• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১২, ২০১৯, ০৪:৫৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১২, ২০১৯, ১১:০৩ পিএম

রাজনীতির উন্নতি হলে জাতির উন্নতি হবে 

রাজনীতির উন্নতি হলে জাতির উন্নতি হবে 

কোনো জাতির প্রত্যেক ঐতিহাসিক কালের সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট প্রকাশ ঘটে সেই জাতির রাষ্ট্র গঠন ও রাজনীতির মধ্য দিয়ে যেমন, তেমনি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আমরা রাজনৈতিকভাবে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে না পারলেও অনৈক্যের মধ্যে জনসমষ্টি রূপে অস্তিমান আছি। রাষ্ট্র যথেষ্ট পরিমাণে গড়ে তোলা না হলেও আমাদের দেশ আছে।

 জাতি হয়ে ওঠার ও রাষ্ট্রগঠনের সম্ভাবনা ও সুযোগ আমাদের আছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান দিক দিয়ে আমাদের আছে বিরাট অগ্রগতি। সকল বিষয়েই প্রচুর গবেষণা হচ্ছে এবং অনেক অনেক বই প্রকাশিত হচ্ছে। নতুন নতুন চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যেরও অন্ত নেই। আছে- সংগীত, নাট্যকলা, সিনেমা, নৃত্যকলা। এসবের গুণগত দিক সম্পর্কে মন্তব্য করা দুঃসাধ্য। কারণ সমালোচনা নেই, ভালো-মন্দের বিচার নেই- ভালো-মন্দের পার্থক্যজ্ঞানও যেন লোপ পেয়েছে। চিত্রকলা, সংগীত, নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, গবেষণা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ইত্যাদিতে যা কিছু উৎকৃষ্ট, সেগুলোর উৎকৃষ্টতা কোনো কোনো সুযোগ্য সমালোচকের মাধ্যমে চিহ্নিত হলে অনেক কিছু বোঝা যেত এবং তাতে উৎকৃষ্ট নতুন সৃষ্টির পথ সুগম হত। ঢাকা কেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে বড় কোনো সমালোচক আত্মপ্রকাশ করেননি।

গবেষণার ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের অন্ধ অনুকরণ ও অনুসরণ। স্বাধীন বাংলাদেশে পাশ্চাত্য ‘প্রগতিশীল’ মহান ভাবধারার প্রতি আগ্রহ দুর্লভ। শূন্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে,  ইত্যাদি বলে ক্ল্যাসিকের ও আদর্শের প্রতি প্রদর্শন করা হয় অবজ্ঞা। সমগ্রের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল অংশের দিকে, সাধারণের  দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল বিশেষের  দিকে দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।

বাংলা সাহিত্যে ১৯২০-এর দশক থেকে আধুনিকতাবাদ  ক্রমে কর্তৃত্বশীল অবস্থান দখল করে নিয়েছে। তার উপর ১৯৮০-র দশক থেকে অনুশীলিত হচ্ছে উত্তরাধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদ সীমাবদ্ধ ছিল সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে, উত্তরাধুনিকতাবাদ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের সকল বিষয়কেই নিজের মধ্যে টেনে নিয়েছে। আধুনিকতাবাদের কার্যকর সমালোচনা আছে আবু সয়ীদ আইয়ুবের আধুনিকতা ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ দু’টিতে। বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সেকালের অনেক লেখক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখার গবেষণায় এবং সাহিত্যক্ষেত্রে উত্তরাধুনিকতাবাদের দেখা যাচ্ছে বিচার-বিবেচনাহীন আগ্রহ ও নির্বিচার অনুগামিতা।

 বিচারমূলক প্রবণতা দুর্লভ। লক্ষ্য করা দরকার যে, আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ আত্মপ্রকাশ করেছে কাউন্টার-রেনেসাঁস রূপে। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে উন্নত বিষয় কার্যকরভাবে গ্রহণ করার মধ্যেও সৃষ্টিশীলতা থাকে। অনুকরণ-অনুসরণ আর সৃষ্টিশীল উপায়ে গ্রহণ এক নয়।যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে দরকার বিবেকবান চিন্তাশীল লেখক-শিল্পীদের ঐক্য। দরকার তাঁদের চিন্তার ও কর্মের স্বতন্ত্র কেন্দ্র ও সংগঠন। দরকার নতুন রেনেসাঁসের জন্য একটি বৌদ্ধিক আন্দোলন। সত্যসন্ধ ন্যায়নিষ্ঠ স্বাধীন চিন্তাশীলতা অবলম্বন করে প্রগতির ও সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কর্মতত্পর হওয়া দরকার।

 নতুন প্রযুক্তির অভিঘাতে সৃষ্ট নতুন বাস্তবতায় সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রগতি সম্পর্কে উপলব্ধির আমূল পুনর্গঠন দরকার। কেবল ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে প্রগতির ধারণাকে সীমাবদ্ধ রাখা একটুও সমীচীন নয়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশের জন্য দরকার নতুন রেনেসাঁসের স্পিরিট নিয়ে দূরদর্শী কার্যক্রম। বাইরের জগত থেকে গ্রহণ করতে হবে নিজেদের সত্তায় থেকে, আত্মসত্তা বিসর্জন দিয়ে নয়।

নিকৃষ্ট রাজনৈতিক দলের হীন-স্বার্থান্বেষী লেজুড়বৃত্তি দ্বারা লেখক-শিল্পীদের কোনো উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় প্রকাশ পায় না। দলীয় গন্ডির বাইরে সর্বজনীন ও বিশ্বজনীন কল্যাণের এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, যেগুলোকে দল-মত নির্বিশেষে সকলেরই সর্বোচ্চ মূল্য দেয়া কর্তব্য। সেগুলোকে বুঝতে না পারলে, মূল্য না দিলে জাতির সংস্কৃতি বিকারপ্রাপ্ত হয়-প্রাণশক্তি নষ্ট হয়ে যায়। জাতীয়তাবোধ, জাতীয় সংস্কৃতি, জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় স্বার্থ তেমনি একটি বিষয়। জাতীয়তাবাদের সঙ্গে দরকার জাতীয়তাবাদের সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ। উপনিবেশবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ হল জাতীয়তাবাদের বিকার।

 নতুন রেনেসাঁস, নতুন সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রগতির প্রয়োজনে সকল গণবিরোধী মতবাদ ও সকল গণবিরোধী শক্তিকে দমন রাখতে হবে।
 জাতির অন্তর্গত সকল জনগোষ্ঠীর ও সকল স্তরের জনগণের সার্থক যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে এবং জাতীয় ঐক্যকে নিশ্চিত করে জাতীয়তাবাদকে সফল করতে হবে। যাঁরা সততার সঙ্গে চলতে চান তাঁদের চলার সুযোগ আইন-কানুনের দ্বারা অবারিত রাখতে হবে। সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অনুসন্ধিৎসাকে এবং মানবিক গুণাবলিকে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হবে। 

জনগণের উপর অপশক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হলে, জাতিকে বিভক্ত করে অনৈক্যের মধ্যে রাখা হলে, জনগণ বিভক্ত থাকলে রাষ্ট্র অচল হয়ে পড়ে, রাষ্ট্রের উপর বিদেশি শক্তির কর্তৃত্ব কায়েম হয়, রাষ্ট্র পরাধীন হয়ে যায়। জাতির ইতিহাসে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করা হলে, ইতিহাসকে বিকৃত করা হলে জাতির আত্মাই বিকৃত হয়ে যায়।অর্থ-বিত্ত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে যারা পিছিয়ে আছে, যারা মোট জনসংখ্যার শতকরা নব্বইভাগ, যারা উৎপাদনশীল, সেই শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত কথিত উদার গণতন্ত্রে দারুণভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিত প্রতারিত। সব দিক দিয়েই তারা দুরবস্থায় আছে।

 নতুন প্রযুক্তির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে তাদের খাওয়া-পরার অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কিন্তু শ্রমজীবীরা কঠোর শ্রমের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সামাজিক ন্যায় ও মানবিক দিক লক্ষ্য করলে দেখা যায় তাদের অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবনপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের বিলুপ্তের পর পৃথিবীর সর্বত্রই তারা আগের চেয়ে বেশি নির্যাতিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হচ্ছে। যারা মুক্তিমান, বিত্তবান, বিদ্বান, সর্বসাধারণের প্রতি তাদের সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ কমে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক বৈষম্য ও বিষুক্তি  বাড়ছে।

সাধারণ মানুষ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ও প্রতিকার চাওয়ার সাহস হারাচ্ছে। উদার গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষ শাসক শ্রেণির লোকদের উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্র হয়ে আছে।বাংলাদেশে সব কিছু কেন্দ্রীভূত হচ্ছে রাজধানীতে, গ্রাম নিদারুণ বঞ্চনার শিকার। প্রান্তিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে দূরে সরিয়ে, বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। চলমান দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ও নারীবাদী আন্দোলনের কালে দুর্নীতি ও নারীনির্যাতন কমছে না, বাড়ছে। মৌলবাদ-বিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় শক্তি প্রবল হচ্ছে, এবং পরিত্যক্ত ও পুরাতন সংস্কার বিশ্বাস পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। দেখা দিয়েছে জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড।

 জাতীয় পর্যায়ে জনগণের রুচি-পছন্দ ও চিন্তা-চেতনার মান উন্নত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের ও তাদের দেশীয় অনুসারীদের স্বার্থসিদ্ধির অনুকূল। সামাজিক ন্যায় বিচার কমতির দিকে হওয়ার ফলে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, হত্যা-আত্মহত্যা বাড়ছে, হিংসা-প্রতিহিংসা বাড়ছে, অনাস্থা ও হতাশা বাড়ছে, সংস্কৃতি অপসংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হয়ে চলছে।

বাংলাদেশে ষোল কোটি মানুষের জীবনযাত্রা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, উন্নতির আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ ও প্রকৃতি, সামাজিক সংহতি ও বিষুক্তি, উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা, প্রগতিশীলতা ও রক্ষণশীলতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করলে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির যে পরিচয় প্রকাশ পায়, তা সুস্থ, স্বাভাবিক নয়; তা রুগ্ন, ব্যাধিগ্রস্ত, বিকারপ্রাপ্ত। এই সংস্কৃতিকে সুস্থ, স্বাভাবিক ও প্রগতিশীল করে তোলার জন্য জাতীয় জীবনে নতুন সংকল্প, নতুন চিন্তাধারা ও নতুন কর্মধারা দরকার। 

জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টিতে নতুন প্রাণশক্তি দরকার। দরকার নতুন সাংগঠনিক আয়োজন ও নতুন নেতৃত্ব। দরকার বাংলাদেশের প্রতিটি নর-নারীর সংস্কৃতি-সচেতনতার কার্যকর সুষ্ঠু বিকাশ। কেবল রাজনীতি দিয়ে হবে না, দরকার প্রগতিশীল নতুন শিল্প, সাহিত্য, জ্ঞান ও বিজ্ঞান। চিন্তাধারা পরিবর্তনের আন্দোলন। রাজনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরস্পর সম্পূরক।

আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতি নিয়ে মতপার্থক্য থাকবে, তা স্বাভাবিক। তবে সকল পক্ষকেই তথ্যনিষ্ঠ ও সত্যাসন্ধ হতে হবে। মতপার্থক্যের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এবং জাতীয় ঐক্যের ও জাতীয় উন্নতির মনোভাবও অবশ্যই থাকতে হবে। এক পক্ষ সব সময় অন্য পক্ষকে শেষ করে দেয়ার চেষ্টায় থাকলে শেষ পর্যন্ত তার ফল বিজয়ী ও পরাজিত উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর হবে। জাতীয় জীবনে বিরোধের উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে সম্প্রীতির, ঐক্যের ও সংহতির উপাদানও। 

এ অবস্থায় বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কিংবা বহুত্বমূলক সমন্বয়ের নীতি কার্যকর করতে হবে। সবাই এক রকম চিন্তা করবেন, তা ভাবা বাস্তবসম্মত নয়। প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল ধারা থাকবে। বাংলাদেশে চলমান ধারাগুলোর মধ্যে যে দৃষ্টিভঙ্গি, যে চিন্তা-চেতনা ও কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে তাতে সুস্থতা নেই, স্বাভাবিকতা নেই, তথ্যনিষ্ঠা নেই, সত্যাগ্রহ নেই। 

যাঁরা সততার সঙ্গে চিন্তা করবেন এবং সৎভাবে কাজ করতে চাইবেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই কর্তব্য অবস্থার উন্নতির জন্য জাতীয় সংস্কৃতি নিয়ে, জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে, জাতীয় সংহতির উপায় নিয়ে মোহমুক্ত, জেদাজেদিমুক্ত, সঙ্কীর্ণতামুক্ত, ইতিহাসসম্মত, কর্মমুখী চিন্তায় অগ্রসর হওয়া। উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধ কমলে এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যের এবং রাজনীতির উন্নতি হলে বলা যাবে যে জাতি উন্নতির ধারায় চলছে।

লেখক : রাষ্ট্রচিন্তক ও সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়