• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০১৯, ০৫:১৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : নভেম্বর ২১, ২০১৯, ০৫:১৭ পিএম

সড়কে শৃংখলা রক্ষায় প্রয়োজন পরিবেশ উন্নয়ন

সড়কে শৃংখলা রক্ষায় প্রয়োজন পরিবেশ উন্নয়ন

সড়কে যানবাহনের শৃঙ্খলা আনার জন্য নতুন পরিবহন আইন ১ নভেম্বর ২০১৯ থেকে কার্যকর হয়েছে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল প্রতিরোধে যানবাহনের শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তার দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের এই উদ্যোগ। সাধারণ বিবেচনায় মানুষ মনে করে ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, চালক ও পথচারীদের ট্রাফিক সিগন্যাল না মানা, অবৈধ গাড়ি পার্কিং, থ্রি হুইলার পরিবহন ইত্যাদির সাথে মটর সাইকেল ও রিক্সা সড়ক ব্যবস্থাপনার প্রধান সমস্যা। নতুন পরিবহন আইনে অপরাধের শাস্তি বা জরিমানার দিকে তাকালে এমনটাই মনে হয়। যুগোপযোগী এ আইনটাতে সড়কে আগের তুলনায় গতি বাড়বে, শৃঙ্খলাও বাড়বে। 

ফলে সড়ক দূর্ঘটনা কমবে। তবে এই আইনের সাথে সংশ্লিষ্ট যানবাহনের মালিক, শ্রমিক ও পথচারীদের মধ্যে শ্রমিক ও পথচারীদের জন্য অর্থদণ্ডের পরিমানটা দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় খুবই কঠিন। তারপরও মানুষ আশা করছে এই আইনের যথাযথ প্রয়োগে সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। তবে এখানে সরকারকে আনুসাঙ্গিক কিছু কাজ আন্তরিকতার সাথে করতে হবে। শুধু আইন করে দায়িত্ব শেষ করলে হবে না।সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে সবচাইতে যা ভাল তা হচ্ছে মানুষ গুরুত্ব পেয়েছে। মোটর সাইকেল চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার করতে হয় ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। 

এখানে প্রধানত মোটর সাইকেল চালকের নিরাপত্তার কথা ভেবেই সড়ক পরিবহন আইনে ২০০ টাকার জরিমানা ১০ হাজার টাকা করা হয়েছে। মানুষকে ভাল না বাসলে এমন গুরুত্ব পাওয়ার কথা নয়। হেলমেটের সাথে সাধারণের কোন সংযোগ নেই। দেশে মোটরসাইকেল চালকরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মানসিকতা না থাকার কারণে হেলমেট ব্যবহার করতে চায় না। নিজের নিরাপত্তা রক্ষায় হেলমেট ব্যবহারে অবজ্ঞা করা কোনভাবেই উচিৎ কাজ নয়। নতুন আইনে শক্তভাবে সমস্যার মোকাবেলায় সচেতনতা সৃষ্টি হবে তা আশা করা যায়। তবে মোটর সাইকেলের সংখ্যা ২০১০ সালে সাড়ে ৭ লাখ ছিল ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ২৭ লক্ষ। এই বৃদ্ধি মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত করলেও দেশে সড়ক ব্যবস্থাপনার স্বার্থে কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিবেচনার দাবি রাখে। 

সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে প্রথমে সড়ক-মহাসড়কের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সড়ক পরিকল্পাবিদরা বলে থাকেন একটা দেশের জন্য ১০-১৩ ভাগ সড়ক থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশে সেখানে সড়ক আছে ৭-৮ ভাগ। বিদ্যমান সড়কগুলো চলাচল উপেযোগী রাখা যাচ্ছে না। সারাদেশে সড়ক উন্নয়নের মহাযঞ্জ চলছে। কিন্তু নির্মাণের জীবনকাল নেই। একপাশে সংস্কার বা নির্মাণ চলছে আর অন্য পাশ চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজসিক নির্মাণ কাজ চলছে।

 ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্প যা দুই বছরে নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল কিন্তু ১০ বছরেও নির্মাণ কাজ শেষ করা গেলো না। এই সড়কটি নির্মাণ করতে ১০ বছর লাগলেও তার জীবনকাল ১০ বছর হবে এমন নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দেশে এমনিতে প্রয়োজনের তুলনায় সড়ক কম তার উপর যদি সড়ক চলাচল অনুপযোগী থাকে তাহলে যত কঠোর আইন করা হোক না কেন মুক্তি সম্ভব হবে না। সড়কের পাশে হাট-বাজার, সড়কের জমি দখল করে দোকান-পাট নির্মাণ, সড়ক দখল করে পার্কিং ও মেরামত কাজ পরিচালনা ইত্যাদি কার্যক্রম বন্ধ করাসহ মানসম্মত সড়ক নির্মাণ করে সড়ক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা প্রয়োজন। 

দেশে যানবাহনের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। এই যানবাহন আমাদের সড়কগুলো ধারণ করতে পারে কিনা তা বিবেচনায় আনা অত্যন্ত জরুরী। জনসংখ্যার কারনে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি না। ২০১০ সালে যেখানে বাস-ট্রাকের সংখ্যা ছিল এক লাখ ১০ হাজারের মতো তা ২০১৯ সালে বেড়ে হয়েছে ২ লাখের বেশি। বাস-ট্রাকের সাথে পাল্লা দিয়ে মিনিবাস, মাইক্রোবাস, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, কার্গোভ্যান, ট্যাংকার, মোটরসাইকেল, অটোরিক্সা, হিউম্যান হলার, প্রাইভেটকার, ট্যাক্সিক্যাব, অ্যাম্বুলেন্স, ট্রাক্টর ইত্যাদি বেড়েই চলেছে।

 বিআরটিএ’র তথ্য মতে ২০১০ সালে সবরকমের যানবাহনের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ লাখ আর এবছর পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৪২ লাখ। বাস-ট্রাক দ্বিগুণ এবং মোট যানবাহন প্রায় তিনগুণ বাড়লেও অন্য অনেক যানবাহন ৪ থেকে ৫ গুণ বেড়েছে। জনস্বার্থে সাধারণ পরিবহন বৃদ্ধি মেনে নিতে বাধ্য হলেও ব্যক্তিগত পরিবহন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কারণ যানবাহন বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে দেশে সড়ক বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি। সড়কের সীমাবদ্ধতা এবং অনিয়ন্ত্রিত যানবাহনের সংখ্যা সড়ক ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এরপরেও মাথার উপর আছে অনেক অনিবন্ধিত যানবাহন। 

যানবাহনের সংখ্যা যে হারে বেড়েছে সে আনুপাতিক হারে সরকারের আয়ে বাড়েনি। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা বিষয়টি নজরে এনেছে কিনা জানি না। তবে সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে এখানে ভুতের প্রভাব আছে। প্রতিবছর আয় বাড়ছে এতে সরকার খুশী। কিন্তু সেটা যে আনুপাতিক হারে বাড়ছে না কেন তার গোড়ায় যাবার কোনো প্রয়োজনীয়তা সরকার অনুভব করেনি।

 বরং ভুতেদের অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছে। এই ভূতরা তো মাঠেও আছে। তারা সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে সেটাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ করাতের দাঁতের প্রশাসনে জড়িয়ে যেতে ভয় পায়। আর এ সুযোগটাই মেঠো ভূতেরা ভালভাবে নিয়ে থাকে। কারণ মেঠো ভূতেদের কাছ থেকে অল্প ঝামেলায় মুক্তি পাওয়া যায়। তাই পুরানো আইনে যেখানে একশ বা দু’শ টাকায় ঝামেলা মুক্তি ঘটতো এখন নতুন আইনে তা মেটাতে ৫ হাজার বা ১০ হাজার টাকার প্রয়োজন পড়বে। উন্নয়নশীল নয় উন্নত দেশের বাসিন্দা বলে কথা। 

প্রধানমন্ত্রী গত বছরের জুন মাসে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল রোধে এবং সড়ক শৃঙ্খলা ফেরাতে ৬ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন । সেগুলো হলো ১. দূরপাল্লার গাড়ীতে বিকল্প চালক রাখতে হবে। ২. একজন চালক দৈনিক ৫ ঘন্টার বেশি গাড়ী চালাবেন না, সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, ৩. গাড়ী চালক ও সহকারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

৪. নির্দিষ্ট দূরত্বে সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করতে হবে, ৫. অনিয়মতান্ত্রিকভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, ৬. চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করতে হবে । সড়ক দূর্ঘটনা রোধ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী যথাযথই নির্দেশনা দিয়েছেন। সার্বিক পরিবেশ উন্নয়ন না হলে শুধু আইন করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তাই প্রাথমিকভাবে সড়ক ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ উন্নয়ন জরুরি। পরিবেশ উন্নয়ন হলেই জাতিসংঘের ঘোষণা এবং বাংলাদেশের অণুসমর্থন বিবেচনায় ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দূর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। 

গত বছর আগষ্টে সড়ক দূর্ঘটনায় এক শিক্ষার্থী নিহত হবার পর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে।  তারা রাজধানীর ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে সরকার ও সাধারণ মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছিল শুধু সদিচ্ছা থাকলে কিভাবে সড়ককে নিরাপদ রাখা যায়। বিদ্যমান আইনের সড়ককে নিরাপদ রাখা যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ কোমলমতি শিশু কিশোরদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বরং এর পরপরই সড়ক শৃঙ্খলা ফেরাতে একটা উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে।

 কমিটি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এবং কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। সড়ক শৃঙ্খলা ফেরাতে আইনের চাইতে এসবের প্রয়োজনীয়তা অনেক। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সে পথে না হেঁটে  নতুন সড়ক আইন -২০১৮ পাশ করে। আধুনিক, নিরাপদ সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসহ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ কামনা করি। পাশাপাশি আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠুক। আশা করা যায় এতেই সড়ক শৃঙ্খলা ফিরবে। সাধারণ মানুষ নিরাপদ সড়ক পাবে। মৃত্যুর মিছিল নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। 
    
 লেখক : প্রাবন্ধিক,সাবেক সভাপতি, ইনষ্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)