• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০১৯, ০৮:৩০ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ১০, ২০১৯, ০৮:৩০ পিএম

আবরার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক

আবরার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক


বেপরোয়া ছাত্রলীগ। কোন মতেই তাদের নিয়ন্ত্রন করা যাচ্ছে না। অতিসম্প্রতি চাঁদাবাজি আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন দাবিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বাদ দেয়া হয়েছে। অভিযুক্ত আরো অনেক। কত কি ঘটে গেল ছাত্রলীগকে ঘিরে । তারপরও তারা অপ্রতিরোধ্য। ছাত্রলীগের যে আচার ব্যবহার নমনীয় কখনও নমনীয় ছিলো এমন বলা যাবে না। আমরা ছাত্র জীবনে দেখেছি ,এরা ক্ষমতায় ছিলো না, তারপরও ক্যাম্পাসের শান্ত-শিষ্ট ছাত্র-ছাত্রীদের উপর তাদের অযথা ক্ষোভ ঝাড়তে হবে। কি সব দাবি দাওয়া ছিলো তা বলে শেষ করা যাবে না।

আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। আমাদের বিভিন্ন কাজে তাদের বাধঅ শুনলেই মাথা ঠিক রাখা যেত না। তবু তাদের সাথে আমরা গোলমাল করতাম না। তারাই বাধানোর পায়তারা চালাতো। তবে এখনকার মতো  ছিলো না।  আবরারকে যেভাবে হত্যা করা হলো একজন সাংবাদিক তার বর্ণনা লিখেছেন, সে বর্ণনা পড়লে কোন মানুষ সুস্থি থাকতে পারবে না। ‘কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার রায়ডাঙ্গা গ্রামে আবরারের বাড়ি। ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন তিনি। পড়ালেখার চাপ থাকায় গত রবিবার ফিরে আসেন। সন্ধ্যায় বুয়েট শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে ব্যস্ত ছিলেন পড়ালেখায়। রাত ৮টার দিকে আবরারকে ওই হলের দোতলার ২০১১ নম্বর টর্চার সেলে ডেকে নিয়ে হুমকি দিতে শুরু করেন বুয়েট ছাত্রলীগের নেতারা। এ পর্যায়ে ছাত্রলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার আবরারের মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে ফেসবুক ঘেঁটে বাছ-বিচার না করেই হকি স্টিক দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। সেখানে অবস্থান করা সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিনও আরেকটি হকি স্টিক নিয়ে আবরারকে পেটানোতে অংশ নেন।

ওই সময় ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন আবরারের হাত ধরে রাখেন। আর আবরারের পায়ে পেটাতে থাকেন উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল। সদস্য মুনতাসির আল জেমি, মো. মুজাহিদুর রহমান মুজাহিদ, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, একই বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ইশতিয়াক মুন্নাও নির্দয়ভাবে পেটাতে শুরু করেন আবরারকে। কেউ হকি স্টিক দিয়ে, কেউ লাঠি দিয়ে, কেউ বা কিল-ঘুষি দিয়ে ইচ্ছামতো আবরারকে পেটানোতে অংশ নেন। এভাবে ২২ জন অংশ নেন এই ভয়ংকর নির্যাতনে। আবরার একটু কাঁদতেও পারেননি। কারণ তখন তাঁর মুখ চেপে ধরা হয়েছিল। চরম এই নির্যাতনের মধ্যেও আবরার বলেছিলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি, আমাকে মেরো না।’ আরো কিছু বলার চেষ্টা করলেও নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা আর বলতে পারেননি।

ওই অবস্থার মধ্যেই টর্চার সেলে প্রবেশ করেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ। তাঁরাও অপেক্ষা না করে নিস্তেজ প্রায় আবরারকে পেটাতে শুরু করেন। এভাবেই একপর্যায়ে মেধাবী ছাত্র আবরার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।’ (৯ অক্টোবর, ২০১৯ কালের কণ্ঠ) একজন ছাত্রনেতা সে যে দলের হোক সে নৃশংস হতে পারে না। তার দলের কেউ হলে তাদের নিবৃত্ত করতো অন্য সবাইকে। ছাত্র লীগের সাথে আমাদের দ্বন্দ্ব হতো না যে তা নয়। তবে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ছিলো । ঝগড়া-গোলমাল শেষে দুপক্ষের নেতারা সবাইকে ডেকে ভালো কথা বলতো, ভাগ করে চা পর্ব হতো(কারন তখন ছাত্র নেতাদের কাছে এত টাকার কথা চিন্তাও করা যেত না। এ কেমন ধরনের সংস্কৃতি, এত নিষ্ঠুর মানুষ কিভাবে হয় ভাবা যায় না। বুয়েটে এরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করছে ঘটনার শেষ সেখানেই নয়।

আবরারে লাশ সিড়ির কাছে রেখে তারা খেলা দেখেছে তারপর রাতের খাবার খেয়েছে। ভাবা যায় যে এরা ছাত্র? এরা মানুষ। ভাবতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।  এ ঘটনায় মধ্য দিয়ে স্পষ্ট যে, বেপরোয়া ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যের রাশ টানতে পারছে না ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও অভিভাবক রাজনৈতিক দল। ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন। (ভোরের কাগজ ৯ অক্টোবর,২০১৯)। এমতাবস্থায় সরকারের অনেক ইতিবাচক অর্জন ও সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে ছাত্রলীগের দুষ্কর্ম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অনুষ্ঠানে তাদের সতর্ক করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তাতে সাময়িক থামলেও বন্ধ হয়নি। এ থেকে মুক্তি মিলবে কীভাবে, এর কোনো উত্তর নেই কারো কাছে।

ওই ঘটনায় পুলিশ বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ ১০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।আবরারের বাবার দায়ের করা মামলায় ১৯ আসামির মধ্যে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলকে। তিনি ১৩ ব্যাচের সিই বিভাগের ছাত্র। এর পরের আসামিদের মধ্যে ১৪তম ব্যাচের সিই বিভাগের ছাত্র ও সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ, ১৫তম ব্যাচের ছাত্র এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মো. অনিক সরকার, একই ব্যাচের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন, উপ-সমাজসেবা সম্পাদক ও ১৬ ব্যাচের ইফতি মোশাররফ সকাল, সাহিত্য সম্পাদক ও একই ব্যাচের মনিরুজ্জামান মনির, ক্রীড়া সম্পাদক ও ১৫ ব্যাচের মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ১৭তম ব্যাচের মাজেদুল ইসলাম, ছাত্রলীগের সদস্য ও ১৬তম ব্যাচের মুজাহিদুর রহমান, একই ব্যাচের ছাত্র তানভীর আহম্মেদ, ১৭তম ব্যাচের হোসেন মোহাম্মদ তোহা, ১৬ ব্যাচের মো. জিসান, একই ব্যাচের মো. আকাশ, ১৭ ব্যাচের শামীম বিল্লাহ ও মো. সাদাত, ছাত্রলীগ সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম, ১৭ ব্যাচের মো. মোর্শেদ ও একই ব্যাচের মো. মোয়াজ এবং ছাত্রলীগ সদস্য ও ১৭ ব্যাচের ছাত্র মুনতাসির আল জেমি।

মামলার সব আসামিই শেরেবাংলা হলের বিভিন্ন তলার আবাসিক ছাত্র। তাদের মধ্যে মাজেদুল, তানভীর, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, জিসান, আকাশ, শামীম, সাদাত, মোর্শেদ ও মোয়াজ ছাত্রলীগের কোনো পদে রয়েছেন কি-না তা জানা যায়নি। তবে শেরেবাংলা হলের একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, সক্রিয় কর্মী হিসেবে তারা নিয়মিত ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে যান এবং সবাই সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেলের কর্মী।(সমকাল,৯ অক্টোবর,২০১৯)


 প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনামূলক একটি স্ট্যাটাস এবং শিবিরের নেতা সন্দেহে আবরারকে তারা নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যা করে বলে বলা হচ্ছে। আবরার শিবিরের কর্মী বা নেতা ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবরারের পরিবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তবে আবরার মাঝেমধ্যে তাবলিগে যেতেন। ঘটনার পর থেকে বুয়েটে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবরার হত্যার বিচারের দাবিতে শেরেবাংলা হলে অবস্থান নিয়েছেন। এমনকি উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। ছাত্রলীগ নামধারীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে অস্থির বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, সরকারি সম্পদ ধ্বংসসহ বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই ছাত্র সংগঠনটি।  বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ পরিচয়ধারীদের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করতে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে; অভিভাবক রাজনৈতিক দলকে। অপরাধীর পরিচয় যাই হোক তাকে ছাড় দেয়া যাবে না- এটা যে কথার কথা নয় তার প্রমাণ দিতে হবে নিজেদের পদক্ষেপে। সরকারকেও তার ভাবমূর্তির স্বার্থেই শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস মোকাবেলায় কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত, প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন মা হিসাবে তিনি এ হত্যার বিচার করবেন। এ বিচারের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হোক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আবরার  হত্যার খুনীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির মধ্য দিয়ে শুরু হোক বিচারের সংস্কৃতি।

লেখক: সাংবাদিক