করে শেকড়। এই অনুসন্ধান ক্রমেই গভীরতর হয় এবং এক পর্যায় প্রাচীনকালের সেই রহস্যময় অজানার পৃথিবীতে শুরু হয় আজকের মানুষের দুঃসাহসী অভিযান। আধুনিক বিশ্বের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আর জ্ঞান চর্চা মানুষর সুপ্রাচীন স্বত্ত্বার অনুসন্ধানে পাথেয় হয়েছে, অনুপ্রানিত করেছে খুঁজে পেতে সেই জাতিগত স্বত্ত্বার প্রতিনিধিত্বকে যার হাত ধরে বন্য আদিমতার অন্ধকার চিরে মানুষ অর্জন করছে বর্তমান বিশ্বের এই আলোকিত সভ্যতা । জীবস্বত্ত্বার পর্যায় থেকে উঠে এসেছে স্বমহিমায়, দ্ব্যর্থ কন্ঠে জানান দিয়েছে - 
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।‘


ইতিহাস বিদ্যার মত জ্ঞানের সম্ভ্রান্ত শাখা নিয়ে কথা বলার ধৃষ্টতা বোধ করি আমার মত মানুষের না করাই শ্রেয়। কিন্তু কখনো কখনো মানুষ বাধ্য হয় এমন ধৃষ্টতার সীমা অতিক্রম করতে। ইতিহাস ও তার দর্শনতত্ত্ব পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণ বোধ করি পৃথিবীর এমন কিছু মানুষের সাধ্যের সীমায় স্রষ্টা আবদ্ধ করেছেন যাদের প্রজ্ঞা ও অনুধাবন শক্তির প্রখরতা অতীতের যে কোনো কালচিত্রকে মনের পটে প্রত্যক্ষ উপস্থাপনে সক্ষম। ঠিক এমনই একজন অখ্যাত বাঙালির প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণের স্বকীয় দর্শন আমাকে এ ধৃষ্টতার সীমালঙ্ঘনে বাধ্য করলো।  


বিদ্যালয় জীবনে যা খানিক গণিত, ইতিহাস বা বিজ্ঞানের মত জটিল জ্ঞানের চর্চা আমার দ্বারা হয়েছে তাও নিতান্ত শিক্ষাগুরুর উদ্বত্ত প্রহার-দন্ডের প্রতিরোধক হিসেবে। ‘ইতিহাস অমর, তাঁর মাঝে সঞ্চিত সকলই স্রষ্টাসম বিশ্বাসযোগ্য। আর ইতিহাসের দর্শন, তত্ত্ব ও বিশ্লেষণের প্রতিটি পুস্তকই তো ইতিহাসের বেদ! সেই বেদের রচয়িতাগন বৈদিক জ্ঞানপতি, তাঁদের বেদতত্ত্ব ভুল প্রমাণের প্রচেষ্টা গুরুপাপ!’ এই দর্শনধারী গতানুগতিক মানুষের মাঝে আমিও একজন। কিন্তু আমার সুদীর্ঘকালের সেই লালিত বিশ্বাসের ঘরে হানা দিলেন এই অখ্যাত বাঙালি, মাসুম খান। তাঁর নব্য প্রকাশিত ‘বৈদিক ভারত’ নামের একখানা একালের চটি বইয়ে প্রখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুলার সাহেবের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস দর্শনে ‘আর্য তত্ত্বে’র ধারনাকে অমূলক আখ্যা দেয়া হয় এবং এতকাল যে ম্যাক্স মুলার দর্শন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস বিশ্লেষণের আদর্শ বলে বিবেচিত ছিল সেটিকেই ভারতের ইতিহাস চর্চার প্রধান অন্তরায় বলে দাবি করা হয়। আমি  কোন ইতিহাসবিদ নই কিন্তু একজন উপমহাদেশীয় হিসেবে এর ইতিহাসের যে স্বকীয় দর্শনের কথা অবগত হলাম তা রীতিমত আমাকে গর্বিত করলো। এই অনুভূতির প্রাপ্তি সত্যিই অসাধারণ যে, একজন অখ্যাত বাঙালি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের ঘাড় থেকে আর্যামির ভুত ছাড়ানোর মন্ত্র সফল ভাবেই ঝাড়তে শুরু করেছেন। সে দিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই যেদিন এমন মাসুম খানদের দ্বারা প্রমাণিত হবে যে পরের অনুগ্রহে নয় বরং স্বকীয়তার সম্ভারেই উদ্ভাসিত আমাদের উপমহাদেশীয় জাতিস্বত্ত্বা। 


প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মানুষ যেমন নিজের স্বকীয়তা ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধানের চেষ্টা চালিয়েছে পাশাপাশি আধুনিক বিশ্বের বুকে নিজেদের কর্তৃত্ব ও আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে সেই পরিচয়ের প্রভাব সৃষ্টির চেষ্টাও করেছে। অনেক ক্ষেত্রে এই চেষ্টা বিতর্কের প্রেক্ষাপটে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সুবিশাল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন ইতিহাস অনুসন্ধান ও তারা দর্শন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই বিতর্কের বিষয়টি বেস গভীর ভাবে চোখে পরে। কালে কালে নিজেদের স্বত্বার সত্যতা খুঁজে নিতে উপমহাদেশীয় ইতিহাসবিদ এবং গবেষকগণ নিরলস প্রচেষ্টায় ব্রত থেকেছেন। কিন্তু কোথায় যেন একটি অদৃশ্য বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়া এই উপমহাদেশের ইতিহাস দর্শন বারংবার সেই অন্ধকুঠিরের প্রাচীরে মাথাঠুকে মরেছে। প্রাচীন সভ্যতার অনেক গুরুত্বপুর্ণ তথ্য ও উপাত্তের নির্ণায়ক নিশ্চিত করতেই আবশ্যক হয়ে পড়ে এই উপমহাদেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রকৃতির উপস্থাপন। কারণ, উপমহাদেশের মানুষের জীবন ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের যে মেলবন্ধন, পারস্পরিক এতো সামঞ্জস্যপূর্ণ জতিস্বত্ত্বার অধিকারী সুবৃহৎ জনগোষ্ঠী বিশ্বের বুকে আর দ্বিতীয়টি নেই।


ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে যেমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিচিত্র সম্ভার পরিলক্ষিত হয় তেমনি আবার সেই বৈচিত্র্যের প্রতিটি ধারাকে মিলেমিশে ‘উপমহাদেশীয় জাতস্বত্ত্বা’র একক ধারায় সাবলীল ভাবেই প্রবাহিত হতে দেখা যায়। জনাব খান তাঁর গ্রন্থে সাবলীল উপস্থাপনের মাধ্যমে খুব সহজেই এই সত্য দর্শনে পাঠকের সহায়ক হয়েছেন। নিজেস্বতা কে না চায়, কে না চায় যা তার তাকে নিজের বলেই সানন্দে গ্রহণ করতে। মাসুম খান এ বিষয়টি পরিষ্কার ভাবে দেখিয়েছেন যে ম্যাক্স মুলারের ভারতীয় ইতিহাস দর্শন অভিজাত ও ঐতিহ্যের ধারক এই উপমহাদেশীয় ইতিহাসকে একেবারে আমাদের অস্তিত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, পরিণত করেছে পরের অনুগ্রহের বর দানে। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তাঁর গ্রন্থে সংযুক্ত করেছেন তা হলো প্রাচীন ভারতের ইতিহাস চর্চার সূচনা লগ্ন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ উদ্যেগে শুরু হয় উপমহাদেশের ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রক্রিয়া। জনাব খান বিচক্ষণতার সাথে যে বার্তা আমাদের দ্বারে পুছে দিলেন সেটি হলো, ব্রিটিশ শাসকের অধীনে পরিচালিত ভারতের ইতিহাসের অনুসন্ধান মূলত এ অঞ্চলের স্বকীয় স্বত্বা খুঁজে নেয়ার প্রয়াসে হয়নি। বরং উপমহাদেশের মানুষের জীবন প্রণালী, আচার-আচরণ, বৈশিষ্ট্য, সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতি সহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রের তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের মত একটি জাতিস্বত্ত্বার কৃত্রিম পরিচিতির আড়ালে এ জাতিকে লুটে নেয়ার প্রয়াসে। তারই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্যকে ‘বহিরাগত’দের অনুদান স্বরূপ মুলার সাহেব তাঁর ‘আর্যনীতি’-তত্ত্বের অন্ধ কুঠিরে ঠেলে দেন। সেক্ষেত্র বিবেচনায় রেখে জনাব মাসুম খান প্রথমেই প্রতিটি উপমহাদেশীয় স্বত্ত্বার প্রতি একটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্তৃত প্রাচীন মানব সভ্যতার সূতিকাগার এই ভারতবর্ষের বুকে সভ্যতার উত্থান কি করে জনাকয়েক বহিরাগতের দ্বারা সম্ভব ?’ সেই সাথে তিনি তার অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের উপস্থাপন ও প্রাসঙ্গিক যুক্তিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুলার সাহেবের সেই বহিরগত ‘আর্য’দের কর্য সুদে-আসলে মিটিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষকে তাঁর ভিটার মালিকানা বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদি শাসকের দল যে এ মাটিতে বহিরাগত বলেই উপমহাদেশের উৎকর্ষের ইতিহাসের দাতা গোষ্ঠীকে বহিরাগত আখ্যা দিয়ে একটি প্রহসনমূলক ইতিহাস তত্ত্বের প্রতিস্থিত রূপ বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে তাও জনাব খান বেস দূরদর্শিতার সাথেই দেখিয়ে দিয়েছেন।


বহু ইতিহাসবিদ ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের প্রকৃত রূপরেখা নিরূপণের চেষ্টা করেছেন যার আরো একটি নিবেদিত প্রয়াশের সাফল্য দেখা গেল খান সাহেবের কাজে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আধুনিকতার যুগে যখন এ অঞ্চলের তারুণ্য যান্ত্রিক সভ্যতার পেছনে ধাবমান ঠিক সেই প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি হিসেবে মাসুম খান তাঁর এই অনবদ্য গ্রন্থটির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও ০সভ্যতার উৎকর্ষে আমাদের স্বকীয়তা এবং নিজেস্ব জাতিস্বত্ত্বার এক যুগান্তকারী ও আধুনিক ইতিহাস দর্শনের দ্বার উন্মোচন করলেন। সাম্রজ্যবাদের অনুগত ভৃত্যেরদল হয়তো তাঁর এই অনবদ্য গবেষণা কাজটিকে যথাযথ মূল্যায়নে ব্যর্থ হবে কিন্তু আমি আস্থার সাথে আজকের এই অখ্যাত বাঙালির বিখ্যাত হবার গল্পটি লেখার অপেক্ষায় থাকলাম। 


সবিশেষ জনাব মাসুম খান, আপনাকে একটি বিশেষ কারণে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। আপনি আমার হৃদয়ে পুষে রাখা একটি দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটালেন । ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানে আপনার গ্রন্থটি এক নতুন মাইলফলক স্থাপন করলো। আপনার মত এমন অনার্য বাঙালি সন্তানের নামে গর্বিত মাতৃভূমি।

 


লেখকঃ সাংবাদিক