• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০২:২২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৫, ২০১৯, ০২:৩০ পিএম

কুমারী পূজা ও যুগভাবনা 

কুমারী পূজা ও যুগভাবনা 

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষে বিশ্বসভ্যতা উচ্চ থেকে উচ্চতর সোপানে আরোহণ করছে। চিন্তায় ও গবেষণায় নিয়ত উন্মোচিত হচ্ছে নতুন দিগন্ত। বিভিন্ন বিষয়ে সংযোজিত হচ্ছে স্পেশালিটি, সুপার স্পেশালিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অকৃত্রিমভাবে বিভিন্ন কাজ সাফল্যের সাথে সম্পাদন করছে। বিশ্বায়নের ফলে প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবন বেড়েছে। জীবন যাত্রায় এসেছে উন্নয়ন, বৈচিত্র ও গতি। ইন্টারনেট, ফেইসবুক এখন আমাদের জীবন ও সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। বিষয়ের ভালমন্দ অনেক সময় নির্ভর করে ব্যবহারের তারতম্যের উপর। আগুনে আহার্য রান্না হয়, আবার হাত পুড়ে যেতে পারে এর অসংযত ও অসতর্ক ব্যবহারে। বহিঃপ্রকৃতিকে জয়ের পাশাপাশি অন্তঃপ্রকৃতিকেও নিয়ন্ত্রন করা অবশ্য কর্তব্য প্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহারের জন্য। 

প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে সভ্যতার পথ চলাকে মসৃণ রাখতে আন্ত:মানবিক সম্পর্ক, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ও চর্চ্চা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সুশীল সমাজ। মূলবোধের অবক্ষয় থেকে উদ্ভূত অনৈতিকতা, অসম্প্রীতি, অসহনশীলতা ইত্যাদি সামাজিক ব্যাধি বিশেষতঃ মাতৃজাতির অবমাননা যে কোন বিবেকবান মানুষকে উৎকন্ঠিত করে। শরীর যেমন আছে রোগজীবাণু আছে, রোগ আছে, রোগের প্রতিকার আছে; কম্পিউটার প্রোগাম আছে, ভাইরাস আছে, এন্টিভাইরাস আছে। সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ মনে করেন ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, দর্শন, এবং মহাপুরুষগণের ব্যবহার, জীবন ও উপলব্ধি বিভিন্ন সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

গিরীশ ঘোষ শ্রীরামকৃষ্ণের পরম ভক্ত; শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আসার পূর্বে অত্যন্ত দুরাচারী ছিলেন। কিন্তু তাঁর ছিল অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা। শ্রীরামকৃষ্ণ তার পাপ কাজ সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু এ সম্পর্কে তাঁকে কিছু বলতেন না। তার গুণটি দেখতেন। গিরীশ নিজের সম্পর্কে  নিজেই বলতেন- এমন পাপ কাজ নেই যে আমি করিনি। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণ আমাকে কখনো বলেন নি- তুমি এটা ছাড়, ওটা ছাড়। তিনি শুধু তাকে উচ্চ আদর্শ দেখিয়ে দিয়েছেন। আলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিয়েছেন। আলোর উপস্থিতিতে যেমন অন্ধকার পালিয়ে যায়, তেমনি আপনা আপনি খারাপ ভাব দূরীভূত হয়েছে। 

পূজা, উপাসনা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শেরই স্থলরূপ। দুর্গাপূজা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম পূজা; ঈশ্বরকে জগজ্জননীরূপে বা মাতৃভাবে উপাসনা। কুমারী পূজার বিশেষত্ব কোথায়? কুমারী পূজা কাঠ, মাটি বা পাথরের প্রতিমা, অথবা কোন প্রতীকের সাহায্যে উপাসনা নয়। চেতন কুমারীতে চৈতন্যময় ঈশ্বরের উপাসনা। জগজ্জননীকে কুমারীরূপে পূজা করতে হবে কেন? কুমারী ও কুমারী পূজা সম্পর্কে  শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন ভক্তের সংশয় দূর করে এবং তাকে ভক্তিপথে সঠিক গন্তব্যে পরিচালিত করে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেনÑÑ“সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক-একটি বিশেষ রূপ। শুদ্ধসত্ত¡ কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ বেশী।” প্রেমাস্পদ জননীর যেখানে বেশী প্রকাশ সেটিই ভক্তের পূজা ও উপাসনার শ্রেষ্ঠ প্রতিমা হবে- এটা বলাই বাহুল্য।

সাধারণত দুর্গাপূজার অষ্টমীতে কুমারী পূজা করা হয় তবে, শাস্ত্রমতে সপ্তমী, নবমীতেও করা যেতে পারে। এক থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প বালিকাদের কুমারী পূজার জন্য নির্বাচন করা হয়। বয়সভেদে কুমারীর বিভিন্ন নাম, যেমন - সন্ধ্যা (১), সরস্বতী (২)..সুভগা (৫)......অম্বা (১৬)। কুমারীকে সুসজ্জিত করে, বিধিমোতাবেক নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে পাদ্য, অর্ঘ্য, ধূপ, দীপ, গন্ধ, পুষ্প, নৈবেদ্য, বস্ত্রালংকার ইত্যাদি ষোড়শোপচারে বাহ্যপূজা করা হয়। আবার হৃদয়ে ধ্যানের মাধ্যমে মানসপূজাও করা হয়। ভক্তের কাছে কুমারী সমগ্র নারী জাতির প্রতিভূ, জগজ্জননীর স্পষ্টভাবে প্রকাশিত রূপ। পূজা ও উপাসনায় চিত্ত শুদ্ধ হয়। ভক্তের উদ্দেশ্য শুদ্ধসত্ত¡ হওয়া; হৃদয়ে ও সর্বত্র করুণারূপিণী মাকে উপলব্ধি করা। কুমারী পূজা ‘মাতৃভাব’ সাধনার অন্যতম উপায়। কুমারী পূজা হচ্ছে সেই আদর্শ বা ভাবের প্রতিরূপ যা আমাদের পরমসত্য লাভে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে এবং নারীর প্রতি আমাদের যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে প্রকৃত অনুপ্রেরণা যোগায়। 

স্বামী বিবেকানন্দ ১৩০৮ সালে বেলুড় মঠে প্রথম দুর্গাপূজায় নয়জন অল্পবয়স্কা কুমারীকে পূজা করেন। কাশ্মীর ভ্রমণকালে এক মুসলিম মাঝির শিশুকন্যাকেও পূজা করেন। সমাজের মহান ব্যক্তিগণ যেমন আচার অনুষ্ঠান করেন, সমাজের সাধারণ লোক তাদেরই অনুসরণ করে।....(যদ্ যদ্ আচরতি শেষ্ঠ যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ। স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে - শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা-৩/২১)। আমরা শাস্ত্র ও মহাপুরুষগণের জীবনের আলোকে পূজার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করলে এবং সে অনুসারে আমাদের চিন্তাভাবনাকে প্রবাহিত করলে আমাদের অন্তরে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। আমাদের কর্মেও তার প্রতিফলন হয়। 

একজন মানুষের বাহ্যিক আচার আচরণ, কথাবার্তা ও কাজে তার অন্তরের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব ও মানসিক বিকাশের স্তর প্রতিফলিত হয়।  সুশীল সমাজের শিষ্ট ব্যক্তিগণ প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার প্রকৃত সম্মান দেয়াকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেন---“কোনো জাতির প্রগতির শ্রেষ্ঠ মাপকাঠি নারীদের প্রতি তাহার মনোভাব।” বিশ্বের অনেক স্থানে নারীদের সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি, পত্নী বা সহকারী জ্ঞানে শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানো হয়। নারীদের প্রতি এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি যে অযথাথর্, তা হয়তো নয়।  কিন্তু অধ্যাত্ম বিজ্ঞানীগণ বলেন, মাতৃরূপ হচ্ছে নারীর মহিমান্বিতরূপ। চিন্তা, বাক্য ও ব্যবহারে নারীকে মাতৃরূপে দেখাই হচ্ছে নারীকে শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শন করা। ভক্ত নারী জাতিকে মাতৃবৎ জ্ঞান করেন ও সম্মান দিয়ে থাকেন। এটা অনস্বীকার্য যে মানুষ যত পবিত্র হয়, চিন্তাজগতে যত উন্নতির দিকে এগিয়ে যায় এবং মানসিক স্তরে যত বিকশিত হতে থাকে, বাইরের জগতের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়ে তার ব্যবহারও তদনুরূপ উন্নততর হয়। নারীরা যদি যথোপযুক্তভাবে সম্মানিত হয় তবে আমাদের নিজেদের, পরিবার ও সমাজেরও কল্যাণ হয়। আমাদের বৃদ্ধ মনু বলেন- “যেখানে স্ত্রীলোকরা পূজিত হন সেখানে দেবতারাও আনন্দ করেন।”

সমাজে নারীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হলে তা নারীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক হয়। নারীরা শিক্ষায়, কর্মদক্ষতায়, গবেষণায় সাফল্যের সাক্ষর রাখতে পারে। সমাজের উন্নতি, অগ্রগতি তরান্বিত হয় ও সভ্যতার পথ চলা মসৃণ হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের পশ্চাতে বিদ্যমান নারীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা আমাদের এ সত্য অনুধাবনে সহায়তা করে। 
আমরা অন্তরের ইচ্ছা ও আদর্শকে বাইরে স্থূলরূপে পূজা করি, শ্রদ্ধা করি বা স্তুতি করি। কুমারী সরলতার, ভালবাসার, নিরভিমানতার, নিরহংকারের ও মানবতার প্রতীক। কোন শিশুর হাতে হয়ত পাঁচশত টাকার নোট আছে, তার কোন আত্মীয় সেই টাকাটা চাইল। শিশুটি বলবে - না, দেবনা। এটি আমার মা দিয়েছে। আবার সেই আত্মীয় যদি তাকে দু টাকা দামের একটি সুন্দর খেলনা দেয়, শিশুটি তখনই সরলভাবে টাকাটি আত্মীয়ের হাতে তুলে দেবে। শিশুরা পরস্পর খেলা করে, ঝগড়া করে এটা ওটা নিয়ে, পরস্পর মুখ দেখাদেখি নেই, আবার খেলতে আসে পরস্পর মিলে, আগের ঘটনা ভুলে যায়, কোনো অভিমান থাকে না। শিশুর ভালবাসার ক্ষেত্রে, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, ছোট-বড় কোন বৈষম্য নেই। পরিবারের ছোট শিশুটি ছোট-বড় সবার কাছে যেতে পারে, সবার মাঝে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। মাতৃভাবের চর্চ্চা মানে শুধু মাতৃরূপের উপাসনা নয়, হৃদয়ে সহনশীলতা, ভালবাসা, নিরভিমানতা ইত্যাদি মূলবোধেরও চর্চ্চা ও বিকাশ।

শৈশব  ও কৈশোর আমাদের নৈতিক শিক্ষা অর্জনের উপযুক্ত সময়, পরিবার হলো মূল সূতিকাগার।  শৈশব  ও কৈশোরের শিক্ষাই আমাদের পরবর্তী জীবনের আচার, ব্যবহার ও ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। মাতা-পিতা যদি শৈশব থেকে সন্তানদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় উজ্জীবিত করেন, নারীজাতির প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেন, তাহলে তাদের মানবিক মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বও অনুপমভাবে গড়ে উঠে। সামাজিক ব্যাধি হ্রাস পায়। চিন্তাশীল ব্যক্তিগণের সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ হয়। সমাজে উন্নতি, শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় থাকে। প্রতি বছর কুমারী পূজা আসে। কুমারী পূজা ও এর অন্তর্নিহিতভাব আমাদের নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের আদর্শ, আলো¯^রূপ; শরতের কালের দেবতা আমাদের সেই আলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেন।
লেখক : সন্ন্যাসী,রামকৃষ্ণ মঠ, ঢাকা


..........................

আরও পড়ুন