• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০১৯, ০৬:৫৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ২৪, ২০১৯, ০৬:৫৪ পিএম

দুর্নীতি ও অগণতন্ত্রের মধ্যে উন্নয়ন সম্ভব কি?

দুর্নীতি ও অগণতন্ত্রের মধ্যে উন্নয়ন সম্ভব কি?

সম্প্রতি অর্থনীতিতে দ্বিতীয় বাঙালি, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জি ও তার ফরাসি স্ত্রী ডাফলো এবং ক্রেমার অর্থনীতি শাস্ত্রে নোবেল বিজয়ী হয়েছেন। বাঙালিদের এই তৃতীয় নোবেল প্রাপ্তিতে আমরা সবাই খুশী, যদিও তাঁর অনুমাত্রিক দারিদ্র্য সমাধানের প্রেসক্রিপশানগুলি নিয়ে অনেকের মনে অনেক সন্দেহ ও দ্বিধা রয়েছে। অবশ্য চলতি হাওয়া বা যুগটি হচ্ছে ‘Grand Narrative’ (মহাকাব্য) এর পরিবর্তে ‘Micro Narrative’ (ছোট গল্প)-এর যুগ।

বিবিসিতে প্রদত্ত সাক্ষাত্কারে অভিজিত বলেছেন, ‘দুর্নীতি ও গনতন্ত্রহীনতার মধ্যেও অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও চরম দারিদ্র্য’ কমতে পারে কারন অগণতান্ত্রিক ও দুর্নীতিপরায়ন সরকারও ন্যূনতম উন্নয়ন সাধন করে নিজের শাসনক্ষমতাকে দীর্ঘায়ত করতে চান! প্রশ্ন জাগে, এখানে তিনি দুর্নীতি ও অগণতন্ত্র বলতে ঠিক কতটুকু মাত্রা বুঝিয়েছেন এবং কী কী শর্তে দুর্নীতি ও অগণতন্ত্রের মধ্যেও অর্থনীতির উন্নতি সম্ভব? দুর্নীতির ও অগণতন্ত্রের মধ্যে প্রচলিত প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য হ্রাস অর্থে অর্থনীতির উন্নয়ন সম্ভব, তার উদাহরণ হচ্ছে ‘স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদ’ বা 

আমরা বাস্তবে দেখেছি, জেনারেল পার্ক চুং হি-র আমলে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর উন্নয়ন হয়েছিল, দারিদ্র্যও কমেছিল এবং এমনকি আয় বৈষম্যও কমেছিল যদিও সেখানে দুর্নীতি ছিল এবং গণতন্ত্রও ছিল না। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, পাশাপাশি এমন কতকগুলো রেডিকেল অর্থনৈতিক নীতিমালা পার্ক চুং হি গ্রহণ করেছিলেন, যেগুলো উন্নয়নের সহায়ক হয়েছিল। যেমন ভূমি সংস্কার। ভূমি সংস্কারের ফলে ভুমি মালিকানা বৈষম্য ও গ্রামীণ আয় বৈষম্য হ্রাস পেয়েছিল এবং কৃষি উত্পাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছিল কারণ অল্প জমিতে চাষি বেশি শ্রম নিয়োগ করে নিবিড়ভাবে একাধিক ফসল উত্পদনে সচেষ্ট হয়েছিল। এর ফলে কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের দাম কমে যায়। গ্রামের উদ্বাস্তু মানুষ শহরে আসতে থাকে এবং শ্রমিক হিসেবে শ্রমঘন মাঝারি কারখানায় আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ পেতে শুরু করে। যেহেতু কৃষিজ খাদ্যপণ্যের দাম সস্তা ছিল, সে জন্য অল্প মজুরিতেও তাদের পক্ষে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব হয়েছিল। সেই সব সস্তা শ্রমিক ব্যবহার করে নানা রকম শ্রমঘন শিল্প উৎপাদন শুরু করেন শহরের উদ্যোক্তারা। সে সব শ্রমঘন পণ্য আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের বাজারে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দক্ষিণ কোরিয়া। পরবর্তী সময়ে শুধু দক্ষিণ কোরিয়া নয়, পূর্ব এশিয়ায় অন্যান্য দেশও প্রায় একই নীতি অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশের কৃষি ও শিল্পের যুগপত্ উন্নয়ন সফল করতে সক্ষম হয়েছিল।

এ ক্ষেত্রে চীনের সাফল্য সবচেয়ে ঈর্ষণীয়। ছোটো ছোটো নানা শ্রমঘন পণ্য উৎপাদনে চীনের জুরি নেই—আবার সময় মতো বৃহত্ কমিউন ভেঙে ছোটো পারিবারিক খামার গঠনেও চীনের কোনো অসুবিধা হয়নি কারণ চীনে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। এই বিকেন্দ্রীভূত কৃষি ও ছোটো-মাঝারি শিল্পের বিকাশের নীতিকে চীনে বলা হয় ‘দুই পায়ে হাঁটা’। কৃষি একটি পা, শিল্প হবে আরেকটি পা। কিন্তু সব দেশে কি এসব নীতি সমান সাফল্যেও সংগে প্রয়োগ করতে পেরেছে বা পারবে?

এই ধরনের নীতি নিয়ে মুখে মুখে শোরগোর তুলে ফিলিপাইনে জেনারেল মার্কোসের সময় উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়েছিল। মার্কোস নিজে ছিলেন সামরিক শাসক। মার্কোসের অনুগত পুঁজিপতি আত্নীয় স্বজন গোষ্ঠী ছিল। ব্যাংক থেকে তাদের প্রচুর ঋণও দেওয়া হতো। পার্ক চুং হীর বেলায়ও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ করি। তার আমলেও দক্ষিণ কোরিয়ায় রাষ্ট্রীিয় আনুকুল্যে বিশাল ক্ষমতাশীল হাউজ গড়ে ওঠে, যারা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় যে ফিলিপাইনে মার্কোস ভূমি মালিকানায় গ্রহনযোগ্য সমতামুখি সংস্কার করতে পারেনি। যেমনটি দক্ষিণ কোরিয়ায় ও পরবর্তীতে তাইওয়ানেও সম্ভব হয়েছিল। যদিও ফিলিপাইনে ইরি বা সবুজ বিপ্লবের হেডকোয়ার্টার তৈরী হয়েছে, কিন্তু সেখানে গ্রামীণ দারিদ্র্যের সমস্যার সমাধান হয় নি। ফিলিপাইনে কোন কোন দ্বীপে তীব্র আয় ও সম্পদ বৈষম্যের কারণে গ্রামাঞ্চলে বামপন্থিদের গেরিলা বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, যেটা দক্ষিণ কোরিয়ায় হয়নি। অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ার ভূমি সংস্কার সংগঠিত না করে উপায় ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ লগ্নে কোরিয়া যখন উত্তর ও দক্ষিণ—এই দুই অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়, তখন উত্তর কোরিয়ায় ভূমি ব্যবস্থা আমূল পরিবর্তন হয়ে যায় এবং কোরিয়ার সেই অংশ সমাজতান্ত্রিক নীতি গ্রহন কওে নেন। তখন দেখা-দেখি দক্ষিণ কোরিয়ায়ও অনুরূপ ভূমি সংস্কারের তাগিদ অনুভূত হয়েছিল। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন, সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ার চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকুশলতা বেশি—এ কথা বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণের জন্য তখন আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদীরাই দক্ষিণ কোরিয়াকে ভুমি সংস্কারের জন্য বিশেষ সহায়তা প্রদান করেন।

ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে সে রকম রেডিকেল সংস্কারের কোনো বাধ্যবাধকতা মার্কিনীদের ছিল না। আর একটা বিষয়ে ফিলিপাইনের সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার পার্থক্য ছিল। ফিলিপাইনে ক্রোনীরা (Cronies) ততটা জাতীয়তাবাদী ছিলেন না। তারা ছিলেন বিলাসী। তারা রাষ্ট্রীিয় আনুকল্য পেয়ে সেই অর্থ নিজের দেশেই উৎপাদনশীল বিনিয়োগে এবং রপ্তানিমুখী শিল্পায়নে দক্ষতার সঙ্গে বিনিয়োগ করেননি, তাদের অনেক অর্থই বিলাস-ব্যাসনে ব্যয় হয়েছে এবং বাইরে পাচার হয়েছে। যেটুকু রপ্তানিমুখী শিল্প ফিলিপাইনে তখন গড়ে উঠেছিল, তার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের চেয়ে আমদানির ব্যয় ছিল অনেক বেশি। ফলে তাদের কাছে কখনোই বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ তৈরি হয়নি। তাছাড়া তখনো সস্তা শ্রম রফতানি করে চলতি একাউন্টের ঘাটতি পুরণের কৌশল ফিলিপাইনে প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

পক্ষান্তরে দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁজিপতিরা অনুকূল পুঁজি পেয়ে সস্তা শ্রমের অব্যাহত সরবরাহের ভিত্তিতে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন এবং এই মুনাফা দেশেই পুনর্বিনিয়োগ করেন। এছাড়া অনেক বিদেশী বিনিয়োগও তারা অপেক্ষাকৃত অনুকূল শর্তে আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন। পার্ক চুং হির কৃতিত্ব এই জায়গায় যে তিনি বড়ো বড়ো হাউজকে শুধু প্রশ্রয়ই দেননি, তাদেও সংগে কিছু চুক্তিও (Deals) করেছিলেন। চুক্তি পালন করে ঋণ শোধ ও তাদের উৎপাদনশীল বিনিয়োগে বাধ্য করেছিলেন। এমনকি ভারী শিল্প বা পুঁজিঘন আমদানি প্রতিস্থাপক নানাধরনের শিল্প নির্মাণের ক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ না শুনে তারা অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। শুধু সস্তা শ্রমভিত্তিক শিল্পায়নে সীমাবদ্ধ না থেকে সময়মত তাদেও জাতীয় পুঁজি রাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে উত্তরণ ঘটিয়েছে দক্ষ শ্রমভিত্তিক পুঁজিঘন শিল্পায়ন। এই উত্তরণেও রাষ্ট্র সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একদিকে যেমন ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে সঠিক উৎপাদনশীল খাতে পরিকল্পিতভাবে ঋণ প্রবাহিত করা হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি উন্নত প্রযুক্তি পরিচালনায় সক্ষম নতুন মানবসম্পদ গড়ে তোলা হয়েছে। কোরীয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কোরিয়ান রাষ্ট্র চাহিদা অনুযায়ী বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং শিক্ষার গুণ ও মানকেও উন্নত করেছে। কোরিয়ান রাষ্ট্র এসব নীতি চালাতে সক্ষম হলো, তার অর্থ এই নয় যে গণতন্ত্র থাকলে এগুলো তারা করতে পারত না। তার অর্থ হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রের যে আমলাতন্ত্র বা রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেখানে গড়ে উঠেছিল, তারা ব্যবসায়ীদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে যায় নি বা পারেনি। সেখানে শাসকগোষ্ঠীর তিন অংশ সামরিক-বেসামরিক আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক এলিট। এদের মধ্যে একধরনের পারস্পরিক চুক্তি ভিত্তিক পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণই ছিল ব্যবস্থাটির জীয়নকাঠি। আমলারা ও রাজনীতিকরা বেশি খাজনা আদায় করতে চাইলে শক্তিশালী ব্যবসায়ীরা তা ঠেকিয়ে দিতেন। উলটো দিক থেকে আবার ব্যবসায়ীরা যদি বেশি খাজনা ভোগ করতে চাইতেন, তাহলে আমলা ও রাজনীতিবিদেরা তা ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হতেন। দক্ষিণ কোরিয়া পুঁজিবাদী পথ গ্রহণ করলেও তার রাষ্ট্রায়াত্ত খাত ছিল দক্ষ। সব রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানকে নিজের বাজেটের মধ্যে কাজ করতে হতো। সব রাষ্ট্রীয় ব্যয়কে বাজেটে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হতো। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র ছিল কঠোর। এই দিক থেকে তারা সবসময় কাজ করেছেন ‘Hard Budget Constraint’ এর মধ্যে। যেহেতু এখানে কঠোর আইনের বা নিয়মের কোনো ব্যত্যয় ছিল না সেজন্য সরকারী ব্যয়ে অপচয় ছিল কম। সরকারি বাজেট বাস্তবায়ন সংস্থাগুলো কাজ খারাপ করে বাড়তি ব্যয় করার সুযোগ পেত না। একধরনের কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য প্রয়োজন ছিল দক্ষ ও সত্ আমলা। কোরিয়ান আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়, এটা ছিল এক ধরনের মেরিটক্রেসি। অর্থাত্, এখানে যারা দক্ষ তাদেরই প্রমোশন হবে।

উল্লেখিত যেসব গুণের কথা বললাম, সেগুলোর কিন্তু ফিলিপিনসে উপস্থিত ছিল না। সেখানে আমলাতন্ত্র ও রাষ্ট্র শক্তিশালী ছিল। গণতন্ত্র উপস্থিত ছিল না আর সেই সুযোগ নিয়ে আমলা ও জেনারেল এবং রাজনীতিবিদেরা ক্রমশ স্বেচ্ছাচারী সম্রাটে পরিণত হয়ে যায়। দুর্নীতির দ্বারা স্বয়ং মার্কোস ও লেডি মার্কোস প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছিলেন। তাদের ঠেকানোর মতো বিপরীত শক্তি ব্যবসায়ীদের ছিল না।

সুতরাং এই দুই দেশের উন্নয়ন ইতিহাস থেকে দেখা যাচ্ছে অগণতান্ত্রিক দুর্নীতিপূর্ণ পরিবেশে উন্নতি হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। অবশ্য অভিজিৎ ব্যানার্জি ‘সম্ভব’ কথাটা বলেছেন, কিন্তু কখন সম্ভব নয়, সে কথাটা বলেননি। আমাদের দেশে এখন যা চলছে, তা থেকে এ কথা যদি আমরা ভাবি যে আমাদের দেশেও গণতন্ত্রহীন দুর্নীতিপূর্ণ পরিবেশে শনৈ শনৈ অগ্রগতি হবে, তাহলে আমরা ভুল করব। হতে পারে আমরা দক্ষিণ কোরিয়া না হয়ে ফিলিপাইন হয়ে যাব।

 লেখক :অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়