• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: অক্টোবর ৩১, ২০১৯, ০৬:১৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : অক্টোবর ৩১, ২০১৯, ০৬:১৯ পিএম

অবক্ষয়ের স্রোতে দিনাতিপাত, জনগণের ন্যায্যহিস্যা কোথায়?

অবক্ষয়ের স্রোতে দিনাতিপাত, জনগণের ন্যায্যহিস্যা কোথায়?

গ্রামের একটি হাঁসচুরি থেকে পেঁয়াজ মজুদ রেখে মানুষের অর্থ লুট করা, নদী দখল থেকে বালিশকাণ্ড, শিশুকন্যা ধর্ষণ থেকে ছাত্রীকে পুড়িয়ে মারা-সবটির সাথেই শেষ বিচারে ক্ষমতাই জড়িত। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়-ক্ষমতার রাজনীতিই সবগুলো ঘটনায় কেন্দ্রীয় চরিত্র। সেরকমই, আরও হাজারটা অনিয়ম আর আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোও কিন্তু সেই ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতিরই নির্যাস। সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা সময় ছিল, যখন  ছিঁটেফোটা হলেও জনহিতকর রাজনীতির তাগিদ ছিল কিন্তু হালে সেটা পুরোপুরিই মিলিয়ে গেছে! রাজনীতিতে এখন লোকরঞ্জনবাদী মিথ্যা অঙ্গীকার, ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার আর ডিভাইড এন্ড রুল নীতিই আস্ফালন দেখাচ্ছে।

চটকদারী এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির শক্তি এবং বাড়-বাড়ন্তের গুঁঢ় রহস্য ভেদ করতে এর দুরারোগ্য দুষ্টক্ষতগুলোতে আলো ফেলা উচিত। আর সেটা করা গেলে ধনীক-লুটেরা গোষ্ঠীর গণবিরোধী রাজনীতির কদর্য মুখটা অনেকটাই বেড়িয়ে আসবে। সেই বিচারে যাবার জন্য মুক্তিযুদ্ধই হবে সর্বোত্তম ভিত্তি। কারন, একাত্তর এদেশের জন্য এমন মহার্ঘ একটি বিষয় যাকে জাতীয় চেতনার প্রমিত দিশা জ্ঞান করে গরিষ্ঠ মানুষ। দলকানা আর ক্ষমতাসীনদের স্তাবক না হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে দেখলে পাওয়া যায় তার শক্তিশালী আর গণমূখী কিছু সুষ্পষ্ট অঙ্গীকার, সেগুলো হল-
১. সব প্রকার বৈষম্য, বঞ্চনার অবসান এবং মর্যাদাপূর্ণ অর্থনৈতিক মুক্তি
২. রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সবার জন্য অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক অংশীদারি নিশ্চিত করা
৩. ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতিক ভীত গড়ে তোলা।

পবিত্র সংবিধানের মূলনীতি অংশে উপরোক্ত কথাগুলোই বহাল রাখা হয়েছে যা জনআকাঙ্ক্ষার সাথে  শতভাগ সাজুয্যপূর্ণ। যে নিরস্ত্র বাঙ্গালি পাকিদের শত্রুজ্ঞান করে তাদের সামরিক শক্তির সম্মুখে  অকুতোভয় ছিল তার প্রধান মন্ত্রণা কি ছিল? তা তো ছিল সেই চাওয়া যা শোষণের অবসান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ আর মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেবে। যা ছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষেরই প্রাণের চাওয়া। মাত্র নয় মাসেই বিজয় আসলো তো বাংগালীর স্বাধীনতার প্রশ্নে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় সওয়ার হয়েই। কিন্তু কি আশ্চর্য,  মাত্র কয়েক বছরেই সেই অঙ্গীকার ফিঁকে হতে শুরু করল! এদেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ, স্টাব্লিশমেন্ট সর্বনাশের হাত ধরে  স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে স্বপরিবারে হত্যা করলো, যাত্রা করলো উল্টোপথে হাঁটা!

এর কী কারন এবং তার ফলাফলই বা কী হয়েছে তার অভিসন্দর্ভ তৈরি এ লেখার লক্ষ্য নয়। এই নিবন্ধের মুখ্য উদ্দেশ্য হল-যে চেতনা আর আশায় আপামর জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশকে স্বাধীন করলো তা পূরণ না করে যে অপরাজনীতি আর ক্ষমতা আমাদের ভাগ্যের নাটাই ঘোরাচ্ছে তারই কিছু অন্ধকার দিকে আলো ফেলা।

পঁচাত্তর পরবর্তীতে এবং স্বৈরাচার এরশাদের নয় বছরের শাসনামল মূলত: তৃতীয় শক্তিই নিয়ন্ত্রণ করেছে। যাঁরা এ নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা হয়তো বিশদ বলতে পারবেন সেই সময়ে ক্ষমতার লাগাম কার হাতে ছিল আর কারা কী কারনেই বা তা করেছিল সে বিষয়টি। কিন্তু এগুলো এমন কিছু বিষয় যেগুলি সাধারণ মানুষও অনেকটাই বুঝতে পারে। যা হোক, সেই অবস্থা কিন্তু কখনই বাংলাদেশকে ছেড়ে যায়নি, বরং গোকূলে বেড়েছে।

কিন্তু নব্বই -এর ৬ ডিসেম্বর স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর সঙ্গত কারনে মানুষ পরিবর্তন আশা করেছিল। দীর্ঘ সামরিক শাসন অবসানে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর যুথবদ্ধ আন্দোলন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার এবং তিক্ত অতীতকে চিরতরে দূর করার পক্ষে গড়ে ওঠা জনমত মানুষের আশাবাদী হওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল। তিনজোটের রূপরেখা অনুযায়ী দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জিতে সরকার গঠন করে। কিন্তু মানুষ যে প্রত্যাশা নিয়ে এতোদিন অপেক্ষা করেছিল তা অল্পতেই মিলিয়ে যেতে থাকে। বিশেষ করে যখন প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সুক্ষ্ণ কারচুপির অভিযোগ তোলে।  যাহোক, পরবর্তীতে তাদের সংসদে যাওয়া এবং গঠনমূলক বিরোধীতার অঙ্গীকার রাজনীতিতে আপাত: স্বস্তি নিয়ে আসে।

কিন্তু সেই স্বস্তি বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। একদিকে সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিএনপি'র সরকার পরিচালনা, নির্বিচার দলীয়করণ এবং দূর্ণীতি আর অন্যদিকে বরোধীদলের কারনে-অকারণে সংসদ বর্জন সহসাই রাজনীতিকে অস্থির করে তোলে। দুটি প্রধান দলের মধ্যে দুরত্ব আর রাজনীতির সমীকরণ নিজেদের পক্ষে মেলাতে গিয়ে তিনজোটের রূপরেখা অবজ্ঞা করতে থাকে। যা  রাজনৈতিক নীতি আর আদর্শকে বড় ধরণের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়। অন্যদিকে সদ্য পদচ্যুত হু.মো. এরশাদ জেলে থেকেও পাঁচটি আসনে বিজয়ী হলে পরিবর্তনের আশার বেলুন একেবারই চুপসে যায়।

পরবর্তিতে মাগুড়া উপনির্বাচনে কারচুপিকে ইস্যু করে বিএনপি সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি প্রবর্তনের একদফা দাবীতে আওয়ামী লীগ সংসদ বর্জনসহ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে দেশ অচল হয়ে পড়ে। অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে পতিত জনগণ যে কোন মূল্যে সে অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায়।

১৯৯৬'এর ১৫ ফেব্রুয়ারির একপেশে নির্বাচনের মাধ্যমে টানা দ্বিতীয়বার সরকার গঠন করলেও মাত্র পনের দিনের মাথায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে পদত্যাগে বাধ্য হয় বিএনপি। বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে।

কিন্তু ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য বিএনপি এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগের দলীয় স্বার্থবাদী কার্যক্রম দেশবাসীকে যুগপৎ বিরক্ত ও হতাশ করে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতি নির্যাতন এবং কারচুপির মাধ্যমে জয় ছিনিয়ে নিতে যেমন দ্বিধা করেনি, আওয়ামী লীগও তেমনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে জোরদার করতে স্বাধীনতা বিরোধী  জামায়াতের সংগে আঁতাত করতেও পিছপা হয়নি। শুধু তাই নয়, প্রধান এ দুটি দল স্ব-স্ব স্বার্থে এতটাই বালখিল্য আর নীতিহীন ভূমিকা নেয় যা এরশাদবিরোধী আন্দোলন থেকে সৃষ্ট নতুন আশার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুঁকে দেয়। 

যাহোক, আওয়ামীগ দীর্ঘ একুুশ বছর পর সরকারে এসে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আর পরবর্তী নির্বাচনে জিতে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু এবার বিএনপি সরকারে বসেই নৈতিক, আইনী সব ধরণের সীমা লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে থাকে। এর অংশ হিসেবে তারা আইন, আদালত, ব্যুরোক্রেসি সবকিছুতেই প্রভাব বিস্তার করতে থাকলে প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী লীগও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে অনড় অবস্থানে চলে যায়। এরকম একটি বাস্তবতায় সামরিক বাহিনীর সহায়তায় অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনীতির জংধরা নানা প্র্যাকটিস দূর করতে উদ্যোগ নিলে প্রাথমিকভাবে জনগণ স্বস্তিবোধ করতে থাকে। কিন্তু অচীরেই সে সরকারও যথা পূর্বং তথা পরং হয়ে যায়। তারা দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বৈশিষ্ট্য হারিয়ে নির্বাচিত সরকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এমনও শোনা যায় যে তারা, জনমতকে ভুল পাঠ করে মূলধারার রাজনৈতিক দল এবং নেতৃত্বে বদল আনারও প্রয়াস নিয়েছিল। যাহোক, দীর্ঘ দু'বছর পর ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে দিন বদলের সনদ নিয়ে ভূমিধ্বস বিজয়ে আওয়ামীলীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসে। যার কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল আকাশ সমান। আর সেটা আওয়ামী লীগই তৈরি করেছিল। তারা অঙ্গীকার করেছিল- প্রতিটি পরিবার থেকে অন্তত একজনকে সরকারি চাকুরীতে নিয়োগ, দশটাকা কেজি চাল আর ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ইত্যাদি। এছাড়া কর্মসংস্থান বাড়িয়ে মাথাপিছু আয় বাড়ানো, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। সেই সরকারের ধারাবাহিকতায় এখন তাদের তৃতীয় মেয়াদ চলছে। বছরের হিসেবে আজ প্রায় একযুগ হতে চলল, কিন্তু দিন বদল কী হয়েছে? কার দিন বদল হয়েছে?যে আশায় দেশ স্বাধীন করেছি মানুষ, যে অঙ্গীকার নিয়ে এরশাদশাহীর পতন ঘটানো হয়েছিল - তা বাস্তবায়নে আওয়ামী সরকারের কর্মসূচি কি? সেই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা কী প্রয়োজনীয় নয়?


নব্বই সালে এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং ফখরুদ্দীন সরকার মিলিয়ে আঠাশ বছর পার হয়ে গেল। এরমধ্যে ১৯৯৬-২০০০ মেয়াদসহ টানা বারো বছর সরকারে আওয়ামী লীগ, তার আগে দু'বার বিএনপি নেতৃত্বাধীন দল সরকার পরিচালনা করলো। তাদের যার যার ভাষ্যে দিনবদল আর উন্নয়নের দিগ্বিদিক প্রচার-প্রচারণায় কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। বর্তমান সরকারের বয়ানে উন্নয়নের নানারকম ফিরিস্তি তুলে ধরা হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন ভার্সন হল- মাথাপিছু আয় অনেক বেড়েছে, বার্ষিক গড় জাতীয় উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি দীর্ঘদিন ধরে উর্দ্ধমূখী, দারিদ্রতার হার অনেক কমেছে,  বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি অন্যতম।

কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষিতে রাজনীতির গুনগত পরিবর্তন অঙ্গীকার, সমাজে নায্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অগ্রগতি পরিমাপের তো সনাতনী সূচকে করা যাবে না। কাঙ্খিত  সেই পরিবর্তন পরিমাপে দরকার এমন সব সূচক যার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ, মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের অধিকার ইত্যাদি। এছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িকতা, একক গণমূখী শিক্ষা প্রবর্তন, নারীর সম মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করার মাধ্যমে নায্যতা নিশ্চিত করাও সেই উন্নয়নের অলঙ্ঘনীয় সূচক। আর সেদিক থেকে উন্নয়নকে মাপতে গেলে ক্ষমতাসীন সরকারসমূহের দাবী ধোপে টেকে না, খারিজ হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লেন্স দিয়ে দেখলে জনতুষ্টিবাদী  উন্নয়নের চেহারাটা কেমন হবে নিম্নে দেখুন-

-  গড় মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি যেটা দেখানো হচ্ছে সেটা একটা ধাঁধাঁ ছাড়া আর কিছু না। সেটা কিছু সংখ্যক মানুষের অবৈধ পথে আয়ের সাথে সাধারন স্বল্প-আয়ের মানুষের আয়ের গাণিতিক যোগ এবং ভাগফল! ধরুন, তালুকদার নামে একজন মানুষের আয় মাসে তিন লক্ষ টাকা, আর গনি মিয়া নামের একজনের কুড়ি হাজার। তাহলে দুজনের আয়ের যোগফল দাঁড়ায়-তিনলাখ কুড়ি হাজার।  ঐ দুজনের গড় আয় দাঁড়ায় এক লক্ষ ষাট হাজার টাকা। তাই এমন অঙ্ক আর শুভঙ্করের ফাঁকি ক্ষমতাসীনদের বিশেষ পছন্দ। কিন্তু তা সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয়ের সাথে একরকম তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।

- লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স বলছে-সবচেয়ে বেশী অতি ধনী মানুষের (অতি ধনী বলতে বোঝায় যাদের সম্পদ তিন কোটি ডলার বা তার বেশী অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় আড়াই শত কোটি টাকার উপরে, তাদের) সংখ্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেদেশে এই সংখ্যাটি ৮০ হাজার জন। এরপরে জাপান, আর চীন। সংস্থাটি বলছে আশ্চর্যের ব্যাপার হল-পৃথিবীতে সবচেয়ে দ্রুত গতিতে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে বাংলাদেশে। ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর এই সংখ্যাটি ১৭.৩ শতাংশ হারে বাড়ছে যা সবচেয়ে ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশী! অর্থনীতি থিঙ্কট্যাঙ্ক বলছে- বাংলাদেশে এ সংখ্যাটি যে অতি দ্রুত বাড়ছে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই। এদেশে কারা নানাভাবে টাকা বানাচ্ছে তা তো সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অল্প কিছু মানুষকে দ্রুত ধনী বানানোর জন্য তো মানুষ যুদ্ধ করেনি! অথচ তাই হচ্ছে কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ জাতীয় আয়ে ন্যায্যহিস্যা পাচ্ছে না। দেশে আয়-বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে আর আয়ভিত্তিক বৈষম্য হলে তা শুধু অর্থের কম-বেশীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মানুষের জীবনে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তাকে কাবু করে রাখে।

- তথাকথিত উন্নয়নের এ খেলায় পুঁজিবাদের কদর্য দাঁতগুলো কেলিয়ে কেলিয়ে হাসতে থাকে। টাকা আর ক্ষমতার দাপটে একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতা কোনো কিছুরই তোয়াক্কা  করছে না। প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে অবৈধ জুয়ার রমরমা ব্যবসা, পিয়ন থেকে শীর্ষ কর্মকর্তা সবাই নাই নাই করেও শতকোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। ক্ষমতার রাজনীতি বা তৎসঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি মাত্রই আজ অসীম ক্ষমতার আধার। ক্ষমতায় বলয় থেকে ছিঁটকে পড়া বা দল নিরপেক্ষ মানুষগুলো এখন কোনোরকম খেয়ে-পড়ে বাঁচতে পারলে যেন বর্তে যায়। এদেশে একটি বালিশের ক্রয়মূল্য আট-দশ হাজার, আর সেই বালিশ ঘরে তুলতে আরও হাজার টাকা খরচ হয়। এদেশে একটি বই পঁচাশি হাজার টাকায় খরিদ করে কোনো কোনো কর্তৃপক্ষ, ভাবা যায়?

- নারীর প্রতি সহিংসতা পূর্বের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এখানে শিক্ষার্থীকে দিন-দুপুরে পুড়িয়ে মারা হয়। দিনের আলোয় কুপিয়ে হত্যা করা হয় কিশোর আর পিটিয়ে মারা হয় বুয়েট শিক্ষার্থীকে, শিশুকন্যারাও পুরুষের লোলুপ থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

- পরমত অসহিষ্ণুতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ইত্যাদি কোন পর্যায়ে পৌছালে বাবার কাছে মেয়ে ধর্ষিত হয়, অন্যকে ফাঁসাতে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে শিশু সন্তানকে জবাই করে বাবা-চাচা, স্ত্রীকে স্বামী! বিপদে যাদের সহায়তা নিকট সাহায্য পাওয়ার কথা, সেই রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় দেখা দিচ্ছে। আইন সভার একজন সদস্য হয়েও নিজের নামে পরীক্ষা দিতে ভাড়া করে প্রক্সি পরিক্ষার্থী!

- শিক্ষক, চিকিৎসকের মত বিশেষ এবং স্পর্শকাতর পেশায় নিযুক্ত অনেকের নৈতিকতায়ও ঘটেছে ভয়াবহ অধ:পতন। যারা মূলকাজের বাইরে গিয়ে আর্থিক- অনৈতিক নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। গত কয়েকদিনে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম-দূর্ণীতি নিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তা তো রীতিমত মগের মুলুক, ভাবনার অতীত!

- রাজনীতি থেকে আদর্শ উধাও। রাজনীতি মানে ক্ষমতা, যা ইচ্ছে তাই করার স্বাধীনতা-এমনটাই আজ দুঃখজনক বাস্তবতা। রাজনীতিতে এখন কদর অশিক্ষিত, টাউট, বাটপার, সন্ত্রাসী আর মাস্তানের। রাজনীতির মাফিয়ারা টাকা আর অন্যায় সুযোগ তৈরি করে দেয়ার বিনিময়ে সণ্ডাদের পুষছেন।

- রাজনীতিতে ইতিহাসের শিক্ষা এখন কেঁদে মরছে। কমরেড তাজুল, নূর হোসেন, ডা. মিলনসহ আরও অনেক শহীদের রক্তের দাগ এখনও শুকায়নি। তাঁদের রক্তের দাগ পিষ্ট করে স্বৈরাচার, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে আপোষ করতে দ্বিধা করেনি ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিক দলগুলো। পতিত স্বৈরাচার এরশাদ বিগত ত্রিশবছরে ক্ষমতা আর রাজনীতির সমীকরণে সবচেয়ে দামী পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সমকালীন রাজনীতিতে তিনজোটের রূপরেখা একটি মাইলফলক অর্জন হলেও এর অরিজিনের সাথে সম্পৃক্ত কোনো দলই আর তা বিবেচনায় নিচ্ছে না! এ তো প্রহসন!

স্বাধীনতার মানে যদি হয় ক্ষমতা, অর্থ-বিত্ত তাহলে সেটা অল্পসংখ্যক রাজনীতিক আর তাদের দোসররা পেয়েছে, পাচ্ছে। স্বাধীনতার স্বাদ আপামর জনসাধারণ পায়নি, বরং পদে পদে প্রতারিত হয়েছে। আজ কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের জীবন মানে পেটে-ভাতে বেঁচে থাকার নিরন্তর চেষ্টা। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই এমন লক্ষ মানুষ শীত-বৃষ্টিতে খোলা আকাশে খুঁজে ফেরে জীবনের মানে। এদেশে সংখ্যায় লঘু হওয়ার কারনে আদিবাসী, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে নানা মাত্রায় নির্যাতিত হচ্ছে। রামু, নাসিরনগর, বাগদা ফার্ম বা হালের বোরহানউদ্দিন যার জ্বলন্ত উদাহরণ। ফলে সংখ্যালঘুদের একটি বড় সংখ্যা এতটুকু স্বস্তির আশায় দেশান্তরি হচ্ছে, বেছে নিচ্ছে অনিশ্চিত জীবন।

প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ কী পাচ্ছে তবে? এ প্রশ্নের উত্তর তো পেতেই হবে জনগণকে, না কি?

    
লেখক : মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী