• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১৮, ২০১৯, ০৫:১৪ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৮, ২০১৯, ০৫:১৪ পিএম

আসন্ন বাজেট ও উন্নয়ন

আসন্ন বাজেট ও উন্নয়ন

শিক্ষাক্ষেত্রের বহিরাঙ্গনে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে মানতে কোনো দ্বিধা নেই। যত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও নানা পর্যায়ের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা কল্পনাতীত। ছাত্র সংখ্যাও অবিশ্বাস্য হারে বেড়েছে। কিন্তু এর পরেও শিক্ষার উন্নয়ন ঘটছে বা ঘটেছে এমন দাবি করা যাবে কি? বস্তুত শিক্ষার উন্নয়ন বলতে বোঝায় শিক্ষার মানোন্নয়ন। সেই ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর অবিশ্বাস্য রূপে পিছিয়ে আছি এবং এগুলোর বিন্দুমাত্র লক্ষণও চোখে পড়ছে দেখে আতঙ্কিত বোধ করি।

২০১৯-২০২০ সালের বাজেট আসন্ন জুন অধিবেশনে পাস করা হবে এবং জুলাই থেকে তা কার্যকর হওয়ার কথা। এ কথা ভাবাই যায়, খসড়া বাজেট প্রণয়ন কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে এবং এখন হয়তো তার ঝাড়াই-বাছাই চলছে। আসন্ন ঈদুল ফিতরের অব্যবহিত পরেই সম্ভবত জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই অধিবেশন শুরু হবে। অতীতে কয়েকবার লিখেছি দেশে উন্নয়ন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তা নেহাতই অসম। অসম উন্নয়নের দ্বারা দেশের সামান্য কিছু মানুষ উপকৃত হতে পারেন কিন্তু সব এলাকার মানুষের ভাগ্যে সে উন্নয়ন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না, পারে না সমভাবে তার ফলভোগ করতে। সুতরাং সুষম উন্নয়ন ও সম্পদের সুষম বণ্টনের পথে যাত্রা শুরু করা জরুরি প্রয়োজন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারও তাই। কিন্তু কোনো এক দুঃসহ কারণে, বাজার অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে সম্পদের অসম বণ্টন-ব্যবস্থার ফলে ঢাকা শহরে কতই না জৌলুসপূর্ণ বিশ তলা, পঞ্চাশ তলা, শত তলাবিশিষ্ট প্রাসাদোপম দালান-কোঠা হরহামেশাই নির্মিত হচ্ছে কিন্তু দরিদ্রজনদের জন্য ফুটপাতও জুটছে না। 

আবার জেলাওয়ারিভাবে দেখলে দেখা যায়, কোনো কোনো জেলায় ব্যাপক উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু বেশির ভাগ জেলায় তা না হয়ে এক চরম বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা জেঁকে বসছে। তেমনই নিষ্ঠুর বৈষম্যের শিকার পাবনা জেলা। যদিও উত্তরবঙ্গের সব জেলাকেই প্রায় বৈষম্যের শিকার বলে অভিহিত করা যায়। এই বৈষম্য দূর করে সুষম উন্নয়ন বিধান করা কিছুটা কঠিন বলে মনে হলেও তা আদৌ অসম্ভব কিছু না। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। একের পর এক জেলা-উপজেলা-বিভাগ তৈরি করা অযৌক্তিক এবং জনস্বার্থবিরোধী হলেও আমরা দিব্যি তা করে চলেছি। নিবন্ধটির পরিসরের কথা ভেবে পাবনার উন্নয়ন নিয়ে জনগণের দীর্ঘদিনের সর্বসম্মত দাবিগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরতে চাই বাজেটকে সামনে রেখে। বিস্ময়কর হলো, দাবিগুলো দীর্ঘদিনের হলেও তার প্রতি আজও প্রায় নজর দেয়া হয়নি।

 রেল যোগাযোগ। এই দাবিটির বাস্তবায়ন হলে যে বহুমুখী সম্ভাবনার দুয়ার উন্মুক্ত হবে তাতে গোটা দেশের মানুষই উপকৃত হবে। সেই ইংরেজ আমলে কলকাতার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের স্বার্থে কলকাতা থেকে ঈশ্বরদী-সান্তাহার-পার্বতীপুর রেলপথটি নির্মিত হয় তবে তা বহুমুখী উপকার সাধন করে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের। সিরাজগঞ্জে কাগজকল প্রতিষ্ঠার পর ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেলপথটি নির্মিত হলেও তাতে বিশাল এলাকার চাষিরাও উপকৃত হতেন। ওই এলাকা মাছ, দুধ, ডিমের ব্যাপক উৎপাদনের ফলে সেগুলো রোজ কলকাতায় চালান দিয়ে কৃষকদের ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন সাধনে তা সক্ষম হয় যদিও এগুলোর বৃহৎ ব্যবসায়ীরা উৎপাদকদের তুলনায় অনেক বেশি লাভবান হন। নানা কাজে এক স্থান থেকে সস্তায় অন্য স্থানে যাওয়ার সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এতে উপকৃত হতেন মাত্র ৫-৭ টি গ্রামীণ উপজেলার মানুষ, সব এলাকার জনগণ নন।

 তাই দাবি, ঈশ্বরদী থেকে পাবনা শহর দিয়ে আতাইকুলা-মাধবপুর-বনগ্রাম-দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মিত হোক। মাঝখানে যমুনা নদীতে আরও একটি সেতু নির্মাণ করে আরিচা ঘাটের সঙ্গে সংযুক্ত করে একেবারে আরিচা-ঢাকা রেলপথ নির্মাণ করে সমগ্র উত্তরবঙ্গের বিশেষ রাজশাহী বিভাগের সব জেলার মানুষের জন্য নানা কাজে, (চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি) স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক। এই দাবি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলে ইতিবাচক উদ্বোধন হলেও তার হত্যালীলার পর প্রকল্পটি হিমঘরে পাঠানো হয়। অতঃপর বছর দশেক আগে ব্যাপক সংশোধনী এনে ওই প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তাতে অগ্রগতি ঘটেছে সামান্যই। ঈশ্বরদী থেকে পাবনা এবং পাবনা থেকে রাজশাহী পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করার পর একটি মাত্র ট্রেন, পাবনা এক্সপ্রেস নামে, দিনে একবার মাত্র পাবনা রাজশাহী রুটে যাতায়াত করতে পারা যাচ্ছে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর এ অগ্রগতিকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও পাবনার পূর্ব বর্ণিত মৌলিক দাবিটি কত শতাব্দীতে পূরণ হবে তা গবেষণাসাপেক্ষ।

সুচিত্রা এক্সপ্রেস

এ প্রসঙ্গে মানুষের জরুরি দাবি, পাবনা থেকে যমুনা সেতু দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত সুচিত্রা সেন স্মরণে 'সুচিত্রা এক্সপ্রেস' নামে অবিলম্বে একটি নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হোক। অন্যপক্ষে মূল প্রকল্প থেকে সরে গিয়ে দুই সাবেক মন্ত্রী পাবনা থেকে সুজানগর-আমিনপুর-কাশীনাথপুর- বেড়া হয়ে রেলপথ টেনে নিয়ে মানিকগঞ্জের কোনো একটি স্থানের সঙ্গে ফেরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এই সংশোধিত রেলপথ নির্মিত হলেও তা বাণিজ্যিক সফলতা পাবে না বরং মূল যে পরিকল্পনাটি পাবনা-আতাইকুলা-মাধবপুর-বনগ্রাম, দুলাই-কাশীনাথপুর-নগরবাড়ি পথটি নির্মিত হলে তা স্পল্পতর ব্যয়সাধ্য হবে এবং বাণিজ্যিক সফলতাও নিশ্চিত হবে। তাই অবিলম্বে নগরবাড়ি পর্যন্ত আতাইকুলা হয়ে রেলপথ ও নগরবাড়ি পাটুরিয়া সেতু ( রেল ও বাস চলাচল উপযোগী) নির্মাণ করে এবং অতঃপর পাটুরিয়া- ঢাকা রেলপথ নির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রকল্প অনুমোদন করে আসন্ন বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে জাতীয় অর্থনীতি যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃত হবে এবং বর্তমান যমুনা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী নানাবিধ পরিবহনের চাপও অনেক কমবে।

এবারে আসি ইছামতী নদী উদ্ধার প্রসঙ্গে  

এই দাবিটিও দীর্ঘদিনের নদীটি পদ্মা থেকে উৎপত্তি হয়ে পাবনা শহর দিয়ে সদর উপজেলা, সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় গিয়ে হুড়া সাগর তথা যমুনাতে গিয়ে পড়েছে। আমাদের ছোটবেলায় এই নদী বর্ষাকালে বিশাল ও স্রোতস্বিনী রূপ ধারণ করত, শহর ও গ্রামের বহু আবর্জনা বয়ে নিয়ে গিয়ে শহর গ্রাম পরিষ্কার করত, বেড়া-পাবনা নৌ চলাচল এবং পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখত। কিন্তু ইংরেজ আমলে শিতলাই জমিদারিদের বিশাল অট্টালিকা পদ্মার ভাঙনের কবলে পড়ার উপক্রম হলে পদ্মা ও ইছামতীর সংযোগস্থলে একটি মজবুত বাঁধ নির্মাণ করায় এখন আর বর্ষাতে পানি আসে না এক ফোঁটাও। যমুনা নদীর সংযোগস্থলেও বিশাল চর উঠে যমুনার জলও ইছামতীতে আর ঢুকতে পারে না। ফলে নদীটি শুকিয়ে ক্ষীর্ণকায় হয়ে পড়েছে। ভূমিগ্রাসীরাও অবৈধ কাগজপত্র তৈরি করে ইছামতীর উভয় পাশে বিশাল বিশাল দালানকোঠা তুলে নদীটির অস্তিত্বকেই হুমকিতে ফেলেছে। এখন ইছামতী একটি সরু খাল মাত্র। তাই সিএস খতিয়ান অনুযায়ী ইছামতী নদীর সীমানা নির্ধারণ এবং ওই সীমানার মধ্যে নির্মিত সব প্রকার স্থাপনা অবৈধ হওয়ায় তা ভেঙে ফেলে দ্রুত সব এলাকা দখলে নিয়ে নদীটির ব্যাপক খননকার্য করে তার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও গভীরতা নিশ্চিত করে পদ্মার মুখে নির্মিত বাঁধ ভেঙে ফেলে পদ্মার জলপ্রবাহ ইছামতী দিয়ে আগের মতো প্রবাহিত করতে হবে পরিবেশ, নৌ-চলাচল, সেচকার্য প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ পুনরায় চালু করার উদ্দেশ্যে। এতে যেমন কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়বে, তেমনই আবার বিপুলভাবে বাড়বে মৎস্য উৎপাদন।

এ প্রকল্প ইতোমধ্যেই গৃহীত হয়েছে বলে শুনি। যদি তা হয়ে থাকে তবে বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন, যাতে জুলাই আগস্ট বা বর্ষা থেকেই ড্রেসিং শুরু করা যায়। তার আগে নানাবিধ স্থাপনা ভেঙে ফেলার কাজ এক্ষুনি শুরু করা প্রয়োজন। ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় পাবনার মানুষের এই দাবিটি পূরণে কোনো অজুহাতেই যেন আর বিলম্ব করা না হয়।

স্বাস্থ্য

সমগ্র উত্তরবঙ্গজুড়েই কোটি কোটি মানুষ স্বাস্থ্য-চিকিৎসাসংক্রান্ত সমস্যায় সেই আদ্যিকাল থেকে ভুগে চলেছেন। আজ এই একবিংশ শতাব্দী যখন প্রায় তার মধ্যগগনে উঠতে চলেছে, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা যখন সারা বিশ্বেও সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখছে, চিকিৎসাসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা সহজলভ্য করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে তখন পাবনার সরকারি হাসপাতালগুলোতে আসন সংখ্যার তীব্র অভাব, হাসপাতালের ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন করা ওষুধ হাসপাতালে না পাওয়া, ডাক্তার-নার্সের মারাত্মক স্বল্পতা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভয়াবহ দুষ্প্রাপ্যতা- এই সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটি এমনই যে, যে কোনো রোগীকেই সামান্য যে কোনো রোগের চিকিৎসার জন্যই ছুটতে বাধ্য হন ঢাকায়। অবশ্য যদি সেই রোগীর বা তার অভিভাবকদের সামান্যতম সচ্ছলতা থাকে। ঢাকায় দৌড়াতে হয়।

রোগীকে ঢাকায় নিয়ে গেলেও ভর্তি করা এক দুঃসহ ব্যাপার যেন একটি যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়। আসন সংখ্যার স্বল্পতার কারণেই এমনটি ঘটে থাকে এবং সেই সুযোগে ভর্তির ক্ষেত্রে অনেক দুর্নীতির অভিযোগও শোনা যায়। সাধারণত ভর্তি হতেই সপ্তাহখানেক লেগে যায়, যদি সেই রোগী বা তার অভিভাবকদের উপরতলায় প্রভাবশালী কারও সাথে প্রভাব না থাকে। এভাবে সঙ্গতিসম্পন্ন রোগীরা তাদের চিকিৎসা সুবিধার্থে আদায় করে নিতে পারলেও বেশির ভাগ রোগীই চিকিৎসা নিতে না পেরে চরম ভোগান্তির মধ্যে দিন কাটাতে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতি আর কতকাল? পাবনাতে সরকারি জেনারেল হাসপাতালটিকে কমপক্ষে ১০০০ বেডে উন্নীতকরণ, সব বিভাগে উপযুক্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ, চিকিৎসকদের শূন্য আসনগুলো পূরণ, নার্সদের সংখ্যা স্বল্পতা দূরীকরণ অবিলম্বে করা প্রয়োজন। আমরা যেন ভুলে না যাই, স্বাস্থ্য একটি মৌলিক অধিকার এবং এ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা সব নাগরিকই প্রয়োজন অনুযায়ী পেতে অধিকারী- এটি আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ আছে। সেই অধিকার কার্যত হরণ করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি না করে। এদিকে লক্ষ্য দিয়ে সমস্যাগুলো দূর করাও অনুরূপভাবে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্বের অন্তর্গত।

দেহের ওজনের চেয়ে অনেক বেশি অনবরত পরীক্ষা নেয়ার নামে ছেলেমেয়েদের আটকে রেখে, জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার প্রতিযোগিতার সঙ্গে সঙ্গে অধিক সংখ্যায় পাস করানো হলেও মানের অবনতি ভয়াবহ। উচ্চতর শিক্ষার ফলাফলের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হবে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, হাজী মো. মহসীন, বেগম রোকেয়ারা শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছেন- এটিও কম শঙ্কার কথা নয়। তাই এদিকে নজর দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো হোক।

  লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক