• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ৮, ২০১৯, ০৩:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ৯, ২০১৯, ০৯:৪১ পিএম

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তবে মৃত্যুপথযাত্রী?

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তবে মৃত্যুপথযাত্রী?

 এখন উপাচার্যদের দলীয় সেবক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা আমরা প্রতিদিনই কমবেশি অনুভব করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে, সব সিদ্ধান্ত, নিয়োগ, পদোন্নতি, গবেষণার সুযোগ সব কিছুর পিছনে দলীয় রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। একই ব্যক্তি থাকছেন হলের দায়িত্বে, সিন্ডিকেটে এমনকি শিক্ষক সমিতিতেও। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্পর্ক হয়ে পড়ছে অনেকটাই শত্রুভাবাপন্ন।

কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টোন শহরের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠান দেখছিলাম। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েরাই। অনুষ্ঠানটি ছিল ড্রাগ কুইন শো। অনুষ্ঠান চলাকালীন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কলেজের প্রিন্সপাল এসেছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। সবই দেখলেন। প্রথম দিকের সারিগুলো সবই পূর্ণ। তিনি চুপিসারে পেছনের দিকে একজন ছাত্রের পাশে এসে বসলেন। সেই ছাত্রও তার দিকে তাকালো না। সে তখন গানের তালে তালে হাততালি দিচ্ছিল। কেউ উঠল না, এমনকি মাইকেও ঘোষণা করা হলো না। তিনি অন্য সব দর্শকের মতো অনুষ্ঠান দেখলেন এবং অনুষ্ঠান শেষে অন্য সব দর্শকের মতো পারফর্মারদের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন।

কোনো দেশের সঙ্গে কোনো দেশের তুলনা চলে না। তবু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জায়গাটির হয়তো একটুআধটু তুলনা চলে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ধারণাটি অনেক বড় এবং এর নানা ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তাই বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তুলনাটি আরো একটু গেঁথে যায় মনে যখন দেখা যায় যে এশিয়ার দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে নেই বাংলাদেশের একটিও বিশ্ববিদ্যালয়। ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এ তালিকায় মিয়ানমার ছাড়া প্রতিবেশী সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ই ঠাঁই করে নিয়েছে। টাইমস হাইয়ার এডুকেশন নামে লন্ডনভিত্তিক এই প্রকাশনাটি ২০১৯ সালের যে তালিকা দিয়েছে সেখানে এশিয়ার ৪০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রয়েছে। গত বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৫০টি। কিন্তু বাংলাদেশের অনুমোদিত ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটিও স্থান পায়নি এই তালিকায়। শুধু এই বছর নয়, দীর্ঘদিন ধরেই চলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মরণদশা। কিন্তু শিক্ষা এবং গবেষণা মানোন্নয়নে খুব বেশি ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং নিয়ে যখন এত হৈচৈ তখন আরেকটি প্রকাশিত সংবাদে চোখ আটকে গেল আর তা হলো বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৮,০৮৮.৪৯ কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকার অনুন্নয়ন এবং ২৯৯৯.০৩ কোটি টাকার উন্নয়ন বাজেট রয়েছে। বলা হয়েছে যে, বিগত বছরের তুলনায় অনুন্নয়ন বাজেট ১৪.৪৫% বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি অনুন্নয়ন বাজেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬৪.৬৫ কোটি টাকা এবং সবচেয়ে কম বাজেট সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩.৬০ কোটি টাকা। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমবারের মতো অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় এই যে বারবার গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের দাবি এলেও সমগ্র বাংলাদেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাত বরাদ্দপ্রাপ্ত হয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি টাকা। হিসাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার জন্য পাবে মাত্র এক কোটির মতো টাকা। অথচ রাস্তাঘাট, অফিস, দালান কোঠা বানানোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের থেকে গবেষণা বরাদ্দ বেশি দরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

গবেষণার এই দুরবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষকদের ক্ষমতার সেবক হওয়ার রাজনীতি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তবে বিভিন্ন সময়েই দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনেকের বিরুদ্ধেই এ ধরনের অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন উপাচার্যের আর্থিক দুর্নীতির জায়গাটা এতটাই প্রকট ছিল যে, উনাদের আপ্যায়ন বিলই ছিল লাখ লাখ টাকা। দুই-একটি বিশ্ববিদালয়ে তো এমনই অবস্থা; যে যায় লঙ্কায় সেই হয়ে যায় রাবণ। সেই উপাচার্যরা শুধু প্রশাসনিক দুর্নীতি নয়, অর্থনৈতিক দুর্নীতিতেও অদম্য। অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই করে এগুলোর সুরাহা হয়েছে এমন নজির কম। বরং প্রমাণিত হওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

উপাচার্য হলেই ভুলে যান যে তারা আসলে আগাগোড়াই শিক্ষক, উপাচার্য পদটি চলে গেলে আবারো চলে যাবেন সে শিক্ষকের কাতারে। এর আগে দাবিও উঠেছিল উপাচার্যদের মন্ত্রী পদমর্যাদার। মনে মনে ভাবি ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিকভাবে লোভনীয় বলেই হয়তো অনেকেই উপাচার্য হতে চান। সেজন্য হাইজাম্প, লংজাম্পের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন ক্ষমতাসীর দলের শিক্ষকরা। মজার বিষয় হলো, বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সহউপাচার্যদের যে কয়জনের সঙ্গে সহকর্মী হওয়ার সূত্রে আলাপ হয়েছে, তাদের মধ্যে খুব কমই বলেছেন তারা এই পদ চেয়েছেন। বেশিরভাগ শিক্ষকদের মুখেই একইরকম কথা শুনেছি। তারা এসব পদ-পদবি পছন্দ করেন না, সরকারের পক্ষ থেকে এসব পদ গ্রহণের জন্য বারবার অনুরোধ করা এবং সেসব অনুরোধ ফেলতে না পারার কারণে তাদের ‘এই অনুরোধের ঢেঁকি শুধু নয়, হয়তো আস্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয়ই গিলতে হচ্ছে’। এমনকি যারা দ্বিতীয় দফায় নিয়োগ পান, সামনাসামনি হলেই তাদের মুখে দেখা যায় অভিনয়ের বিরক্তি। মুখ এবং ভাব এমন করে রাখেন যে তারা কিছুতেই থাকতে চান না, কিন্তু সরকার নাছোড়বান্দা। উনাদের কিছুতেই ছাড়ছেন না। কিন্তু সবাই জানে এই পদগুলোতে যেতে কতটা তদবির করতে হয়, কতটা সরকারের কাছাকাছি থাকতে হয়, পৌঁছাতে হয়। শিক্ষকের পরিচয় মুছে দলীয় সেবক হওয়ার জন্য কতটা পরীক্ষা দিতে হয়। আর দ্বিতীয় দফা নিয়োগ বৃদ্ধির জন্য তো লাগে আরো তদবির। কারণ ততদিনে আরো কয়েক প্রার্থী তদবিরে পা বাড়িয়ে রাখেন।

শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে দেড় মাস ছুটি দেয়া হয়েছে মূলত তার ‘সম্মান’ রক্ষা করে তার মেয়াদ শেষ করার জন্য। অনিয়ম এবং অর্থনৈতিক অনৈতিকতার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপেক্ষাকৃত নবীন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধেও। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় একজন প্রার্থীর অপহরণ নিয়ে আলোচনায় আসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে মার্চের গোড়ার দিক থেকে আন্দোলন চলছিল গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের এক সহকারী অধ্যাপককে অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামেন সেখানকার শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ওই শিক্ষককে বিভাগের চেয়ারম্যানের পদ থেকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি দেয়। পাশাপাশি তাকে আট সেমিস্টারের একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। সেখানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল না তৈরি করেই তদন্ত কমিটির মাধ্যমে প্রশাসন সেটির সুরাহা করেন। তবে যৌন নিপীড়ন প্রমাণিত হলে সেই শিক্ষককে কেন চাকরিচ্যুত করা হয়নি সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ নীরব ছিলেন।

সাতটি বড় এবং পুরনো কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অধিভুক্তিটি ছিল বেশ অপরিকল্পিত। সেটির পেছনেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের মধ্যকার তিক্ত সম্পর্কই নাকি কাজ করেছে বলে অনেকের অভিমত। তবে ভুক্তভোগী যে শিক্ষার্থীরাই সেটি আমরা সাদা চোখেই দেখতে পাচ্ছি। এখন উপাচার্যদের দলীয় সেবক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা আমরা প্রতিদিনই কমবেশি অনুভব করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে, সব সিদ্ধান্ত, নিয়োগ, পদোন্নতি, গবেষণার সুযোগ সব কিছুর পিছনে দলীয় রাজনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে। একই ব্যক্তি থাকছেন হলের দায়িত্বে, সিন্ডিকেটে এমনকি শিক্ষক সমিতিতেও। শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্পর্ক হয়ে পড়ছে অনেকটাই শত্রুভাবাপন্ন। একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়েই শেষ করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ পাঠ।

শিক্ষক রাজনীতি এখন আদর্শিক না হয়ে হয়ে পড়েছে লাভ আর লোভের রাজনীতি। দলীয় শিক্ষকদের সম্পর্ক শিক্ষার্থী আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে খুব বেশি নেই যতটা আছে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে। তাই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও হয়ে পড়েছে অনেকটাই নুয়ে শুকিয়ে যাওয়া গাছ আর কৃষকের মতো। উভয়েই টিকে আছে, তবু দেখে মনে হবে কেউ কারো সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

   লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।