• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২০, ০৯:১২ এএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১, ২০২০, ০৫:০৫ পিএম

রক্তাক্ত রাজপথ হতে গণতন্ত্রের পুনরুত্থান

সহে না মানবতার অবমাননা

সহে না মানবতার অবমাননা

প্রতিদিন সারাবিশ্বের মত বাংলাদেশের নানা প্রেক্ষাপটেও ঘটছে বিভিন্ন ঘটনা। অতীতেও ঘটনাবহুল সময়ের এই অব্যাহত পদচারণায় ঘটেছে অনেক কিছুই। তবে তার সব কিছুই হয়তো স্মৃতির দুয়ারে কড়া নাড়ে না। তবে সম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন পর্যায়ে বিতর্কিত করতে যে রাজনৈতিক অপচর্চা  চালানো হচ্ছে আর পদে পদে সরকারের দোষ ধরার চেষ্টা চলছে, এর প্রেক্ষিতে স্মৃতির আর্কাইভে খুঁজে দেখলে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিনটি চোখে পড়ে।

আজ থেকে ঠিক ১৯ বছর আগে তৎকালীন বিচারপতি লতিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি নীলনক্সার নির্বাচনের আয়োজন করে তত্বাবধায়ক সরকার। নীলনক্সার ঐ নির্বাচনের পরপরই শুরু হয় সারাদেশে ভয়াল তাণ্ডব। আর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিভীষিকাময় একটি অধ্যয় রচিত হয় ২০০১ এর রক্তঝরা এমনই অক্টোবর মাসে। সেদিনের সেই রক্তাক্ত রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণমানুষের দুর্গ অটল ছিলো বলেই দেশ বিরোধীদের পরাজয় ঘটেছিল। 

সেই রক্তাক্ত সময়কে স্মরণ করে তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দল, বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত বিপন্ন গণতন্ত্র লাঞ্ছিত মানবতা - গ্রন্থটি হতে সংকলিত বিশেষ লেখাটি দৈনিক জাগরণ পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।

অক্টোবর ২০০১ নির্বাচন ষড়যন্ত্রের চরম খেলা হলো। কিভাবে নির্বাচনে অতি চালাকির সঙ্গে কারচুপি করা হয়েছিল তা গবেষণায় ভোট জালিয়াতির ১৭টি ভিন্ন ভিন্ন পন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে-

টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়।
• নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্র দখল ও ব্যালট বাক্স ভরে ফেলা।
• ডামি প্রার্থী দিয়ে তার এজেন্টকে নিজের পক্ষে ব্যবহার।
• বিশেষ (দলের সমর্থক বা নীরব কর্মী) ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ, যে ভোটকে প্রভাবিত করবে এবং সুযোগমতো   ব্যালট বাক্স ভরবে।
• প্রকৃত ভোটারকে ভোটদানে বিরত রাখা। দুর্বলকে হুমকি দিয়ে অথবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়ে ভোটদান প্রক্রিয়া     ধীর করে দেওয়া।
• আইনরক্ষাকারী বাহিনীকে প্রবাবিত করে প্রতিপক্ষের কর্মী- নেতাদের আটক, অপদস্থ করা এবং প্রতিপক্ষ এলাকায়   ঘন ঘন টহল দিয়ে প্রতিপক্ষ ভোটার ও সমর্থকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা।
• একজন প্রার্থীর হাতে ভুল ভোটার তালিকা ধরিয়ে দিয়ে ভোটকেন্দ্রে অন্য ভোটার তালিকা ব্যবহার করা।
• পোলিং ও প্রিজাইডিং অফিসারদের হাত করে ব্যালট বাক্স ভরা।
• নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ব্যালট বাক্স আগে থেকে ভর্তি করে রাখা বা ব্যালট বাক্স ঠিকমতো       সিলগালা না করা যাতে পরে ব্যালট ভর্তি করা যায়।
• সমস্যার দোহাই দিয়ে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে অন্য প্রার্থীদের না জানিয়ে আবার ভোট গ্রহণ শুরু, অথবা পিটিয়ে   ভোটার বের করে দেওয়ার মতো সংকটময় পরিস্থিতিতেও ভোট গ্রহণ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানানো।
• অনেকভাবেই ভোট গণনায় কারচুপি করা যায়।
  ক. প্রার্থীর ভোট বদল করে দেওয়া।
  খ. ব্যালট পেপার বান্ডিল করার সময় বৈষম্যের মাধ্যমে।
  গ. ব্যালট বক্স হারিয়ে ফেলে।
  ঘ. ট্যালি গড়াপেটার মাধ্যমে।

• জেলা সদরে যাওয়ার সময় ভোট বাক্স জালিয়াতি বা গায়েব করা।
• ভোট গণনা ও ফল ঘোষণার পর কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিল ঘোষণা।
• ভুল ফল ঘোষণা বা পছন্দের দল এগিয়ে থাকা আসনগুলোর ফল ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন কমিশনের জনমতকে   প্রভাবিত করা।
• প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছাপানো এবং তা নির্দিষ্ট পার্টির প্রার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া। যাতে করে   সুযোগমতো ওই প্রার্থী ব্যালট বাক্স ভরতে পারে। অথবা এমনভাবে ব্যালট পেপার ছাপানো যাতে করে যাকে   হারানো  হবে তার পক্ষের ভোটগুলো বাতিল হয়ে যায়।
• এমন পরিমাণ জাল ভোট প্রদান যাতে কেন্দ্রে মোট ভোটারের ভোট বেশি হয়ে যায়। প্রতি ঘন্টায় সম্ভাব্যের চেয়ে     বেশি ভোট প্রদান অনেক কেন্দ্রেই ঘটে। যেমন: ঘণ্টায় এক বুথে ৮০ ভোটের বেশি ভোট। কিন্তু আমাদের অনেক   কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার ঘণ্টায় এক শ/দু শও হয়ে থাকে।
• প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে যাতায়তের সহজ সুবিধা নেই, সেখানে শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ভোট গ্রহণ ডাহা   জালিয়াতির পর্যায়ে পড়ে। (গ্রস্থ কারচুপির নির্বাচন: অবৈধ সরকার)

নির্বাচনের কয়েকদিন পূর্ব থেকে এবং নির্বাচনের দিন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর চারদলীয় জোট সন্ত্রাস, সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর কর্তৃক হয়রানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, ভোটারদের ভোট দিতে না দেওয়া-এটা কি নিরপেক্ষ সুষ্ঠ নির্বাচন? এতকিছুর পরও আওয়ামী লীগ ৪১% ভোট পেয়েছে। ১৯৯১ সালে ৩৪% ভোট পেয়ে ১০৩ সিট, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩৮% ভোট পেয়ে ১৪৬টি আসন পেয়েছিল আর এবার ৪১% ভোট পেয়ে ৬২টি আসন পাওয়া কি অস্বাভাবিক নয়? জোট ৪৬% ভোট পেয়ে ২১৫টি আসন পায়। মাত্র ৫% ভোটের ব্যবহানে এত বড় আসনের ব্যবধান কি সম্ভব?

শুধু কারচুপি করেই তো শেষ হয় নি। আওয়ামী লীগকে শেষ করে দিতে হবে। এবারে নির্বাচনের রেজাল্ট দখল করতে ভুল করেনি। রেজাল্ট দখল করেছে তারপর শুরু করেছে রাজনৈতকি প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ঘরছাড়া করে দেওয়া। শিশু কন্যাও রেহাই পায় নি এদের হাত থেকে। বিএনপি ও জামায়াত শিবির ক্যাডাররা সমগ্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও মহিলা আওয়ামী লীগের অগণিত নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের পর থেকে। হাত, পা, চোখ তুলে নষ্ট করে দেওয়া, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, লুটপাট করা। প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী, সশস্ত্রবাহিনী অর্থাৎ সেনা, নৌ বিমানবাহিনীর অফিসার, পুলিশ কর্মকর্তা, চাকরি হারাচ্ছে। সাংবাদিকরা খবর লিখে নিহত ও আক্রান্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করতে পারছে না। প্রতি পদে পদে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দেশ পরিচালনা না করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাটাই যেন এই সরকারের সব থেকে বড় কাজ। প্রায় ৪৫ হাজার সন্ত্রাসীর মামলা তুলে নিয়ে মুক্ত করে দিয়েছে। সন্ত্রাসী সমাজবিরোধীদের আনন্দের সীমা নেই বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসায়। খুলনার কুখ্যাত এক সন্ত্রাসী জামিন পেয়েই প্রথম স্লোগান দিয়েছে খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ বলে। তার মন্তব্য খুবই লক্ষণীয় যে, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় না এলে সে জামিন পেত না, তার ফাঁসি হতো। এবার অনেকগুলো নৃশংস হত্যা মামলার আসামি ও ফাঁসির রায় হয়েছে তারপরও সে স্বপ্ল দেখে এবার হয়তো মুক্তি পাবে।

জাতির পিতার হত্যাকারী, শিশু, নারী হত্যাকারী, যারা আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী এবং জাতীয় চার নেতা হত্যাকারী তাদেরও রক্ষার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে এ সরকার। ১৫ আগস্ট যাঁরা শাহাদাতবরণকারী হলেন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, পারভীন জামাল, শেখ আবু নাসের, কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব, সেরনিয়াবাত, সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু। কর্নেল জামিল, কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারি কর্মচারী, কাজের লোকজনসহ অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। ৩ নভেম্বর নিহত জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, এম. মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে হত্যা করেছে।

একের পর এক ঘটনা ঘটছে, হত্যাকাণ্ড ঘটছে অথচ হত্যাকারী-অপরাধী সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।

লেখক: বিশিষ্ট রাজনীতিক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

সম্পাদনা : এস এম সাব্বির খান, সাব-এডিটর, দৈনিক জাগরণ।