• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ০৭:১৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ০৭:১৫ পিএম

ভাস্কর্য ও মূর্তি

ভাস্কর্য ও মূর্তি
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন। ফাইল ফটো

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এখন মুখ্য আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাস্কর্য ও মূর্তির বিষয়টি। যারা বিতর্কে বা আন্দোলনে লিপ্ত, তারা কি জানেন আসলে ভাস্কর্য কি? এ সম্পর্কে কতটুকু জানারই-বা চেষ্টা করছেন তারা? ভাস্কর্য বা মূর্তি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা অনেকটা কান চিলে নিয়ে গেছে অবস্থার মতো। কানে হাত না দিয়েই কেউ কেউ দৌড়াচ্ছেন চিলের পেছনে। ভাস্কর্য বা মূর্তির প্রভাবে কোনো ধর্ম ক্ষতিগ্রস্ত বা লাভবান হওয়ার কথা নয়।

ভাস্কর্যের ইংরেজি শব্দ Sculpture. এক ধরনের ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্মকে ভাস্কর্য বলা হয়। অর্থাৎ জ্যামিতিক শাস্ত্রের ঘনকের ন্যায় ভাস্কর্যকে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ এবং গভীরতাসহ ত্রিমাত্রিক হতে হবে। ভাস্কর্য একটি প্রাচীন শিল্পকর্ম। মানুষ বর্ণ বা হরফ লেখার প্রচলনের বহু আগ থেকেই ভাস্কর্য তৈরি করতে শিখেছিল। আর ভাস্কর্যের মাধ্যমে মানুষ নিজেদের ঐতিহাসিক নির্দশনগুলো নতুন প্রজন্মের জন্য রেখে যায়। তবে প্রাচীনকালের ভাস্কর্যগুলোর শৈল্পিক নকশা বা নিপুণতা বর্তমান সময়ের মতো ছিল না। বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ পৃথিবীর সব দেশেই ভাস্কর্যের প্রচলন রয়েছে। রেনেসাঁ এবং আধুনিককালে ভাস্কর্য শিল্পকর্মটি ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের সভ্যতা যে প্রাচীন, তার প্রমাণ মেলে এই অঞ্চলে পাওয়া ভাস্কর্যগুলোর নিদর্শন থেকে। মানবসভ্যতার উন্মেষকালে ভারতীয় উপমহাদেশের জনপদে বসতি গড়ে উঠেছিল। সেই সময় ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে জনবসতিগুলো এ উপমহাদেশের মতো সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩৫০০ বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় ভাস্কর্যের উপস্থিাতি। এ উপমহাদেশের অংশ বর্তমানে যা পাকিস্তান, সেখানে রয়েছে হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা। ভারতে ব্রোঞ্জ ও পাথর খোদাই করা ভাস্কর্যগুলোর মাধ্যমে এ উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে। তা ছাড়া ইলোরা এবং অজন্তার পাথরে খোদাই করা ভাস্কর্যগুলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদাপূর্ণ ভাস্কর্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ ও ষষ্ঠ শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যর মথুরা নগরের বেলেপাথর দিয়ে গড়া ভাস্কর্যগুলো সৌন্দর্যটা উন্নত রুচির পরিচয় বহন করে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন ধ্রুপদী যুগে বাংলাদেশ অঞ্চলটিতে বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড়, গঙ্গাঋদ্ধি, সমতট ও হরিকেল নামক জনপদ গড়ে উঠেছিল। সুতরাং এই নির্দশনগুলো প্রমাণ করে পৃথিবীর আদি সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল এই উপমহাদেশে। ভাস্কর্য নিয়ে যারা বিতর্কের সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন, তারা সভ্যতার পুরাকীর্তিগুলো ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। এর ফলে সভ্যতার ইতিহাস অনুশীলনের বিকাশমান ধারাটি লোপ পাবে। প্রাচীন ইতিহাসের জ্ঞান বর্তমানকে সমৃদ্ধ করে। আর আগামীর পথচলাকে সঠিক নির্দেশনা দেয়। তাই আজকে একদল মানুষ ধর্মের মোড়কে নিজেদের আচ্ছাদিত করে আগামী প্রজন্মকে সুশিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার বা সুশিক্ষা যাতে না পায় এ রকম একটি ক্ষেত্রটি সৃষ্টি করতে চাইছেন, ভাস্কর্যের বিরুদ্ধি আন্দোলন করছে। অনেকেই বলবেন, বর্তমান ইতিহাস তো লিপিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে। তা হলে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য কি ভার্স্কযের প্রয়োজন কি? নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলায় পাহাড়পুরে এবং কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে প্রাচীন পুরাকীর্তি পাওয়া গেছে। এ দুটি স্থানে কিছু তাম্রলিপিও পাওয়া যায়। এই ঐতিহাসিক স্থানে পাওয়া তাম্রলিপিতে ওই সময়কার ঘটনা বা ইতিহাস লেখা আছে। কিন্তু ওই তাম্রলিপিতে কি লিখা আছে তা পড়তে কি কেউ পেরেছেন। পড়তে না পারার কারণ ওই সময়কার ব্যবহৃত অক্ষর বা বর্ণগুলোর সাথে বর্তমানের কোনো মিল নেই। তবে অনুমান করা হচ্ছে যে, ওইগুলো প্রায় ১০ হাজার বছর আগের তাম্রলিপি । বিষয়টি কি দাঁড়ায়, এটা বাংলা জনপদের একটি প্রাচীন নিদর্শন; অথচ এর সাথে বাংলা হরফের মিল নেই। এর কারণ হলো, কালের বিবর্তনে ওই সময়কার বর্ণের পরিবর্তন সাধিত হতে হতে আজকের বাংলা অক্ষর বা বর্ণ এসেছে, যেগুলো এখন বাংলা ভাষায় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু লিখিত কোনো ইতিহাস না পাওয়া গেলেও ওই সময়কার ভাস্কর্যের মাধ্যমে তখনকার সময়ের মানুষের জীবনযাপনের প্রণালিটি সম্পর্কে জানা যায়। আজ থেকে ১০ হাজার বছর পরে নানা ধরনের বিবর্তনের ধারায় বর্তমান সভ্যতার পরিবর্তিত হতে পারে বা হবে এটাই স্বভাবিক। তখন পুরাকীর্তি বা ভার্স্কযগুলোও ইতিহাস পাঠের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াবে। 

মূর্তি যা বিগ্রহ নামে পরিচিত। এর ইংরেজি শব্দ হলো Fetish. Fetish-এর আক্ষরিক অর্থ হলো অবয়ব। পৃথিবী কিছু সনাতন ধর্ম পালনকারী মানুষ দেবতার অবয়বে মূর্তি তৈরি করে । আর এই মূর্তিগুলো তাদের দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে তাদের কাছে বিবেচিত হয়। মহাপুণ্য লাভের আশায় দেবতার অবয়বে গড়া বিগ্রহকে তারা পূজা করে থাকেন। মূর্তি সাধারণত ধর্মীয় সংস্কার বা শাস্ত্রের নির্দেশে নির্মিত হয়ে থাকে। মূর্তিকে পূজা করার নির্ঘণ্ট বা সময় নির্ধারিত হয় ধর্মীয় শাস্ত্রানুসারে। মূর্তিতে তিথি, লগ্ন, ক্ষণানুসারে দেবতার অবগাহন এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠার পরই সানতন ধর্ম পালনকারীরা সেই মূর্তিকে পূজার যোগ্য মনে করেন। মূর্তি পূজার যোগ্য হলেই তাতে তারা পূজার্ঘ্য অর্পণ করেন। উপমহাদেশে যারা হিন্দু ধর্ম পালন করে থাকে, তারা মনে করেন দেবতারূপী মূর্তি ধর্ম পালনকারীদের ধ্যানের জন্য বিশেষ সহায়ক একটি বিষয়। এ প্রসঙ্গে শ্রী কৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেন, ‘দেহধারী মানুষের পক্ষে সাকার ঈশ্বরের তুলনায় নিরাকার ঈশ্বরে মনঃসংযোগ করা অধিক কষ্টকর।’ তাই বাঙালি সমাজে যারা হিন্দু ধর্ম পালন করেন, তারা ঈশ্বররের নৈকট্য লাভের উদ্যেশ্যে মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করে থাকেন। শিল্প শাস্ত্রের নির্দেশানুসারে মূর্তি নির্মাণ করা হলেও, প্রাণ প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরোহিতরা ওইসব মূর্তিকে পূজার উপযোগী করে তোলেন। 
বাংলাদেশে বর্তমানে মূর্তি বা ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলন করছেন কিছু ধর্মান্ধ মানুষ। তাদের এই আন্দোনের উদ্দেশ্য হলো ইসলাম ধর্মের পবিত্র রক্ষা করা। তাদের এই দাবি কতটা যৌক্তিক? বিমানবন্দরে মরমি সাধক, বিশ্ব মানবতাবাদী লালন শাহের ভাস্কর্যটি স্থাপন করতে তারা দেয়নি। তাদের আন্দোলনের চাপের মুখে হাইকোর্টের ন্যায়বিচারের প্রতীক গ্রিক দেবীর ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, যারা ভাস্কর্য বা মূর্তিবিরোধী আন্দোলন করছেন, তারা কি নিরাকার না সাকার ঈশ্বরের বিশ্বাসী? কারণ কোনো মূর্তিতে দেবদেবীর অবগাহন না হলে তা পূজার উপযোগী হয় না। আর মূর্তিকে পূজার উপযোগী করতে হয় পুরোহিতের মাধ্যমে। বিমানবন্দর বা হাইকোর্টের সামনে ভাস্কর্যটি কোনোদিনই পূজার উপযোগী হবে না। তা হলে এগুলো দিয়ে কি করে ধর্মের পবিত্রতা ক্ষুণ্ণ হলো? যারা আন্দালন করছেন, তারা কি ভাস্কর্য বা মূর্তি দেখলে ওই অবয়বে দেবদেবী অবগাহন করেছে এমন চিত্রটি দেখতে পান। আন্দোলনকারী কি সনাতনী পুরোহিতরা যেভাবে মূর্তির মাঝে দেবদেবীকে অবগাহন করায়, সেই প্রক্রিয়াটি বর্তমানে নির্মিত ভাস্কর্য বা মূর্তিগুলোতে দেখতে পান। যদি তারা বিগ্রহে এ ধরনের বিষয়টি দেখতে পান, তা হলে তাদের ঈমানের জোর কতটুকু আছে? যদি না পান, তা হলে কেন আন্দোলন করছেন? যদি তাদের ঈমানের শক্তি ধর্মের প্রতি যথার্থই থেকে থাকে, তা হলে এ ধরনের আন্দোলন করাটা তাদের উচিত নয়। সুতরাং সকল বিগ্রহ বা মূর্তি পূজার উপযোগী নয়; আর ভাস্কর্য তো অনেক দূরের কথা। উপমহাদেশের কোনো সনাতন ধর্মের পুরোহিত কি মেনে নেবেন, রাস্তাঘাটের পাশে নির্মিত সব বিগ্রহ বা মূর্তি পূজার উপযোগী। তা কখনোই মানবেন না। কারণ তাদের ধর্মমতে বোধনের মাধ্যমে দেবদেবীকে মূর্তিতে অবগাহন করানো হয়নি। যারা আন্দোলন করে বিশেষ একটি ধর্মপালনকারীর দিকে ঢেলে দিচ্ছেন ভাস্কর্য শিল্পকর্মকে, ওই ধর্মপালনকারীরা কিন্তু তা গ্রহণ করবেন? তা ছাড়া কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ রয়েছেন, তারা যে মানসিক বিকারগ্রস্ত তা তাদের কথাই ফুটে ওঠে। ময়মনসিংহ শহরে মহারাজা শশীকান্তের বাড়ির সামনে অবস্থানরত গ্রিক দেবীর একটি মূর্তি রয়েছে। এই উলঙ্গ মূর্তি দেখলে নাকি জৈবিক তাড়নার সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কিছু মানুষকে মূর্তিটা সরিয়ে ফেলার জন্য স্টেটাস দিয়েছেন। যারা পাথরের মূর্তি দেখে জৈবিক তাড়না রুখতে পারে না, তারা এক ধরনের অসুস্থ। এই অসুস্থদের সোসিও সাইকোলজিস্টদের দিয়ে সরকারের উচিত চিকিৎসা করানো। 
 ভাস্কর্য়ের প্রভাবে কোনো ধর্মের স্বকীয়তা বৃদ্ধি পায় না, আবার এর প্রভাবে কোনো ধর্মের পবিত্রতাও নষ্ট হয় না। একটি জনপদে বিভিন্ন ধরনের মানুষ বাস করেন। প্রত্যেকেই তার নিজস্ব বিশ্বাসমতে নিজস্ব ধর্ম পালন করে থাকেন। ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। তাই ঐতিহ্য বা কৃষ্টির শিল্পকর্মগুলোকে ধর্মীয় বেড়াজালে আবদ্ধ করার চেষ্টাটা হলো এক ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরির অপচেষ্টা। এ ধরনের আন্দোলন করার পেছনে যে একটা রাজনৈতিক হীনউদ্দেশ্য কাজ করছে, তা যে কেউ সহজেই অনুধাবন করতে পারছে। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি হাসিলের জন্য ধর্মকে ব্যবহার করা উচিত নয়।
তাই রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এখন জরুরি। 

লেখক : কলামিস্ট