ষড়যন্ত্রের জালে বিপন্ন রাজনীতি-৩০

মেজর মঞ্জুর ও জিয়া হত্যার পূর্বাপর— দুই

জাগরণ ডেস্ক প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২০, ০৪:০৮ পিএম মেজর মঞ্জুর ও জিয়া হত্যার পূর্বাপর— দুই

মেজর জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে জেনারেল জিয়া বিরোধী যে দলটি গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যেই  একটি কট্টর উগ্রপন্থী গোষ্ঠী ছিল।। তারা ছিল জিয়ার বিরুদ্ধে চরম ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী। লে. কর্নেল মতিউর কি ছিল ওই গোষ্ঠীরই লোক? মঞ্জুরকে সামনে রেখে তারা কি খুঁজছিল নিজেদের মতলব  হাসিলের সুযোগ? সে সুযোগ কাছে আসতেই তারা তা হাতছাড়া করেনি?

কোনওদিন যদি জিয়া হত্যার নিরপেক্ষ তদন্ত হয় তাহলেই হয়তো এসব প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে এখন অনেক অসুবিধা আছে। কেন-না এসব প্রশ্নের জবাব যিনি দিতে পারতেন সেই মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে হত্যা করা হয়েছে। আর এই ঘটনার যিনি সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী সেই জেনারেল এরশাদ সম্প্রতি মারা গেছেন। এ বিষয়ে সরকারি ভাষ্যে তখন বলা হয়, গ্রেফতারের পর মঞ্জুরকে তখন চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। তখন একদল “উত্তেজিত” সৈন্য তাকে গুলি করে হত্যা করে। এই “উত্তেজিত” সৈন্য কারা? তারা কি উত্তেজনার বশে মঞ্জুরকে খুন করেছে? নাকি চট্টগ্রাম বিদ্রোহের প্রমাণ  চিরতরে ধামাচাপা দেয়ার জন্য তারা পরিকল্পনা মাফিকই তাকে হত্যা করেছে? চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে আবুল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড ‘জিয়া হত্যা’ ষড়যন্ত্রের প্রকৃত ইতিহাসকে পর্দার আড়ালে ঠেলে দিয়েছে। সেই পর্দা সরিয়ে প্রকৃত ইতিহাসকে উদ্ধার করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। হয়তো সে আড়াল করা ইতিহাস কোনওদিনই আর আলোর মুখ দেখবে না। তবে আমরা পর্যায়ক্রমে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

‘নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষে ১০ জন সশস্ত্র গার্ড থাকে। মাহফুজ তাদের সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় সরকারি প্রটোকল অফিসারের কাছ থেকে সার্কিট হাউসের কক্ষ বন্টনের তালিকা সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে দেন। এই তালিকা দিনের বেলায় যখন ফিল্ট ইন্টেলিজেন্সের ওসি মেজর মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখনই তার মাধ্যমে মতিউরের দলের কাছে পাঠিয়ে দেন। জেনারেল মঞ্জুরের কড়া নির্দেশ ছিল এই পরিকল্পনায় যেন কোনও সৈন্যকে কাজে লাগানো না হয়।’

........‘’........

এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সরকারি ভাষ্য এবং ওই সময়ের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়,  ২৯ মে, শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে জেনারেল মঞ্জুরের অনুগতরা চূড়ান্ত অভিযানের পরিকল্পনা তৈরির জন্য লে. কর্নেল দিলওয়ার হোসেনের বাসভবনে সমবেত হন। এ বৈঠকে অংশ নেন লে. কর্নেল মাহবুব, লে. কর্নেল ফজলে হোসেন, মেজর খালিদ এবং মেজর মোহাম্মদ লতিফুল আলম চৌধুরী এবং পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর রওশন ইয়াজদানী ভূঁইয়া। লে. কর্নেল মতিউর সন্ধ্যার আগেই রাঙামাটি থেকে ফিরে আসেন এবং তিনি এ বৈঠকে যোগ দেন।  

বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে দায়িত্ব নির্ধারিত করে দেয়া হয়। মেজর মারুফ রশিদকে দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকার সঙ্গে সব রকম টেলিযোগাযোগ লাইন কেটে দেয়ার। সার্কিট হাউসের ভেতর থেকে সহযোগিতা পাওয়ার ব্যবস্থা আগেই বেশ পাকাপোক্তভাবে করা হয়েছিল।এ কাজটি করেছিলেন লে. কর্নেল মতিউর। তিনি এদিন কোনও এক সময় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসার লে. কর্নেল মাহফুজের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেন আজ রাতেই তারা আঘাত হানতে যাচ্ছেন। মাহফুজ তাকে সম্ভাব্য সব প্রকার সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের শয়নকক্ষে ১০ জন সশস্ত্র গার্ড থাকে। মাহফুজ তাদের সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় সরকারি প্রটোকল অফিসারের কাছ থেকে সার্কিট হাউসের কক্ষ বন্টনের তালিকা সংগ্রহ করে নিজের কাছে রেখে দেন। এই তালিকা দিনের বেলায় যখন ফিল্ট ইন্টেলিজেন্সের ওসি মেজর মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখনই তার মাধ্যমে মতিউরের দলের কাছে পাঠিয়ে দেন। জেনারেল মঞ্জুরের কড়া নির্দেশ ছিল এই পরিকল্পনায় যেন কোনও সৈন্যকে কাজে লাগানো না হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মেজর খালিদকে ভার দেয়া হয় কিছু সৈন্য জোগাড় করার। মেজর খালিদ ছিলেন ব্রিগেড মেজর। তবুও তার পক্ষে ওইসময় সৈন্য জোগাড় করা অসুবিধাজনক হয়ে পরলো। রাত ৯টার দিকে তিনি প্রথম ইস্টবেঙ্গলের এনসিও সুবেদার আবুল হালিমকে নির্দেশ দেন অস্ত্র-শস্ত্রসহ কিছু সংখ্যক সৈন্যকে নিয়ে কালুরঘাটে উপস্থিত হওয়ার জন্য। তিনি এক বান্ডিল টাকা হালিমকে দেন ট্রাক ভাড়া করার জন্য। এতে সুবেদার হালিমের মনে সন্দেহের জন্ম দেয়। তিনি টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে খালিদকে জিজ্ঞেস করেন, “সৈন্যদের আমি কি বলবো?”  খালিদ বলেন, “তোমার যা ইচ্ছে বলো... তাদের বলো যে, প্যারেডের সময় সিনেমা দেখার শাস্তি হিসেবে তাদের কালুরঘাট পাঠানো হচ্ছে।”  সুবেদার হালিমের সন্দেহ তখন আরও ঘনীভূত হলো। তিনি ইতস্তত করতে লাগলেন। খালিদ তখন তার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকালেন। আধঘণ্টা পর মেজর খালিদ ৬৯ পদাতিক ব্রিগেডের মেজর মোহাম্মদ মোস্তফাকে অনুরোধ করলেন কিছু সৈন্য দেয়ার জন্য। মোস্তফা তার ব্রিগেড কমান্ডারের বাসায় গিয়ে জানালেন মেজর খালিদ প্রেসিডেন্টকে সার্কিট হাউস থেকে তুলে আনার জন্য কিছু সৈন্য চাইছে। ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন আহমেদ বললেন, “খালিদ কি পাগল হয়েছে? অবিলম্বে তুমি তাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলো।”  তিনি সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ দিলেন যে ব্যারাক থেকে একজন সৈন্যও যেন বাইরে না বেরোয়। ব্রিগেডিয়ার মহসিন তখন জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু লাইন পেলেন না। তবে তিনি তখন ব্যাপারটি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বাহিনী বা গোয়েন্দা বাহিনীকে জানালেন না। ততক্ষণে খালিদ বুঝতে পারলেন যে সৈন্য জোগাড় করা তাদের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। সবকিছু অফিসারদেরই করতে হবে। রাত দশটার দিকে লে. কর্নেল মাহবুব দুই জন অফিসারকে সার্কিট হাউসে পাঠালেন সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য। ১৫ বেঙ্গল এর সেকেন্ড ইনচার্জ মেজর শওকত আলী এবং মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম ক্লাবের দেয়ালের পাশে অবস্থান নিলেন সার্কিট হাউসের ওপর নজর রাখার জন্য। ঘটনা শেষ হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানেই ছিলেন।  

‘৩০ মে, রাত প্রায় আড়াইটা। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার আগে তারা সবাই কালুরঘাট এসে সমবেত হলেন। এই কালুরঘাটেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। ঠিক এখানেই অবস্থিত ছোট্ট রেডিও স্টেশন থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে রাতারাতি পরিচিত হয়ে উঠেন’

........‘’........

ক্যান্টনমেন্টে মধ্যরাত থেকেই দ্রুত অভিযান বাস্তবায়নের কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গেল। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ১১ এবং ২৯ ইস্টবেঙ্গলের সব অফিসারকে বৈঠক ডেকে পাঠালেন লে. কর্নেল মতিউর রহমান ও লে. কর্নেল মাহবুব। ২৮ ইস্টবেঙ্গলের সেকেন্ড ইনচার্জের অফিসে এই বৈঠকের আয়োজন করা হলো। এতে ৬ জন অফিসার উপস্থিত হন। তারা হলেন— মেজর মমিন, মেজর গিয়াস উদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনির, ক্যাপ্টেন জামিল, ক্যাপ্টেন মঈনুল ইসলাম এবং ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ। মতিউর দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং একখানা কোরআন শরীফ বের করলেন। তিনি সমবেত সবার উদ্দেশে বললেন, “ উপস্থিত সুধীবৃন্দ, আমার হাতে রয়েছে পবিত্র কোরআন শরীফ। আমরা আজ যা করতে যাচ্ছি তা শুধু এই দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এর সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ জড়িত নেই। যারা আমাদের সঙ্গে থাকতে চান তারা এই পবিত্র কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিন এবং প্রতিজ্ঞা করুন। আর যারা এ কাজে রাজি নন তারা রুম ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তবে তাদের কাছে একটাই অনুরোধ দয়া করে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবেন না।”  কথাগুলো পর একটু থামলেন মতিউর। আবেগে গলাটা যেন একটু জড়িয়ে গেলো।

মতিউরের এ বক্তব্যের পর কেউ কোনও কথা বললেন না। তারা সবাই মতিউরের দিকে এগিয়ে এলেন। সবাই কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন। তারপর তারা প্রত্যেকেই তাদের ইউনিফর্ম পরলেন এবং সঙ্গে নিলেন গুলিভর্তি সাব-মেশিনগান ও গুলির বেল্ট। অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে ৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দফতরে লে. কর্নেল ফজলে হোসেনের নেতৃত্বে কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিলেন মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন আরিফিন, লেফটেনেন্ট মো. রফিকুল ইসলাম এবং লেফটেন্যান্ট মোসলেহ উদ্দিন। এখন তারা সবাই প্রস্তুত মতিউরের নির্দেশের জন্য। হ্যাঁ, লে. কর্নেল মতিউরই এই অভিযানের নেতা।

৩০ মে, রাত প্রায় আড়াইটা। তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে এবং ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার আগে তারা সবাই কালুরঘাট এসে সমবেত হলেন। এই কালুরঘাটেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। ঠিক এখানেই অবস্থিত ছোট্ট রেডিও স্টেশন থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করে রাতারাতি পরিচিত হয়ে উঠেন।

তিনজন সঙ্গীসহ লে. কর্নেল মাহবুব এসেছেন তার সাদা টয়োটা গাড়িতে। এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানে হাজির হলেন ১৮ জন অফিসার এবং দুইজন জেসিও। সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ফজলুল হক তার রেজিমেন্টের দুই প্লাটুন (৪০ জন) সৈন্যসহ উপস্থিত হলেন। যখন মেজর খালিদ তাদের উদ্দেশের কথা জানালেন, তখন সৈন্যরা এতে যোগ দিতে রাজি হলো না। কাজেই তাদের লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ছেড়ে দেয়া হলো এবং সবাইকে কালুরঘাট ব্রিজের অপর প্রান্তে বান্দরবানে রেখে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। সশস্ত্র ব্যক্তিদের ক্যান্টনমেন্টের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটি কারও চোখে পড়লো না। কারণ এ সময়ে নৈশকালীন প্রশিক্ষণ চলছিল। তাছাড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থাও এ সময় শিথিল ছিল। স্থানীয় আর্মি সিকিউরিটি ইউনিট এ ব্যাপারে কড়া নজর রাখলে এই ব্যাপারটি নজরে না আসার কোনও কারণ ছিল না। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউরের দলের সঙ্গে ছিল ১১টি সাব-মেশিনগান, ৩টি রকেট লঞ্চার এবং গ্রেনেড ফায়ারিং রাইফেল। ১৬ জন অফিসারকে একটি পিকআপে গাদাগাদি করে তোলা হলো। সার্কিট হাউসের একটি নকশা বের করে তিনি অফিসারদের পরিকল্পনাটি বুঝিয়ে দিলেন। তিনি তাদের আবার শপথ করিয়ে বললেন, “আজ আমরা শুধু প্রেসিডেন্টকে তুলে আনতে যাচ্ছি”।

এই অভিযানে তিনটি গ্রুপ ছিল। প্রথম দু’টি সার্কিট হাউস আক্রমণ করবে। তৃতীয় গ্রুপটি সার্কিট হাউসের পেছনে আলমাস সিনেমা হলের কাছে অবস্থান নেবে। কেউ যদি সার্কিট হাউস থেকে পালাতে চেষ্টা করে তবে তাকে গুলি করে মারা হবে। প্রথম দলে যেতে কে কে ইচ্ছুক জানতে চাইলে অনেকেই এই দলে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। এই দলটি জিয়াকে অপহরণ করবে। কিন্তু মতিউর তাদের মধ্য থেকে ৬ জনকে বেছে নিলেন। তারা হলেন মাহবুব ফজলে খালেদ ক্যাপ্টেন জামিল হক ও আবদুস সাত্তার এবং লেফটেন্যান্ট রফিকুল হাসান খান। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ফজলে আর গাড়ি চালকের আসনে ছিলেন মাহবুব। ৯ নম্বর কক্ষে ঘুমন্ত জিয়াকে অপহরণের দায়িত্ব দেয়া হয় ফজলে এবং ক্যাপ্টেন সাত্তারকে। মতিউর নিজে ছিলেন দ্বিতীয় গ্রুপে। তার সঙ্গে ছিলেন মেজর মমিনুল হক, মেজর মোজাফফর হোসেন, ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন আহমেদ এবং লেফটেন্যান্ট মোসলেহ উদ্দিন। প্রথম দলকে পেছন থেকে সহায়তা করবে এই দ্বিতীয় দলটি। মেজর গিয়াস উদ্দিন, মেজর ফজলুল হক, ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ এবং সৈয়দ মুনিরকে নিয়ে গঠন করা হয় তৃতীয় দলটি।

রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। দল তিনটি কালুরঘাট থেকে সার্কিট হাউসের দিকে রওনা দিল। প্রথম দলের পিকআপে বসা তরুণ লেফটেন্যান্ট রফিক এ সময় কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “আমরা কি প্রেসিডেন্টকে মেরে ফেলতে যাচ্ছি?”  

লে. কর্নেল ফজলে তাকে বললেন, “না আমরা শুধু তাকে তুলে নিয়ে আসব।” অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শেষ মুহূর্তেও দলের অনেক সদস্য বিশ্বাস করতেন যে তারা জিয়াকে জিম্মি হিসেবে তুলে আনতে যাচ্ছেন।

দু’টি দল সার্কিট হাউসে বিনা-বাধায় প্রবেশ করে। অজানা কারণে সার্কিট হাউসের লোহার গেট খোলা ছিল। গেটে পাহারায় ছিল চারজন প্রহরী। তারা দল দু’টিকে সার্কিট হাউসে প্রবেশে কোনও বাধা দেয়নি। এ সময় লে. কর্নেল ফজলে হোসেন তার রকেট লঞ্চার থেকে পরপর দু’টি ফায়ার করেন। একটির আঘাতে জিয়ার শয়নকক্ষের নিচের দিকের কিছু অংশ ভেঙে যায়।

‘জিয়া সাদা পাজামা পরিহিত অবস্থায় অন্য দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাত সামান্য তুলে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, “কি চাও তোমরা?” কাছেই ছিলেন মেজর মুজাফফর এবং লেফটেন্যান্ট মোসলেহ উদ্দিন। মুসলেউদ্দিন জিয়াকে নিশ্চিন্ত করতে চাইলেন। তিনি বললেন, “ভয়ের কোনও কারণ নেই স্যার।”  সম্ভবত তখন এই দুই অফিসারের ধারণা ছিল জিয়াকে হত্যা নয়, অপহরণ করা হবে’

........‘’........

সবাইকে ভয় পাইয়ে দেয়া এবং দলের অন্য গ্রুপকে সঙ্কেত দেয়ার জন্যই এই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। রকেট লঞ্চারের ফায়ারের পরপরই অন্য সবই তাদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। নিরাপত্তা কর্মচারীদের মধ্যে প্রথমেই নিহত হন পুলিশ কনস্টেবল দুলাল মিয়া। তার মাথায় গুলি ‍লাগে। এ সময় প্রায় ৪৪ জন সশস্ত্র পুলিশ ডিউটিতে ছিল। কিন্তু তারা কেউ বাধা দেয়ার চেষ্টা করেনি। বরং তাদের কেউ কেউ আত্মগোপন করে। পরবর্তীকালে তদন্ত কমিশন জিয়া হত্যার তদন্তকালে দেখতে পান যে, দুলাল মিয়া ছাড়া আর মাত্র তিনজন পুলিশ গুলিবিদ্ধ হয়। এতে বোঝা যায় যে, আক্রমণকারীরা তেমন কোনও বাধার সন্মুখীন হননি। এছাড়া অন্য যে ১২ জন পুলিশ আহত হয়েছিল তাদের কেউ গুলিবদ্ধ হননি। এমনকি সার্কিট হাউসে কর্তব্যরত প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরাও এ সময় ঝিমোছিলেন। যে দু’জন সৈন্য জিয়ার কক্ষের সামনে পাহারায় থাকার কথা তাদের একজনকে নিচতলায় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। আর অন্যজনকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায় তার কোয়ার্টারে।

যাই হোক আশ্চর্যজনকভাবে এই অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্তরা দলের কেউ নিহত অথবা আহত হননি। তাদের যে দু’জন আহত হন তারা আকস্মিকভাবে তাদের সহযোগীদের গুলিতেই আঘাত পান। পেছনের দলের গুলিতে আহত হন লে. কর্নেল ফজলে হোসেন ও ক্যাপ্টেন জামিল। আহত অবস্থাতেই জামিল দোতলায় উঠেন এবং জিয়ার দেহরক্ষী নায়েক রফিকউদ্দিনকে গুলি করেন। এতে রফিকউদ্দিন আহত হন। তিনি গুলির শব্দ শুনে ওইসময় জিয়ার কক্ষের দিকে ছুটে আসছিলেন। সার্কিট হাউসের দোতলায় পেছন দিকের একটি ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন প্রেসিডেন্টের চিফ সিকিউরিটি অফিসার লে. কর্নেল মইনুল হোসেন এবং প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আশরাফুল হক। গুলির শব্দ শুনে তারা অস্ত্র হাতে জিয়াকে রক্ষা করতে ছুটে আসছিলেন। কিন্তু তারা অস্ত্র ব্যবহারের আগেই আক্রমণকারীদের গুলিতে সঙ্গে সঙ্গে করিডোরে লুটিয়ে পড়েন।

৫ সদস্য বিশিষ্ট পেছনের দলটি মতিউরসহ এই সময়ে দোতলায় অন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। তারা আগেই জেনেছিল যে জিয়া ৯ নম্বর কক্ষে আছেন। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে কক্ষের দরজা ভেঙে ফেলতেই দেখলেন ঘরে জিয়া নেই। এ ঘরে রয়েছেন ড. আমিনা রহমান। ফলে তারা করিডোরে ছোটাছুটি করতে লাগলো। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এ সময় উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, “প্রেসিডেন্ট কোথায়? প্রেসিডেন্ট কোথায়?” কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বুঝতে পারলেন জিয়া চার নম্বর রুমে আছেন। সিঁড়ির কাছে অবস্থিত এই রুমের দু’টি দরজা ছিল। একটি দরজা সিঁড়ির কাছে, অন্যটি বারান্দার দিকে। বারান্দার দিকে দরজাটি ছিটকিনি লাগানো ছিল। ক্যাপ্টেন সাত্তার লাথি মেরে ছিটকিনি ভাঙার চেষ্টা করেন। ঠিক এই সময়ে কেউ একজন চিৎকার করে বললো, “প্রেসিডেন্ট বাইরে আসছেন।” এর ঠিক এক মুহূর্ত পরেই আরেকজন চিৎকার করে বললো, “ওই তো তিনি।”

জিয়া সাদা পাজামা পরিহিত অবস্থায় অন্য দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। তারপর হাত সামান্য তুলে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, “কি চাও তোমরা?” কাছেই ছিলেন মেজর মুজাফফর এবং লেফটেন্যান্ট মোসলেহ উদ্দিন। মুসলেউদ্দিন জিয়াকে নিশ্চিন্ত করতে চাইলেন। তিনি বললেন, “ভয়ের কোনও কারণ নেই স্যার।”  সম্ভবত তখন এই দুই অফিসারের ধারণা ছিল জিয়াকে হত্যা নয়, অপহরণ করা হবে। কাছেই ছিলেন মতিউর। তিনি জিয়াকে কোনও সুযোগই দিলেন না। মুসলেহ উদ্দিনের আশ্বাসের বাণী তার ঠোঁটে থাকতে থাকতেই মতিউর তার সাব-মেশিনগান দিয়ে জিয়ার  গুলি ছুড়লেন। একের পর গুলিতে জিয়ার শরীরের ডান দিক ঝাঁঝরা হয়ে গেল। দরজার কাছে তার দেহ হুমড়ি খেয়ে পড়লো। মতিউর পাগল হয়ে উঠলো। বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার দেহ উল্টে মুখে-মাথায় ম্যাগজিনের বাকি গুলিগুলো শেষ করলেন। গুলির আঘাতে জিয়ার মাথা ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেল। জিয়াকে হত্যার পর তারা দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো। তারা তাদের দু’জন আহত সহযোগীকেও সঙ্গে নিয়ে গেল। ২০ মিনিটেরও কম সময়ে এই হত্যাকাণ্ড শেষ হয়ে গেল।

চলবে...

আবেদ খান ● সম্পাদক, দৈনিক জাগরণ

আরও সংবাদ