• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ২২, ২০১৯, ০৮:১৪ এএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ২২, ২০১৯, ০৮:১৪ এএম

ঈদ টার্গেটে সারাদেশে পরিবহনে বেপরোয়া চাঁদাবাজি

ঈদ টার্গেটে সারাদেশে পরিবহনে  বেপরোয়া চাঁদাবাজি


আসন্ন ঈদকে ঘিরে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজদের তৎপরতা বেড়েছে। এই বেপরোয়া চাঁদাবাজি রোধে র‌্যাব-পুলিশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতারা পরিবহন চাঁদাবাজদের পক্ষে অবস্থান নেয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও উদ্যোগই ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে অনেকের অভিযোগ।
 
পরিবহনের একাধিক নেতা বলেছেন, রাজধানীর শতাধিক পয়েন্টে এ চাঁদাবাজি এখন অপ্রতিরোধ্য রূপ নিয়েছে। একশ্রেণীর পরিবহন শ্রমিক, চিহ্নিত সন্ত্রাসী, পুলিশ ও ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্টদের সমন্বয়ে এ চক্র গড়ে উঠেছে। তাদের কাছেই জিম্মি হয়ে পড়েছে যানবাহন চালক, মালিকসহ সংশ্লিষ্ট সবাই। 

চাঁদাবাজির নিয়ে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও দ্বন্দ্ব-মারামারি হচ্ছে। বিভিন্ন রুটে পরিবহন ধর্মঘট পর্যন্ত পালিত হয়েছে। তবুও চাঁদাবাজদের রোষানল থেকে রেহাই মিলছে না।

সায়েদাবাদ টার্মিনাল, গুলিস্থান বাসস্ট্যান্ডসহ রাজধানীর সর্বত্রই পরিবহন সেক্টরকে ঘিরে চাঁদাবাজি চলছে। সায়েদাবাদে বিভিন্ন রুটে কমিটির নামে চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া চাঁদাবাজি করছে। টার্মিনাল-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সায়েদাবাদ থেকে দেশের পূর্ব-উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহের ৪৭টি রুটে চলাচলরত দুই হাজারের বেশি যানবাহন থেকে প্রতিদিন চাঁদাবাজি চলছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুরসহ ৩২টি রুটে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ২শ’ কোচ চলে। 

এছাড়া রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল, মহাখালী, উত্তরা, গাজীপুর, টঙ্গী, কালিগঞ্জ, শ্রীপুর, কাপাসিয়াসহ শহর ও শহরতলীর অন্যান্য রুটে ১ হাজারেরও বেশি বাস-মিনিবাস চলাচল করে। যানবাহনের চালক, কন্ডাক্টর ও হেলপাররা জানান, কোনো রুটের যানবাহনই চাঁদামুক্ত নয়। বরং চলাচলকারী সব গাড়িকে প্রতি ট্রিপেই নির্ধারিত অঙ্কের চাঁদা পরিশোধের পর বাস টার্মিনাল ত্যাগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে দূরপাল্লার কোচ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদাবাজি চলছে এবং লোকাল সার্ভিসের প্রতিটি গাড়ি থেকে ট্রিপে আদায় করা হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। 

বিভিন্ন রুটে চলাচলরত গাড়ির মালিক-শ্রমিকরা জানান, কমিটি দখল ও মাত্রাতিরিক্ত চাঁদাবাজির অত্যাচারে মালিকরা পথে বসতে চলেছেন। পাশাপাশি শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মালিক বলেন, লাকসাম, কিশোরগঞ্জ, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন রুটে এখন গাড়িপ্রতি ১২৫০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে।

চাঁদাবাজির শিকার পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা প্রতিদিন চাঁদা প্রদানের বিস্তারিত তালিকা তুলে জানান, পরিবহন-সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় ফেডারেশনের নামে ৫০ টাকা, মালিক সমিতি ৮০ টাকা, শ্রমিক ইউনিয়ন ৪০ টাকা, টার্মিনাল কমিটি ২০ টাকা, কলার বয় ব্যবহার বাবদ ২০ টাকা, কেরানির ভাতা ২০ টাকা, মালিক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের নামে ৫০ টাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় দুই প্রভাবশালী নেতার নামে ৫০ টাকা করে চাঁদা নেয়া হচ্ছে।

দাউদকান্দি রুটের মিনিবাস চালক লুৎফর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটের বাস শ্রমিক বেলায়েত, হোসেন আলী, খবির মিয়াসহ কয়েকজন জানান, চাঁদা না দিয়ে কোনো গাড়ি টার্মিনাল থেকে বাইরে বের করার সাধ্য কারও নেই। চাঁদা নিয়ে কোন শব্দ করলে নির্যাতনসহ টার্মিনাল ছাড়া হতে হয় বলেও পরিবহন শ্রমিকরা মন্তব্য করেন।

পরিবহন চালক ইউনিয়ন সূত্র জানায়, বেবিট্যাক্সি, টেম্পো, বাস, মিনিবাস, ট্রাক থেকে জোরজবরদস্তি করে টাকা আদায়ের বিষয়টি বিভিন্ন বিশেষণে চিহ্নিত।

সন্ত্রাসীরা সরাসরি চাঁদা তুললেও পরিবহন শ্রমিকরা চাঁদা নেয় শ্রমিক কল্যাণের নামে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা টাকা তোলে মাসোহারা হিসেবে। এছাড়া আছে বেকার ভাতা, রাস্তা ক্লিয়ার ফি, ঘাট ও টার্মিনাল সিরিয়াল, পার্কিং ফি নামের অবৈধ চার্জ। এমন নানা নামে, নানা কায়দায় চলছে এ চাঁদাবাজির ঘটনা। সামাল দেয়ার যেন কেউ নেই। রাজধানীসহ ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতে চলছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা।
 
সায়েদাবাদ-গাবতলী রুটে চলাচলকারী একাধিক মিনিবাস চালক বলেন, নানামুখী চান্দা-ধান্দার কবলে চালক, মালিক, শ্রমিক সবার জীবনই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। নানা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা। মহাখালী, গাবতলী, সায়েদাবাদসহ অন্যান্য বাস ও ট্রাক টার্মিনালের অবস্থা আরও দুর্বিষহ। এসব স্থানে গাড়ি ঢুকতে ও বেরোতেও টাকা লাগে। 

উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার রুটে চলাচলরত কোচের চালকরা জানান, প্রায়ই কোনো না কোনো স্থানে বেকার ভাতা আদায় করা হচ্ছে। নিজেদের বেকার পরিবহন শ্রমিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে একটি চক্র গাড়িপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে। সারা বছরই বিভিন্ন টার্মিনালমুখে অবস্থান নিয়ে তারা রীতিমতো রংবেরঙের স্লিপের মাধ্যমে চাঁদা তুললেও কেউ বাধা দেয় না। ঈদকে সামনে রেখে এখন সড়কের মোড়ে মোড়ে চলছে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য। বিশেষ চেকিং ও মাসোহারা আদায়ের ব্যাপারে তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন। রাজধানীর একপাশ দিয়ে প্রবেশ করে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে ট্রাক প্রতি ৫০০-৬০০ টাকা গুনতে হয়।

ট্রাক চালকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, আগে সাধারণত ঢাকার যে কোনো একজন সার্জেন্টকে ১০০ টাকা দিয়ে স্লিপ সংগ্রহ করলে সিটির মধ্যে আর কোথাও পুলিশকে চাঁদা দিতে হতো না। কিন্তু বর্তমানে এক সার্জেন্ট অন্য সার্জেন্টের স্লিপকে পাত্তা দেয় না, আলাদা আলাদাভাবে টাকা দিতে হয়।

এছাড়া সারা দেশে পুলিশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে প্রতিদিন ১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। আর ঈদ বা কোনো উৎসবে এ চাঁদা আদায়ে পুলিশ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রাজধানীমুখী সড়কপথে চাঁদাবাজি বন্ধে সাদা পোশাকে পুলিশের ১৭টি টিম কাজ শুরু করেছে। ঢাকা ও আশপাশে ১৪টি মোবাইল কোর্টও নামছে।
 
রাজধানীর টার্মিনাল ও সড়কসমূহে চাঁদাবাজি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া।

তিনি বলেন, চাঁদাবাজির স্থান হিসেবে শতাধিক পয়েন্টকে চিহ্নিত করে সেখানে সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েনসহ সিসি ক্যামেরা ফুটেজের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

সার্জেন্ট, ট্রাফিক ও পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করে পুলিশ কমিশনার বলেন, সংশ্লিষ্ট ট্রাফিক ও সার্জেন্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এইচ এম/এএকেএস/আরআই