• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৮, ২০১৯, ০৩:০৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১১, ২০১৯, ১১:০৬ পিএম

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথ

আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথ

 শৈশব থেকে আমরা আমাদের স্কুলে, কোন অনুষ্ঠানে শুরুতেই গাইতাম  আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘ আমার সোনার বাংলা’।  জাতীয় সঙ্গীত সম্বন্ধে জানতে গিয়ে জেনেছিলাম রবীন্দ্র সঙ্গীতের গীতিকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সুরকার কুষ্টিয়ার বাউল শ্রী গগন চন্দ্র দাস। ডাক হরকরার কাজ করতেন বলে গগন হরকরা নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। তার গান‘আমি কোথায় পাবো তারে..’ গানটি থেকে সুর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  বঙ্গভঙ্গের সময়ে লিখেছিলেন এ গানটি। ১৯৪৭ সালে  দেশভাগ হলো সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে। বঙ্গ ভেঙে গেলো । আমাদের বাংলা পড়লো পাকিস্তানের ভেতরে। পাকিস্তানিরা শাসক হলো আর আমরা শাসিত সে সূত্রে শোষিত

বাঙালিদের উপর কত নিপীড়ন শুরু হলো । কিন্তু সংকট হলো  রবীন্দ্র নাথকে নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মননের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছেন। পাকিস্তানি শাসকরা সেটা বুঝেই রবীন্দ্রনাথকেই প্রথম শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করল । সংস্কৃতির উপর পাকিস্তানিরা শুরুতেই যে আঘাত হানতে শুরু করলো রবীন্দ্রনাথ হলো তার মাধ্যম। অথচ রবীন্দ্রনাথই বিশ্বের একমাত্র কবি, যাঁর গান দু’টি স্বাধীন দেশের জাতীয় সঙ্গীত, ভারতে ও বাংলাদেশে। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতেরও সুর রবীন্দ্রনাথের। আমাদের একজন বাঙালি রবীন্দ্রনাথ থাকায় আমরা ঐশ্বর্যবান হলেও পাকিস্তানি শাসকদের কাছে তিনি জুজু হয়ে দাঁড়ালেন। সংস্কৃতি ভীতি তাদের রবীন্দ্রবিরোধী যেমন করেছিলো  আবার অন্য দিকে রবীন্দ্রনাথকে তারা দেখতো বাঙালি এবং হিন্দু হিসাবে। আর সেটাই রবীন্দ্রনাথের জন্য কাল হলো। শাসকদের চিন্তা কাজ করলো এমনভাবে যে রবীন্দ্রনাথকে মুছে ফেলা জরুরি। সে সময় এমন কথাও উঠলো  রবীন্দ্রসঙ্গীত নিজেদের লিখতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকলীন ভিসিকে এ ব্যাপারে চাপও প্রয়োগ করা হলো।

আমি যখোন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়েছি। যখোন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মমতার কাহিনী পড়েছি, যখোন বুদ্ধিজীবী হত্যার বীভৎসতা জেনেছি, ২ লক্ষ মা-বোনের উপর পাশবিকতার ইতিহাস পড়েছি। আমি যন্ত্রনায় কুকড়ে উঠেছি। খুনীদের নির্মমতায় প্রতিরোধে জ্বলে উঠতে চেয়েছি । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত- এটা যখোন গাওয়া হয় আমার মনে হয় এমন একটি বাংলাদেশের জন্য বিভিন্ন সময়ে যতো আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে তার শহীদেরা এ গানের সুরে উঠে দাঁড়ায়। আমার মনে হয় এ গানের সুধা তারাও শোনে। গানটি শুনলে বুক ভেসে যায় । এ গানটি সুর, কথা,আবেগ,আবেশ সব মিলে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মা, তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি এরকম শ্রুতিমধুর আবেগময় কথা পৃথিবীর কোনো জাতীয় সঙ্গীতে পাওয়া যাবে না। আমাদের জাতীয় সঙ্গীত এমনই যে, এ গানটি  পরিবেশন করলে বা শুনলে দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে- । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ - আমাদের  জাতীয় সঙ্গীত। বিশ্বে এমন আবেগময় সঙ্গীত আছে কি না আমার জানা নেই।

 এ গানটি জাতীয় সঙ্গীত করার ইতিহাস বলতে গিয়ে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুন বলেছেন, ১৯৫৬ সালে ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ থেকে আসা সংসদ সদস্যদের সম্মানে কার্জন হলে আয়োজন করা হয়েছিল অনুষ্ঠানের। উদ্যোক্তা ছিলেন গণপরিষদ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ সনজীদা খাতুনও ছিলেন আমন্ত্রিত শিল্পী। তিনি মঞ্চে আসার আগে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে তাকে বলা হলো ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইবার জন্য। কারণ তিনি চাইছেন পাকিস্তানিদের কাছে ‘সোনার বাংলা’র প্রীতি ও ভালোবাসার জানান দিতে। কিন্তু সনজীদা খাতুনের গানটি পুরো মুখস্থ ছিল না। সনজীদা খাতুনের ভাষ্যে,

    বেকায়দা হলো, কারণ অত লম্বা পাঁচ স্তবকের গানটি যে আমার মুখস্থ নেই। গীতবিতান-এর খোঁজ পড়ল। বই হাতে পেয়ে কোনওমতে অত বড় গানটি গেয়েছিলাম আমি। গানটি বাঙালিকে কতখানি আবেগ তাড়িত করে, সেইটি বোঝাবার জন্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিদেরকে গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিব। 

এরপর থেকে সনজীদা খাতুনসহ অন্য শিল্পীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাইতে থাকেন। এ গানকে যেন বঙ্গবন্ধু আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করে দিলেন।
১৯৬৭ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী ঢাকার নওয়াব বংশোদ্ভূত খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করে ঘোষণা দিল, ‘রবীন্দ্র সংগীত আমাদের সংস্কৃতি নয়।’ এর সমর্থনে এগিয়ে এলেন চল্লিশজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী নামধারী। যাদের মধ্যে শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, আইনজীবী, গায়কও রয়েছেন। বাইশে শ্রাবণ উপলক্ষে তিনদিন ধরে সকল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ অনুষ্ঠান আন্দোলনের রূপ ধারণ করে। গভর্নর মোনেম খাঁর পুত্র অনুষ্ঠান পণ্ড করার অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংস্কৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে এগিয়ে নেবার প্রেরণা যোগান। রবীন্দ্র সংগীতকে মর্যাদা দান ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তার প্রসার ঘটানোর জন্য সভা-সমাবেশে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন চালু করান। যার মধ্যে আমার সোনার বাংলা ছিল প্রধান। সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, ছিলেন যিনি এই আন্দোলনের মুখ্য সংগঠকের অন্যতম, তার উপলব্ধি,‘সাতষট্টির আন্দোলনের সব চাইতে স্থায়ী ফসল “আমার সোনার বাংলা” গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠা।’

 পাকিস্তানিদের রবীন্দ্র বিরোধীতা এমন আকার ধারন করলো যে রবীন্দ্র বিরোধিতার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা একাত্ম হলেন।  যে কারনে দিন দিন শক্তিশালী হলো পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথকে যত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলো রবীন্দ্রনাথ ততো শক্তিশালী হতে থাকলো।  তার গান ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলো হাটে , মাঠে ,বন্দরে। আন্দোলন সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথের গান। মুক্তির হাতিয়ার হলো রবীন্দ্রনাথের গান। একের পর এক পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন শুরু হলো আর সেসব আন্দোলনে সাংস্কৃতিক প্রেরনা যোগালো রবীন্দ্রসঙ্গীত। 


সত্তর সালের গোড়ায় বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী জাহিদুর রহিমকে দায়িত্ব দেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশের জন্য। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের রেকর্ড প্রকাশে ছায়ানটের শিল্পীরাও এগিয়ে আসেন। কলিম শরাফীর ব্যবস্থাপনায়, আবদুল আহাদের পরিচালনায়, সনজীদা খাতুনের বাসায় তাঁরই যত্ম-আত্তিতে খাটুনিতে তৈরি হয় গানটি। সম্মেলক কণ্ঠে ছিলেন, জাহিদুর রহিম, অজিত রায়, ইকবাল আহমদ, ফাহমিদা খাতুন,জাহানারা ইসলাম, হামিদা আতিক, নাসরীন আহমদ প্রমুখ। সর্বত্র বাজতে থাকে এই রেকর্ড। অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের কণ্ঠে এই গান ধ্বনিত হতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্পী কলিম শরাফী রমনা রেসকোর্সে লাখো লাখো জনতার উপস্থিতিতে সোনার বাংলাসহ রবীন্দ্রসংগীতের এক সেট গানের রেকর্ড উপহার দিয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে।

১৯৭০ সালে জহির রায়হান তার ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার করেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় দিকে দিকে বেজে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ভবিতব্য বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে জনগণ ‘আমার সোনার বাংলা’কে নির্বাচন করেছিল।  সে সময় পুরো পাঁচ স্তবকই গাওয়া হতো অনুষ্ঠানে।মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কেতনে আঁকা হলো রবীন্দ্র আলেখ্য। একাত্তরে পাক হানাদারদের বর্বরতার বিরুদ্ধে বাঙালির রক্তকে ফেনিয়ে তুলতে এবং স্বাধীনতার যুদ্ধে মৃত্যুর প্রতিরোধ ও জীবনের সংগ্রামে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল পাথেয় ও প্রেরণা।


স্বাধীনতার পর কেবিনেট ডিভিশনের সভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত অনুমোদন করা হয়। কেবিনেট সচিব  এইচ টি ইমাম ; টেলিভিশনের পক্ষে জামিল চৌধুরী সভায় আলোচনায় অংশ নেন। সভায় বঙ্গবন্ধু শোনেন যে, স্বরবিতানের ছাপানো সুরের সঙ্গে আমাদের শিল্পীদের গাওয়া সুরের মিল নেই। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘যে সুর গেয়ে এদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে সুরেই আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়া হবে, সেটিই জাতীয় সংগীতের সুর।’ পরবর্তীকালে জামিল চৌধুরী ‘শ্রোতার আসর রেকর্ড ক্লাব’ থেকে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় গীতির একটি এক্সটেনডেড প্লে (EP) রেকর্ড বের করেন। দু’টি পিঠে দু’টি গান। যুদ্ধের সময় মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে যে সুরে ‘সোনার বাংলা’ গেয়েছিলেন, সেই সুরেই রেকর্ডে গাওয়া হয়। সুচিত্রা মিত্রের গাওয়া সুরের অনুসরণে মুক্তিযুদ্ধের সময় গাওয়া সুরটি ধরে রাখার জন্য তা রেকর্ডে ধারণ করা হয়।বঙ্গবন্ধুর নিদের্শে কেবিনেট সচিব এইচ টি ইমাম জাতীয় সংগীতের স্বরলিপি সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। দায়িত্ব দেন শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলমান ছাত্র রবীন্দ্র স্নেহধন্য শিল্পী আবদুল আহাদকে।
মুক্তিযুদ্ধকালে সুচিত্রা মিত্র, ১৯৭১ সালের মে মাসে এইচ.এম.ভি. থেকে নতুন করে প্রকাশ করেন “আমার সোনার বাংলা” গানের রেকর্ড, যার নম্বর ৪৩৪১৫। যুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানটির যে রেকর্ড বাজানো হয়েছিলো তা কলিম শরাফীর ই.এম.আই.গ্রামোফোন কোম্পানি কর্তৃক রেকর্ডকৃত ছিল। একাত্তরের ৩রা এপ্রিল থেকে ২৫ মে পর্যন্ত শর্টওয়েভ ট্রান্সমিশনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়ে গানটি প্রচারিত হয়েছিল। চট্টগ্রামের রামগড়ে এই কেন্দ্র চালু ছিল। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে ব্যবহৃত গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের তৃতীয় পর্যায়ে প্রচারিত হয়েছিল।

বাংলাদেশে  রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে অনেক ত্যাগ, তিতিক্ষা, সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে। দীর্ঘ পরাধীন একটি পশ্চাত্পদ জাতিকে আত্মবোধনে উদ্বোধন করেছিল এ গান। তবে জাতীয় সঙ্গীতাকারে  ‘ সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি  সর্বযেত্দির প্নরচারিত হলেও জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত হওয়ার দিনটি  ছিল ৩ মার্চ,১৯৭১ ।র এইদিনে পল্টনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ অনুষ্ঠানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচিত করা হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র : যেভাবে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পেলাম
গ্রন্থনা: মীর শাহনেওয়াজ