• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ৩, ২০১৯, ০৬:৫৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ৪, ২০১৯, ০২:৪৯ এএম

নববর্ষ, সম্প্রীতি ও ঐক্যে সমুজ্জ্বল দিন

নববর্ষ, সম্প্রীতি ও ঐক্যে সমুজ্জ্বল দিন

পহেলা বৈশাখ। নববর্ষ। বাংলার মানুষের এবং বাঙালি সংস্কৃতির সর্ববৃহৎ উৎসব। এই তো আমাদের আদি পুরুষদের সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক পরিবেশে উদযাপিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। আমরা বাঙালিরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, মত নির্বিশেষে যেমন উন্মুখ হয়ে থাকি কবে আসবে পহেলা বৈশাখ, তেমনি পাহাড়ে, সমতলে নানা নৃগোষ্ঠী মানুষ বৈসাবি আয়োজন করেছেন। এই দিনটি আমাদের কাছে শুধু উৎসবের দিন নয়, জীবন সংগ্রামে প্রকৃতির রুদ্ররোষের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ের দিন।

এই মহান দিনে নতুন সূর্যোদয়ে অবগাহন করে আমরা সবাই এক বাক্যে প্রার্থনা করি, জগতের সব গ্লানি দূর হয়ে যাক এবং শুচিস্নিগ্ধ হয়ে উঠুক আমাদের এই বাস উপযোগী পৃথিবীটা। কিন্তু রুদ্র বৈশাখ যখন তার ঝড়ো ঝাপটায় ঘরবাড়ি, ফল-ফসল তছনছ করে দিয়ে যায় তখন আমরা এসো হে বৈশাখ কথাটি ভুলে গিয়ে কোমর বেঁধে বিধ্বস্ত বসতবাটি, ক্ষেতখামার পুনঃসংস্থাপনের উদ্দেশ্যে গা-গতর খাটাই, তখন বৈশাখকে মেনে নিতে ইচ্ছা করে না। অথচ মোগল সাম্রাজ্যের দৌরাত্ম্যের আমলে এই মাসকেই লক্ষ্য করে ফসলি সনের পত্তন হয়েছিল। সম্রাট আকবর এই অভিধার স্রষ্টা। সেই সঙ্গে চাষাবাদে রত জমিনের খাজনা আদায়ের জন্য নির্ধারিত এই দিনটি ক্রমেই বাংলার মানুষের কাছে নববর্ষ অথবা বর্ষবরণের দিন হিসেবে গণ্য হয়ে ওঠে। প্রভুদের খুশি করার জন্যই আমাদের পূর্বপুরুষদের দিনরাত পরিশ্রম করে চোখের জলের সেচ দিয়ে ফসলের কাল গুনতে হতো। নিজের ঘরে কষ্ট থাকলেও মহাজনদের ফসলি সনের প্রথম দিনে খুশি করতে পারলেই কৃষিজমিতে শ্রম দেওয়া মানুষগুলো কিছুটা স্বস্তিতে থাকত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ওদের খুশি করতে পারলেই আবার জমিন চাষের সুযোগ মিলবে তাদের। এই ভেবে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উদয়াস্ত গতরখাটায়ে মানুষগুলো। তবু যদি এর ভেতরেই বর্ষবরণের খানিকটা তৃপ্তি জোটে।
গ্রামবাংলায় নববর্ষের চালচিত্র অতীব আনন্দময় এবং জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। অতীতের সেই দিনগুলোয় বাড়িতে বাড়িতে পিঠে-পায়েস ও আরও নানা ধরনের ভোজন-বঞ্চনার ব্যবস্থা থাকত। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এদিন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত। নতুন পোশাকে সেজে ভাই কিংবা বাবার হাত ধরে চলে যেত বাহারিয়া মেলায়, যে মেলা বসত গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে। বয়সী বটগাছটার তলাকে কেন্দ্র করে। কত না ধরনের খাবার, খেলনা, আসবাবপত্র, হাঁড়ি-পাতিল, পসারি সাজিয়ে দোকানিরা বসতেন। তাদের কাছে পাওয়া যেত তালপাতার বাঁশি, হাতে ঘুরিয়ে বাজনা বাজানোর মতো বাদ্যযন্ত্র, নানা ধরনের পুতুল, কাগজের চরকি এমন কত বাহারের আকর্ষণীয় জিনিস। শুধু কী তাই, আরও থাকত নানা ধরনের মিষ্টির বিপুল আয়োজন। বাতাসা, কদমা, চিনি দিয়ে তৈরি ইলিশ মাছ, গরু, পাখি এবং কুতুব মিনারের আদলে তৈরি মিষ্টি। যাকে সেকালে ‘সাজ’ বলে চিনতাম। মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, তিলের নাড়ু, কটকটি এ ধরনের আরও অনেক কিছু। মেলার একপাশে যেমন গরম জিলাপি ভাজার কড়াই তপ্ত চুলোর ওপর চড়িয়ে নিরন্তর সরবরাহ করা হতো চাহিদামতো শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ সবাইকে। আর তার পাশেই বসত মিষ্টির দোকান, থাকত রসগোল্লা, পানতোয়া, লালমোহন, রাঘবসাই। আর নানা আকারের সন্দেশ, কোনোটা মাছের মতো, কোনোটা শাঁখের মতো, কোনোটা বা পাখির মতো। আর ওই যে আসবাবের কথা বললাম। সেটি থাকত মেলার একেবারে প্রান্তে। যেখানে চৌকি থেকে শুরু করে আলনা, টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ, জলচৌকি, কাঠের টুল এমনকি বাহারি নকশা করা খাটও পাওয়া যেত। আমাদের দেশের কামার, কুমোরের হাতের যে ধার ছিল তার প্রদর্শনী হতো-মাঠির তৈরি খেলনা, হাঁড়ি-পাতিল তো থাকতই, এমনকি কুয়োর পাত এবং গরুর খাবারের জন্য চাড়িও থাকত। বাংলার মেঠোপথে চলাচলের প্রধান বাহন ছিল গরুর গাড়ি আর ডুলি ও পালকি। কোনো কোনো মেলায় গুরুর গাড়ির চাকা এবং পালকিও কিনতে পাওয়া যেত। আর সবচেয়ে মজার যে জিনিসটি মেলায় আসা শিশু-কিশোরদের আকর্ষণ করত সেটা হলো নাগরদোলা। কী না আনন্দ ছোট ছোট ছেলেমেয়ের, কখনো বড়দের সঙ্গে নাগরদোলায় চেপে প্রচণ্ড আনন্দ উল্লাসে চিৎকার, হৈ-হুল্লোড় করত। কেউ কেউ ঘোরার সময় বড়দের চেপে ধরত। তবুও তাদের নাগরদোলায় চড়া চাই।
এ তো গেল গ্রামীণ সংস্কৃতি এবং জীবনযাপনে সাধারণ মানুষের আয়োজন। কিন্তু বৈশাখ পত্তনের আদি পর্বের সঙ্গে বোধহয় মিল রেখে আমাদের দেশের গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে ব্যবসায়ীরা এই দিনটিকে উদযাপন করতেন, এখনো করেন। তবে বহুলাংশে কমে গেছে। পহেলা বৈশাখ ব্যবসায়ীদের নবযাত্রার দিন। তাই তারা সেদিন নতুন হালখাতা খুলে বসেন। লাল, নীল, সবুজ কাগজে ত্রিকোণ পতাকা দিয়ে পুরো দোকানটাকে সাজান। আর দোকানে ঢোকার প্রবেশপথের দুধারে দুটি কলাগাছ, তার সঙ্গে দুটি মঙ্গলঘট আমপাতা দিয়ে সাজিয়ে গেট তৈরি করেন। আর সেখানে ওই লাল, নীল, সবুজ কাগজ কেটে শিকল বানিয়ে প্রবেশদ্বারটিকে আকর্ষণীয় করে তোলেন। এই দিনের ভোরবেলা থেকে তারৎ খদ্দের আমন্ত্রিত হয়ে দোকানে আসেন। কুশল বিনিময় করেন এবং মিষ্টিমুখ করেন। এদের মধ্যে কারো যদি বাকি-বকেয়া থাকে, তা এই দিনে শোধ করেন। মহাজনের আদায় হয় ভালো, তিনিও খুব কুশলী। আর নতুন হালখাতাটি উদ্বোধন করেন। পুরনো বছরের জাবেদা খাতাটি সুতো দিয়ে বেঁধে সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখেন। এদিন দোকানে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টির আয়োজন থাকে অভ্যাগতদের আপ্যায়নের জন্য। দিনটি বণিকের বাণিজ্য নয়, শুধু অভ্যাগত সবাই দিলখোলা মহাজনকে দেখতে পান। এই যে পরিবেশ এতে সাম্প্রদায়িকতার কোনো ছোঁয়া ছিল না, ছিল সম্প্রীতির অপার ঐশ্বর্য।
একালের নববর্ষ
পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ জামানায় যদিও বা প্রচলিত রীতিতেই পহেলা বৈশাখ পালন করা হতো। ব্যবসায়ীরাও নতুন বছরকে হালখাতার মাধ্যমে স্বাগত জানাতেন। কিন্তু সামরিক জান্তার আইয়ুবী আমলে বাংলার সংস্কৃতিকে আঘাত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করলেও মুসলিম লীগের মতো বাংলা ভাষাকে অবমাননা করতে ছাড়ল না। সেই সঙ্গে বাংলার মানুষের নববর্ষ ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন ২৫ বৈশাখ যেন তাদের চক্ষুশূল হয়ে গেল। প্রথম লড়াইটা বাধল ১৯৬১ সালের কবিগুরুর জন্মশতবর্ষে, রবীন্দ্রসংগীত বর্জন এবং মেয়েদের কপালে টিপ পরার ওপর অদ্ভুত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। কিন্তু তাই বলে একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন বন্ধ করতে পারেনি সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু, তেমনি এই নিষেধাজ্ঞাকেও উড়িয়ে দিল বাংলার সাধারণ মানুষ, শিল্পী-সংস্কৃতিসেবী তো বটেই। তারা জোট বাঁধল এবং পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান গ্রামে তো পালিত হতোই। এবার শহরেও এসে পৌঁছল। এতদিন মানুষের ঘরে ঘরে বা পাড়া-মহল্লায় বৈশাখের যে ছোটখাটো আয়োজন হতো এবারে তা পাকিস্তানি সামরিক শাসনামলেই বহিরাঙ্গনে বিস্তৃত হয়ে গেল। এর উদ্যোগ গ্রহণ করল রবীন্দ্র শতবর্ষের ফসল হিসেবে সৃষ্ট ছায়ানট। তারা তাদের বিদ্যানিকেতনের বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন ধার্য করে দিল পহেলা বৈশাখকে। চলেও ছিল কয়েক বছর কিন্তু বর্ষবরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মানুষের জীবনে বলে ছায়ানট রমনার বটমূলে


নব-অরুণোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সম্মেলক গান গেয়ে নতুন বছরকে আবাহনের সিদ্ধান্ত নিল। ১৯৬৭ সালে সম্ভবত রমনার বটমূলে ছায়ানট প্রথম বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করে, সেই থেকে আজ পর্যন্ত এ শুধু বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এ অনুষ্ঠানটি সব বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হতে হতে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। অবশ্য মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে দশজনকে হত্যা করে উৎসাহী মানুষগুলোকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানবিমুখ করতে চেয়েছিল। তা কিন্তু পরের বছর থেকে দ্বিগুণ জনসমাগমে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ হয়েছে এবং সেই সঙ্গে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ১৯৮৩-৮৪ সালে সবর্জনীন আনন্দ শোভাযাত্রা উদ্যোগে শুরু হয়। সেটাই পরে ১৯৮৯ সালে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রারও পত্তন হয়েছিল। প্রতিবছর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটিয়ে চারুকলার শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েরা দিনরাত পরিশ্রম করে প্রগতিশীল শিক্ষকদের পরামর্শে অসাধারণ সব মোটিফের সৃষ্টি করেন। নানা ধরনের মুখোশ ও পশু-পাখি তো থাকেই, রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন হিসেবে কখনো বিশাল অজগর, কখনো প্যাঁচা, কখনো বা দৈত্য-দানবের প্রতিকৃতি দিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাজানো হয়। এই দীর্ঘদিনের স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা কতখানি আনন্দ ও ঘৃণা প্রকাশে সক্ষম হয়েছে তা এ দেশের জনগণ সবাই জানেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ঢাকায় শুরু হওয়ার অনেক আগেই যশোরে মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয়। আজ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কার স্বীকৃতি পেল না পেল তা না ভেবেই কিন্তু বাংলার জনগণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিজেদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে শুরু করেছেন। তাই বলি আমাদের বৈশাখ যতই রুদ্র হোক না কেন, মানুষকে এখনো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে এবং মানুষে মানুষে সখ্য সৃষ্টি করে।


১৯৭১ সালে তাই চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র চালু হওয়ার পর যে বৈশাখ এসেছিল, তাকে আবাহন করে বিপ্লবী সৈনিক ও বেতার প্রযোজক কবি মুস্তফা আনোয়ার লিখেছিলেন, বৈশাখের রুদ্র-জামা আমায় পরিয়ে দে মা। কারণ আমরা তখন পাকিস্তানি পশুশক্তি হায়েনা বাহিনীর সঙ্গে লড়ছিলাম। তাই কবি বৈশাখের রুদ্ররূপকে আপন শক্তিতে পরিণত করার জন্য দেশমাতৃকার কাছে আবদার করেছিলেন। আমরা তো তাই আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে গণহত্যা সত্ত্বেও বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ ও মাতৃকাকে পৈশাচিক শক্তির কবল থেকে পুনরুদ্ধার করতে জানপ্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলাম।


অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, আমি তখন দৈনিক পূর্বদেশে চাকরি করি। আনম গোলাম মোস্তফার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করলাম, আমরা কী করে নতুন বছরকে আবাহন জানাব। অনেক চিন্তার পর সিদ্ধান্ত হলো, কারফিউর মধ্যে বাইরে যখন কিছুই করা সম্ভব নয়, তখন সবাই মিলে গুড়ের পায়েস খেয়ে নববর্ষ উদযাপন করব। আমরা জানতাম, আমাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছু মানুষ তো আছেই। তা ছাড়া কিছু জামায়াতের লোকও সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়েছে। তার পরও আমরা উদ্যোগ গ্রহণে অবিচল রইলাম। কিন্তু অবজারভার হাউসে পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক পূর্বদেশ ও রোজনামা ওয়াতিন এবং বাংলা ও উর্দু চিত্রালীর সাংবাদিক ও প্রেস কর্মচারীরা কর্মরত ছিলেন। মেশিনম্যান থেকে আরম্ভ করে এডিটর পর্যন্ত সর্বসাকুল্যে সেই মুহূর্তে শ’দেড়েকের মতো মানুষ উপস্থিত ছিলেন। এতজনের পায়েস রান্না করা যাবে কী করে। এ যখন ভাবছিলাম, তখন নারিন্দার পীর সাহেবের প্রধান খলিফা সুফি গোলাম মহিউদ্দিন পূর্বদেশে সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে কাজ করতেন। তিনি এগিয়ে এলেন এবং আমাদের আশ্বস্ত করলেন। বললেন, আপনারা চিন্তা করবেন না, কারফিউ যখন থাকবে না নারিন্দা পীর সাহেবের বাসা থেকে ডেগ-ডেকচি ও কাফগিরের ব্যবস্থা আমি করব। আপনারা চাল, গুড় ইত্যাদি কেনার জন্য টাকার ব্যবস্থা করুন। ওরা এখানে (অবজারভার হাউসে) এসে সেই রান্না করবে।

আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। ১৪ তারিখ সকালবেলা রান্না হলো। অবজারভার অফিস ছাড়াও রাস্তার ওপারের দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকার সাংবাদিক ভাইদের আমন্ত্রণ জানালাম এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু কারফিউয়ের কারণে তারা আসতে পারলেন না। গুড়ের পায়েস রান্না করে পূর্বদেশের রিপোর্টিং টেবিলগুলো একসঙ্গে লাগিয়ে সেখানে খাবারের ব্যবস্থা করলাম। থালা নিয়ে হলো সংকট। এত থালা কোথা থেকে পাব। বাইরে থেকে তো আনা সম্ভব নয়। তাই অবজারভার হাউসের নিরাপত্তাকর্মী এবং প্রেসকর্মীদের খাবারে ‘বারতন’গুলো একত্র করে সবাইকে একসঙ্গে না দেওয়া গেলেও বারবার পায়েস পরিবেশন করা হলো। সবাই চমৎকৃত এবং আনন্দিত হলেন। আমরা উৎফুল্ল হলাম সফল হলাম বলে। শুভ নববর্ষকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকবলিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশেও বরণ করতে পেরে। বঙ্গসংস্কৃতি এবং বাঙালি জাতিসত্তার গর্বে সেদিন বুকটা ভরে গিয়েছিল। মনে মনে বললাম, দস্যুদল দেশের ওপর যতই দমননীতি চালাক না কেন, আমরা তো কয়েকজন হলেও আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ওদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পালন করলাম এবং প্রমাণ করলাম বাংলার অকুতোভয় মানুষকে হত্যাকা-, দমননীতি চালিয়ে ক্ষান্ত করা যাবে না।
বৈশাখ আমাদের ঐতিহ্য। বঙ্গসংস্কৃতির প্রধান জনপ্রিয় উৎসব। এই প্রাণশক্তিতেই আমরা অসত্য-অশুচিকে প্রতিরোধ করব।
লেখক : সাংবাদিক, কলাম লেখক ও স্বাধীনবাংলা বেতারের সংগঠক।