• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২, ২০২০, ০১:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ২, ২০২০, ০১:৪৭ পিএম

প্রযুক্তির ত্রুটিতে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গ

প্রযুক্তির ত্রুটিতে তারুণ্যের স্বপ্নভঙ্গ
ড. মো. নাসিম আক্তার

তেইশ বছরের শিক্ষকতা জীবনে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই চিন্তা করেছি শির্ক্ষাথীদের মঙ্গলের কথা। তাদের মন ও মননের বিকাশে সর্বদা নিজের চিন্তা চেতনাকে জাগ্রত রেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সেমিষ্টারে ফলাফল প্রস্তুতের সময় আমরা সবসময় খেয়াল রেখেছি কোনভাবে যেন আমার উদাসীনতা শিক্ষার্থীর স্বপভঙ্গ না করে।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মে বিষয় ভিত্তিক তত্বীয় পরীক্ষার প্রথম পত্র, দ্বিতীয় পত্র ও উপস্থিতির নম্বরসহ মোট ৩০০ নম্বর হয়। নূন্যতম পাশ নম্বর ১২০। কম্পিউটারে ডাটাএন্ট্রি করে যোগফল যদি ১১৯ হয় তাহলে ফলাফল তৈরীর সফটওয়ারের যুক্তির বদৌলতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা ১২০ হয়ে যায়। আবার যদি কোন ছাত্র কোন বিষয়ে ৭৯ পায় তাহলে তাকে আমরা সাধারণত ৮০ করে দেই। এটাই আমাদের ছাত্রদের প্রতি সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এবার এস.এস.সি. পরীক্ষায় খেয়াল করলাম বহু ছাত্র ৭৯ পেয়ে ‘এ’ পেয়েছে। শিক্ষক হিসেবে বিষয়টি মেনে নিতে আমার ভীষন কষ্ট হচ্ছে। কারণ মানুষ তৈরীর কারিগর শিক্ষকের হাতে বিষয়টি থাকলে তারা এমন প্রান্তিক নম্বরকে বাড়িয়ে ৮০ নম্বর করে দিতেন, তা শিক্ষক হিসেবে আমি ১০০ ভাগ হলফ করে বলতে পারি। সারা বিশ্বে শিক্ষকেরা ছাত্রদের আগ্রহ ও উদ্দীপনা বৃদ্ধিতে এভাবেই কাজ করেন।

আমি কিছু কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা দেখেছি যেখানে দুজন পরীক্ষক পরীক্ষার খাতায় কোন নম্বর না দিয়েই নম্বরপত্রে নম্বর তুলে খাতা দেখেন। তারপরে যদি দুজনের পরীক্ষিত মোট নম্বররে পার্থক্য ষোল হয় সেক্ষেত্রে ঐ রোল নম্বরগুলির খাতা তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। তৃতীয় পরীক্ষকের খাতা দেখার বিষয়টিও প্রায়শ ঘটে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিভেদে খাতা দেখার নম্বরের পার্থক্য হয়। যে বিষয়টি বললাম এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিষয়। এক্ষেত্রে খাতার সংখ্যা একশটির বেশী হয় না। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে অল্প সময়ে অধিক খাতা দেখতে দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে, শিক্ষার্থীদের প্রতি নিজের অজান্তেই খাতা দেখায় বৈষম্যের সৃষ্টি হতে পারে। স্কুল কমিটির অবিভাবক প্রতিনিধি থাকায় দেখেছি শিক্ষকভেদে কখনো কখনো সঠিক উত্তরে শুন্য দিয়েছে আবার ভুল উত্তরে নম্বর দিয়েছে। একজন হেড এক্সামিনারের সাথে কথা বলছিলাম এই নিয়ে। তিনি মজা করে বললেন, ‘আজকাল নম্বর দেওয়ার প্যাটার্ন ১,১,২,৩- এটাই ফলো করা হয়। কারন এতখাতা ঠিকমত পড়ে বেশিরভাগ শিক্ষকই সঠিক পরীক্ষণ করেন না’। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা শিক্ষক হিসেবে নিজেদেরই বদনাম করা হয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটাই রূঢ় বাস্তবতা। তাই বলা যায় পরীক্ষা দিয়ে কেউই বলতে পারবে না কি ঘটবে তার ভাগ্যে’।  

করোনার মত মহামারী যখন আমাদের দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে, সংগত কারনেই সবাই বাসায় থাকতে থাকতে মানসিকভাবে বিষাদগ্রস্ত। এমন অবস্থায় কোমলমতি ছাত্রদের ৭৯ নম্বর ৮০ না করে ৯ কমিয়ে ৭০ নম্বর করা শিক্ষার্থীদের জন্যে নতুন দুঃখের অবতারনা। মাধ্যমিকে প্রতিটি গ্রেডের পার্থক্য ১০ নম্বর। অর্থ্যাৎ একজন ছাত্রের ৭০ থেকে ৭৯ নম্বর পর্যন্ত ‘এ’ গ্রেড যার সাংখ্যিক মান ৪। আরো গভীরভাবে চিন্তা করলে ৭০ পাওয়া আর ৭৯ পাওয়া ছাত্রকে কি এক মাপকাঠিতে বিচার করা যায় ? তাই ৭৯ এর পরিবর্তে যখন আমি ৪ বা ‘এ’ গ্রেড দিচ্ছি প্রকৃতপক্ষে তার নম্বর ৯ কমে ৭০ হয়ে যাচ্ছে। এখন আমার প্রশ্ন গ্রেড রক্ষায় কারোর নম্বর ৯ কমানো উচিৎ নাকি তাকে উৎসাহিত করার জন্যে তার গ্রেড এক বাড়িয়ে ‘এ+’ এ উন্নীত করা উচিত। এক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ডের রেজাল্ট প্রসেসিংয়ের যে সফটওয়্যার আছে তাকে সামান্য পরিবর্তন করলেই বহুনির্বাচনী প্রশ্নের নম্বর ও লিখিত প্রশ্নের নম্বর যখন যোগ করে ৭৯ হবে তার স্থলে স্বয়ংক্রিয় ভাবে এক বেড়ে ৮০ নম্বর হয়ে যাবে। এতে শিক্ষার্থীর উদ্দীপনা ও উৎসাহ বাড়বে। আমি এমন পরীক্ষার্থীকে জানি যার দুটো বিষয়ে ৭৯ থাকার কারণে গ্রেড পয়েন্ট এসেছে ৪.৭৮। মোট নম্বর ৯২৩ কিন্তু ৯২৫ হলে জিপিএ ৫ হত। অর্থাৎ মাত্র দুই নম্বরের জন্য তার জিপিএ ৫ এর সাথে ব্যবধান হচ্ছে ০.২২ যা সত্যি একজন শিক্ষর্থীর জন্য হৃদয়বিদারক। কারণ এটা পি.এস.সি. অথবা জে.এস.সি. এর রেজাল্ট নয়।

সারাজীবনের জন্য সংরক্ষণ করার মত একটি রেকর্ড। করোনার মত মহামারীতে ঘরবন্দী হয়ে জীবন ভীষন ক্লান্ত। কোন দিকে আনন্দের বার্তা নেই। এমন মুহুর্তে ফলাফল পূনঃনিরীক্ষণের সময় আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ৭৯ নম্বরকে ১ নম্বর বাড়িয়ে ভবিষ্যৎ জীবনে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে উৎসাহিত করলে ভাল বৈকি মন্দ হবে না।  শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান সহ অন্যান্য কর্মকর্তা সাধারণত প্রেষণে বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসেন। তারা সবাই শিক্ষক। তাই আমাদের অনুরোধ তারা যেন শিক্ষকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়টি আন্তরিকতার সহিত বিবেচনা করেন।

শিক্ষকদের যতই বদনাম বলি না কেন, অতীতে যখন ১০০ নম্বর মুল্যায়ন শিক্ষকের হাতেই ছিল, তখন শিক্ষকগণ ৭৯ পেলে অবশ্যই ৮০ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তাই অতীতে এই ধরণের সমস্যার উদ্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে বহুনির্বাচনী প্রশ্ন ও লিখিত অংশের নম্বর কম্পিউটার এর মাধ্যমে যোগ হয়ে ৭৯ নম্বর হচ্ছে তখন সফটওয়ারে স্বয়ংক্রিয় ভাবে ৮০ করার জন্য কোন ব্যবস্থা নেই যা শিক্ষর্থীর স্বপ্নকে ভঙ্গ করছে। দোষ চাপানো হচ্ছে প্রযুক্তির উপর। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে প্রযুক্তিকে আমরা নিয়ন্ত্রন করব। প্রযুক্তি আমাদের নিয়ন্ত্রক নয়। শিক্ষার্থীদের পরিণতির জন্যে কম্পিউটারের মত আবেগ, অনুভূতি বা হৃদয়হীন একটি যন্ত্রের উপরে দোষ চাপিয়ে আমরা বিবেকবান মানুষ কি দায়মুক্ত হতে পরি ? এটা কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিনীত জিজ্ঞাসা। করোনায় প্রত্যেকটি জীবন অনিশ্চয়তার দোলাচলে। শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উৎসব আমরা পালন করতে পারছি না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু কিশোরদের সাথে সময় কাটাতে ভালবাসতেন। একারনেই  জাতিসংঙ্ঘ কর্তৃক শিশুদিবস ২০শে নভেম্বর পালন করা হলেও আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন তথা ১৭ই মার্চে পালন করা হয়। তাঁর জন্ম শতবৎসরে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে প্রান্তিক ৭৯ নম্বরকে ৮০ নম্বরে পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন রক্ষার একটি যৌক্তিক উদ্যোগ মুজিব জন্ম শতবর্ষের উপহার হিসেবে তারুণ্যের স্বপ্ন বুননে চিরস্বরণীয় হয়ে থাকবে।  

লেখক
অধ্যাপক
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,
গাজীপুর-১৭০৭

★★ প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। দৈনিক জাগরণ-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে লেখকের এই মতামতের অমিল থাকাটা স্বাভাবিক। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য দৈনিক জাগরণ কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না। এর দায় সম্পূর্ণই লেখকের।