• ঢাকা
  • রবিবার, ০৫ মে, ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৬, ২০১৯, ০৯:৫৬ পিএম

দখল

রাজধানীতে খাল উদ্ধারে নেই উদ্যোগ

রাজধানীতে খাল উদ্ধারে নেই উদ্যোগ
দখল ও ময়লা আবর্জনার চাপে ভারাক্রান্ত মোহাম্মদপুরের কাটাসুর খাল -ছবি : জাগরণ

 

হাইকোর্টের রায়ের পর শুরু হয়েছে দখল হয়ে যাওয়া নদীর পাড় উদ্ধার কার্যক্রম। কিন্তু সরকারের এই তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও রাজধানীর ভেতরে বিভিন্ন খালের ‘দখলকৃত জায়গা' উদ্ধারে নেই নূন্যতম তৎপরতা। 

মহানগরীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর, রায়ের বাজার, ইব্রাহিমপুর, কালশির সাংবাদিক কলোনী, বাউনিয়া, দিয়াবাড়ী, শাহজাদপুর, নন্দীপাড়া, সেগুনবাগিচা, গোপীবাগ, বেগুনবাড়ি খালসহ প্রতিটি খালের বেশিরভাগই এখন দখলদারদের পেটে। বাসা-বাড়ির আবর্জনা, প্রাণীর মৃতদেহসহ নানা ধরনের বর্জে এ সব খাল এতোটাই ঠাসা হয়ে আছে যে, জলধারা কোনোটারই স্বাভাবিক নেই। সেই আছে দুর্গন্ধও। দখল হয়ে যাওয়া খালের জায়গা উদ্ধারে কখনই কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সরেজমিনকালে এলাকাবাসীদের সাথে কথা বলে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।

দখল ও ময়লা আবর্জনার চাপে ভারাক্রান্ত মোহাম্মদপুরের কাটাসুর খাল - ছবি : জাগরণ

রায়ের বাজার খালপাড়ের বাসিন্দা সুলতান মিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, আদালতের নির্দেশের পর এখন পর্যন্ত দখল হয়ে যাওয়া খালের জায়গা উদ্ধারে তিনি কোনও তৎপরতা দেখতে পাননি। 

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জাগরণকে বলেন, নদীর পাড় দখল মুক্ত করার যে পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়েছে, তা সত্যিই বড় অর্জন। শুধু নদী নয়, ঢাকার খালপাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদও জরুরি। কারণ এর সাথে জড়িত আছে পরিবেশ ও জলাবদ্ধতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোও।

কাটাসুর খালপাড়ের বাসিন্দা ও ৩৩ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিতন জাগরণকে বলেন, এই খালের এক মুখের শ্যামলী স্লুইচ গেট ও আরেক মুখ রায়ের বাজার খাল হয়ে বুড়িগঙ্গায় লাইন আছে। কিন্তু অবস্থা এতোটাই খারাপ, ময়লা পানি অতোদূর পর্যন্ত যেতে পারে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, খাল ঘেঁষে উঠা স্থাপনাগুলো বেশিরভাগই খালের জায়গা বা পাড় দখল করা। এ সব স্থাপনা উচ্ছেদ না করা হলে খালের আগের প্রবাহ ফিরিয়ে আনা কখনই সম্ভব নয়। এ সব জায়গা দখল হয়েছে ভূমি অফিস, সিটি করপোরেশন, ওয়াসার অসাধু কর্মীদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। দখলকারীরাও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে কেউ এ সব নিয়ে কখনও মাথা ঘামানোর সাহস পান না।

অভিযোগ আছে- সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মীদের সহযোগিতায় জাল দলিল দিয়ে নদীর পাড় দখল করা হয়। ছবিটি কেরাণীগঞ্জের ওয়াশপুর থেকে তোলা - ছবি : জাগরণ

রাজধানীর ১০টি খাল এলাকায় দেখা গেছে, খালের জায়গা বা পাড় দখল করে বহু স্থাপনা তোলা হয়েছে। তবে এ সব দখল হয়ে যাওয়া জায়গা উদ্ধারে তৎপরতা নেই। 

২০১৬ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসন ঢাকায় ৫৪ খাল চিহ্নিত করেছিলো। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫৪টির মধ্যে ৩৭টি খালের অংশ বিশেষ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং আড়াইশয়ের বেশি ব্যক্তি দখল করে নিয়েছেন। এর মধ্যে ২২টি খাল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সীমানায় ও ২৫টিরও বেশি খাল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়।

সরকারি তথ্যমতে, ঢাকা মহানগরের বাসাবো খালের প্রস্থ ৬০ ফুট। বাস্তবে এর প্রস্থ কোথাও ১৫ ফুট বা ২০ সর্বোচ্চ ২৫ ফুট। খালের ওপর বা পাড়ে টংঘর, দোকান-পাট গড়ে তুলে দখলদাররা বহু আগেই খালের দেহ বাগিয়ে নিয়েছেন।

১১০ ফুট প্রশস্ত রামচন্দ্রপুর খাল এখন ৪০-৫০ ফুট নিয়ে টিকে আছে। বাসাবো খালের মতো বেগুনবাড়ি খাল ও মহাখালী খালের প্রস্থ ৬০ ফুট থাকার কথা। এর বাস্তব অবস্থাও বাসাবো খালের মতোই। কোথাও ১৫, ২০, কোথাও ২৫ ফুট প্রস্থ। বাকি জায়গা দখলদারদের কবলে। 

১০০ ফুট প্রশস্ত আবদুল্লাহপুর খাল এখন ৫০ ফুট প্রশস্ত নিয়েও নেই। ১২০ ফুট প্রশস্ত কল্যাণপুর খাল সংকুচিত হতে হতে ঠেকেছে ৬০ ফুটে।

ঢাকা জেলার ভেতর দিয়ে বহমান বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন প্রান্তে দখল চিত্র অহরহ। সীমানা পিলারও দখলদারদের পেটে। জাল দলিল, রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এ সব দখল করা হয়েছে। তবে দখল উচ্ছেদে এখনও সরকারের দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখা নেই এ অঞ্চলে।

সম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশের পর নদী তীর দখল ও দূষণমুক্ত করার লক্ষ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কামরাঙ্গীরচরের নবাবচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে দু’শতাধিক পাকা ও আধাপাকা স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। 

মঙ্গলবার (৫ ফেব্রুয়ারি) নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিআইডব্লিউটিএ দখলদার উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়ে নদী উদ্ধারে পুনরায় উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার ঘোষণা রয়েছে। 

উচ্ছেদ অভিযানে একটি তিন তলা ভবন, পাঁচটি দোতলা ভবন, ২৮টি একতলা ভবন, আধাপাকা ঘর ২২টি এবং টংঘর ১৫৫টি উচ্ছেদ করা হয়েছে।

২৯-৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ছোট-বড় ৪৪৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বিআইডব্লিউটিএ। ঢাকা সদরঘাট থেকে গাবতলী পর্যন্ত নদীর দু’পাড়ে ৬০৯টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এগুলোর মধ্যে ৫৬টি বহুতল ভবন রয়েছে।

বুধবার (৬ফেব্রুয়ারি) মোহাম্মদপুর বসিলা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, নদীর এক পাড়ে মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ থানা এলাকা, অন্য পাড়ে কেরাণীগঞ্জ উপজেলার ওয়াশপুর এলাকা। মোহাম্মদপুরের অংশে নদীর পাড়ে প্রায় দুই কিলোমিটার হেঁটে দেখা যায় নদী ঘেঁষা বহু স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে বসতবাড়ি, ছোট-মাঝারি কল-কারখানা ইত্যাদি। কোথাও কোথাও স্থাপনা নির্মাণও করা হচ্ছিল। এসব বসতবাড়ি, কল-কারখানার মালিকদের প্রত্যেকেরই জোরালো দাবি- এই জায়গার বৈধ মালিক তারা।

মালিকানা প্রশ্নে জুলহাস নামে এক ভোগদখলকারী বলেন, সাফ দলিলে কিনেছি। কী করবেন কইরেন। রতন নামে আরেকজন ভোগদখলকারী বলেন, কেনা জায়গা আমার, রেজিস্ট্রি আমার নামে।

তবে ওই দুই কিলোমিটারসহ বেশকিছু স্থানে নদীর পাড় ঘুরে একটি সীমানা পিলারও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

কেরাণীগঞ্জ উপজেলার ওয়াশপুরে বুড়িগঙ্গা পাড়েও দেখা গেছে, পাড় দখলের রাম রাজত্ব। খুঁটি বসিয়েও দখল করা হয়েছে নদীর পাড়। জানা গেছে, এ সব খুঁটি বসিয়েছেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মালেক। খুঁটির আশপাশে দখলের আরও দৃশ্য আছে। ইট-সিমেন্ট দিয়ে নির্মিত স্থাপনার ভগ্নাংশ যেমন দেখা গেছে, তেমনি স্থাপনা নির্মাণ করতেও দেখা গেছে। ওয়াশপুরের ইট ব্যবসায়ী শাওন মিয়া বলেন, এ সব জায়গা নদীর। সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। এখন শুনি ওই জায়গা নাকি তারা কিনে এটা-সেটা বানায়। আসলে সব মিথ্যা।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, নদীর পাড় দখলদাররা যথেষ্ট শক্তিশালী। নদী, খালসহ জলাধারের জায়গা বেদখলের শাস্তি কঠোর হওয়ার উচিত। যাতে কেউ দখলের কথা চিন্তাও না করে।

আরএম/এসএমএম