• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০১৯, ০৯:৩৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৩, ২০১৯, ০৭:৫৫ পিএম

সড়ক দুর্ঘটনা 

ক্ষতিগ্রস্থদের বেশিরভাগই ক্ষতিপূরণ পান না

ক্ষতিগ্রস্থদের বেশিরভাগই ক্ষতিপূরণ পান না
গ্রিনলাইন বাসের চাপায় পা হারানো রাসেল

গ্রীনলাইন বাসের চাপায় পা হারানো রাসেল সরকার শেষ পর্যন্ত পরিবহনটির মালিকের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক পেলেন। যদিও  মালিকের প্রতি আদালতের নির্দেশ ছিল ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করার। বাকি টাকা পরিশোধ করতে একমাস সময় দেয়া হয়েছে পরিবহনের মালিককে।

বুধবারের (১০ এপ্রিল) এই ঘটনার পর আদালত অঙ্গণে এই নিয়ে চলছে নানামুখী আলোচনা। এতে কেউ বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে আদালতের অনেক নির্দেশ আছে। কিন্তু এসব নির্দেশ পালন হয় খুবই সামান্য। আবার কেউ এর কারণ উল্লেখ করে বলছেন, এসব ঘটনার ভুক্তভোগীরা সাধারণত গাড়ির মালিকদের চেয়ে আর্থিক ভাবে অসামর্থ্য হন। তাই তারা আইনি প্রতিকার পান না বললেই চলে। আবার কেউ কিছু দিতে বাধ্য হলেও আইনের ফাঁকে মামলাটি দীর্ঘসূত্রতায় ফেলে বহুবছর পর তা দেন। টাকার অবমূল্যায়ন হয়ে যাওয়ার ফলে ভুক্তভোগীর ততটা উপকারে আসেনা তা। 

আইনজীবীরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ রাসেল সরকার ছাড়াও এর মধ্যে শিশু জিহাদ, লঞ্চ দুর্ঘটনায় আবু বকর ও রমিজউদ্দিন কলেজের ছাত্র রাজীব ও মিমের পরিবার ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছে। তবে সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন, চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনিরের পরিবারকেও ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ এলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর স্ত্রী রওশন আক্তার বলেছেন, ২৪ বছর অপেক্ষার পর এই রায় পেয়েছি। এটা জাহাজের সঙ্গে ডিঙি নৌকার যুদ্ধ করার মতো অবস্থা। আমি অনেক ছোট মানুষ। একটি কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করে অনেক কষ্টে মামলা চালিয়েছি। এখন প্রভাবশালী মহলের কারণে এই ক্ষতিপূরণের টাকা পাচ্ছি না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেছেন, অনেক মামলার চূড়ান্ত শুনানিও হয়নি। এ পর্যন্ত চারটি পরিবারের লোকজন ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে শিশু জিহাদ, লঞ্চ দুর্ঘটনায় আবু বকর, রমিজউদ্দিন কলেজের ছাত্র রাজীব ও মিমের পরিবার। অনেকগুলোর হাইকোর্টে আদেশ হওয়ার পরও এখনও ক্ষতিপূরণ পায়নি। সামনে কয়েকটি মামলার দিনও রয়েছে। আমি আশা করি উচ্চ আদালতের আদেশ অবশ্যই বাস্তবায়ন হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী আব্দুল হালিম বলেন, এই বিচারটা দরিদ্র মানুষের জন্য। নিম্ন আদালত ক্ষতিপূরণ দেয়ার পর তা পেতে অনেক দেরি হয়ে যায়।

জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা দেশের প্রথম মামলাটি হয়েছিল ২৯ বছর আগে। ২৬ বছর সময় লেগেছে মামলাটির রায় হতে। রায়ের তিন বছরেও মেলেনি ক্ষতিপূরণের টাকা। সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মন্টু সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন ১৯৮৯ সালে। তার স্ত্রী রওশনা আরা ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন ১৯৯১ সালে। ২০১৪ সালে মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিচার আদালতের রায় বহাল রেখে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল আপিল বিভাগ মন্টুর পরিবারকে এক কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে গাড়ির মালিক বা কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়। এখনও রওশন আরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি।

রাজধানীর কুর্মিটোলায় বাস চাপায় নিহত শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীমের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে জাবালে নূর পরিবহন। নিহত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫ লাখ টাকা করে দেয়ার হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রাখে আপিল বিভাগ। গত বছরের ৩০ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের মালিকপক্ষকে বাসচাপায় নিহত দুই শিক্ষার্থী রাজীব ও মীমের পরিবারকে এক সপ্তাহের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা করে দিতে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। গত ২৯ জুলাই দুপুরে বিমানবন্দর সড়কে বাসের জন্য অপেক্ষা করা শিক্ষার্থীদের চাপা দেয় জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস। এতে ঘটনাস্থলেই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল করিম রাজীব ও দিয়া খানম মীমের মৃত্যু হয়। এছাড়া এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন।

গত বছরের ২৮ এপ্রিল মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে কথাকাটাকাটির জেরে গ্রীনলাইন পরিবহনের বাসচালক রাসেল সরকারের (২৩) ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেন। এরপর অস্ত্রোপচার করে তার বাম পা কেটে ফেলা হয়। এ ঘটনায় রাসেলের বড় ভাই আরিফ সরকার বাসচালক কবির মিয়ার বিরুদ্ধে যাত্রাবাড়ি থানায় ওইদিনই মামলা করেন। পা হারানো রাসেলের বাবার নাম শফিকুল ইসলাম, গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ি। ঢাকার আদাবর এলাকার সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় তার বাসা। ওই দুর্ঘটনার পর সরকারি দলের সংরক্ষিত আসনের সাবেক এমপি আইনজীবী উম্মে কুলসুম স্মৃতি গত বছরের ১৪ মে হাইকোর্টে ক্ষতিপূরণ চেয়ে একটি রিট আবেদন করেন।

রাজধানীর বসুন্ধরা গেট এলাকায় সু-প্রভাত বাসের চাপায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) শিক্ষার্থী আবরার আহাম্মেদ চৌধুরীর নিহতের ঘটনায়, তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল করেছে বাস মালিক। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয় বলে জানান রিটকারী আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল।

এর আগে গত ২০ মার্চ আবরারের পরিবারকে এক সপ্তাহের মধ্যে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে সু-প্রভাত পরিবহনকে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একইসঙ্গে আবরারের পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে আদালত রুল জারি করে। এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।

সড়ক দুর্ঘটনায় চট্টগ্রাম ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে তিন শিশু শিক্ষার্থী এবং এক কলেজ ছাত্রী নিহতের ঘটনায় তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সম্প্রতি এ বিষয়ে দায়ের করা এক রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এর আগে, গত ২২ জানুয়ারি চট্টগ্রামে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী। ১৬ জানুয়ারি এক কলেজ শিক্ষার্থী। ২৮ জানুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জে আপন দুই ভাই (শিশু) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। পরে ওই ঘটনায় চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (বাস্ট) পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়।

মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ও পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবার এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি। বিষয়টি আপিল বিভাগে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের এক গ্রামে ছবির শুটিং স্পট দেখে ঢাকা ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন খ্যাতিমান চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ এবং শহিদ বুদ্ধিজীবী, নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর ছেলে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন। দুর্ঘটনার প্রায় দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা বাস মালিক, চালক ও বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দু’টি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার একটির চূড়ান্ত রায়ে গত বছরের ৩ ডিসেম্বরে তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাস মালিকপক্ষ আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করেছে। যেটার শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে রয়েছে। এদিকে হাইকোর্টে বেঞ্চেও চলমান রয়েছে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীরের মামলার বিচার কাজ।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলার ক্ষেত্রে প্রথম নিষ্পত্তি হয় দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মন্টুর। ১৯৮৯ সালে রাজধানীর শান্তিনগরে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন তিনি। তার স্ত্রী ১৯৯১ সালে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বাংলাদেশ বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে মামলা করেন। নিম্ন আদালত আর্থিক ক্ষতিপূরণের রায় দেন। ২৫ বছর পর ২০১৪ সালের ২০ জুলাই মন্টুর পরিবারকে ৩ কোটি ৫২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। ২০১৬ সালে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ ১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দেয়। তবে এখনও ক্ষতিপূরণ পাননি মন্টুর স্ত্রী রওশন আরা।

বরগুনার তালতলীর পি কে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাদ ধসে হতাহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ কেন দেয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। ৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, বরগুনার জেলা প্রশাসক, বরগুনার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, তালতলী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। জনস্বার্থে দায়ের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত রোববার বিকালে হাইকোর্টের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আদেশ দেয়। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম. মাইনুল ইসলাম।

এমএ/টিএফ