• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৭, ২০২১, ০৭:২৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জানুয়ারি ২৮, ২০২১, ০৭:৩৬ পিএম

চসিক নির্বাচন

বিচারহীন-বিকারহীন যে প্রাণের অপচয়

বিচারহীন-বিকারহীন যে প্রাণের অপচয়

স্বাস্থ্যঝুঁকিতে স্থগিত হয়ে পড়া চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচন অবশেষে অনুষ্ঠিত হলো। দশ মাস পর যে নির্বাচন দেখা গেল চট্টগ্রামে, সেখানে একাধিক প্রাণের অপচয় হয়েছে। নির্বাচনি সহিংসতায় দুইজনের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে এসেছে। সহিংসতায় প্রাণের অপচয়ের এই ঘটনাগুলোর বিচার আমরা দেখি না। বিচারহীন হয়ে থাকা এই হতাহতের ঘটনাগুলো নির্বাচনি ব্যবস্থার দুর্বল দিক। এই হতাহতের ঘটনাগুলো নিয়ে নীতিনির্ধারকদের খুব বেশি ভাবতে দেখি না। নির্বাচনের আগে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু কেন্দ্র নির্ধারণ আর সেখানে নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু সদস্যের উপস্থিতি ছাড়া তাদের যেন আর কোনো দায়িত্ব নেই! এই ঘটনাগুলোর বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। ফলে প্রাণের অপচয় ও ক্ষয়ক্ষতির শিকার কেবলই সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো।

প্রাণের অপচয়ের ক্ষতিপূরণে প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যেখানে সম্ভব না, সেখানে আর্থিক ক্ষতিপূরণের উদাহরণও এখানে বিরল। ফলে যার যায় সেই কেবল টের পায় কী ক্ষতি হয়েছে তাদের। আর অন্যদের কাছে সেটা কেবলই এক সংখ্যা। মানুষের জীবনটা এভাবে স্রেফ একটা সংখ্যা হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এখানে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা হয়ত হিসাব কষে দেখেন কত কমসংখ্যক মানুষ হতাহত হলো। সংখ্যার হিসাবের এই ন্যূনতম সংখ্যাটাই তাদের সাফল্যের মাপকাঠি। কী ভয়ানক অমানবিকতা এটা, ভেবেছেন কি কেউ কখনো!

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এবারের নির্বাচন নানা কারণে আলোচনার দাবি রাখে। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় দশ মাস আগে নির্বাচনের আটদিন আগে স্থগিত হয়েছিল। গত বছরের ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এই নির্বাচন। কিন্তু ওই মাসেই দেশে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী ‘সরকারি ছুটি’র নামে অনানুষ্ঠানিক ‘লকডাউন’ ঘোষিত হওয়ার প্রাক্কালে নির্বাচন স্থগিত করা হয়। করোনার সেই সময় আর আজকের এই সময়ের মধ্যে পার্থক্য আগে সরকারি ছুটির নামে অনানুষ্ঠানিক লকডাউন ছিল, এখন সেটা নেই। তবে আগে যেমন করোনার সংক্রমণ ছিল দেশে, এখনো আছে। লোকসমাগমে আগে যেমন ছিল স্বাস্থ্যঝুঁকি, এখনো এই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। যদিও ওই সময়ে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারি নির্দেশিকাগুলো কাগজে-কলমের পাশাপাশি বাস্তবেও কিছুটা দৃশ্যমান ছিল। কিন্তু সেটা এখন নেই। আগের নির্দেশিকাগুলোও বলবৎ আছে। এখনো তবে সেটা কাগজে-কলমে।

দশমাস আগের মতো এখনো দেশে করোনা আছে। তবে নিকট অতীতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে, জাতীয় সংসদের একাধিক আসনের উপ-নির্বাচন হয়েছে আর এখন চলছে কয়েক ধাপের পৌরসভা নির্বাচন। ইতোমধ্যে দুই ধাপের পৌরসভা নির্বাচনও সম্পন্ন হয়েছে। এই মাসে আরেক ধাপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সূচিও রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় জনসমাগম এড়াতে এই নির্বাচনগুলোর আয়োজন থেকে নির্বাচন কমিশন সরে আসেনি। এখানে যদিও স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে তবে নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাসহ দেওয়ার মতো আরো আছে দেশে-দেশের নির্বাচন আয়োজনের উদাহরণও। এখানে স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি নীরবে নিভৃতে কাঁদলেও এটাও জায়েজিকরণ ফর্মুলায় ফেলা যায় মূলত যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের নির্বাচনের দৃষ্টান্তকে উপস্থাপন করে। এখানে তাই নির্বাচন কমিশনকে একবাক্যে দোষারোপ করা যাচ্ছে না। তবে যেখানে করোনাকালের স্বাস্থ্যঝুঁকি বর্তমান সেখানে বিষয়টির উপস্থাপনা নিশ্চয়ই বাহুল্য নয়।

যাই হোক, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটল তার বিচার হবে না বলেই শঙ্কা। যারা আহত হলেন, যারা সংঘর্ষে জড়ালেন এখানে ন্যায়-অন্যায়ের বিচারও হবে না। কে অপরাধী এখানে আর অপরাধী নয় এটা স্রেফ দোষারোপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এই ঘটনাগুলো আইন-আদালতের আওতায় নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছাবে না বলে হতাহতের শিকার পরিবারগুলো ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। যারাই এই সহিংসতায় জড়িয়েছেন তারা নিজেদের দেহের রক্তের দিয়ে অন্যের উপরে ওঠার সিঁড়ি রচনা করে গেছেন শুধু। এখানে এর বেশি কিছু করেননি তারা। আমাদের অতীত অন্তত এই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

গত কয়েক বছর ধরে দেশের নির্বাচনগুলো নির্বাচন কমিশনের রুটিন কার্যক্রম বলেই অনুভূত হচ্ছিল। প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন জাতীয় নির্বাচন, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠের রাজনীতিতে অনুপস্থিতি, সরকারবিরোধীদের ওপর প্রশাসনের দমনপীড়নসহ অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভোটের মাঠকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন করে ফেলেছিল। এর বাইরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন নির্বাচনি মাঠে উত্তাপ ছড়ালেও সেটা এভাবে এত বিস্তৃতভাবে নিকট অতীতে দেখা যায়নি। চট্টগ্রামে যে প্রাণহানির ঘটনা ঘটল সেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফল বলেই গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘটিত এই সহিংসতার ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও হয়ত অভিন্ন। নির্বাচনের দিনের এই হতাহতের ঘটনার জের ধরে নির্বাচনোত্তর আরও সহিংস ঘটনা যে ঘটবে না সে নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। ফলে হিংসার যে ঘটনার প্রকাশ ঘটেছে সেটা সহসাই বন্ধ হওয়ার নয়!

প্রতি নির্বাচনের আগে কিছু কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণের তথ্য জানানো হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। নগরের ৭৩৫ কেন্দ্রের মধ্যে ৪১০টি কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করে সেসব জায়গায় চার স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার তথ্য জানানো হয়েছিল। সাধারণ কেন্দ্রে যেখানে দুইজন পুলিশ ও দশজন আনসার সদস্য দায়িত্বে রয়েছেন সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে এর সংখ্যা ছিল পাঁচ সশস্ত্র পুলিশ ও বারোজন আনসার সদস্য। এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা কি যথেষ্ট? তারা কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে? প্রশ্ন তুলছি, কারণ ওই নির্বাচনের একাধিক কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে; ঘটেছে হতাহতের ঘটনাও। এখানে দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও গাফিলতির ঘটনা ঘটেনি? দায়িত্ব পালনে অনীহা কিংবা কাউকে ছাড় দেওয়ার ব্যাপার কি এখানে ছিল? এসব খতিয়ে দেখা দরকার।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যকার সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেছে। এটা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ সংঘাত। তবে ভোটের দিন প্রশাসন নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকার কারণে এর দায় নির্বাচন কমিশনকেও নিতে হবে। এখানে কারো দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় প্রশাসন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এই হতাহতের ঘটনার দায় নিতে হবে। এখানে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার দাবি উচ্চাভিলাষ-সম মনে হলেও সুস্থ সমাজ ও সুষম রাজনৈতিক চর্চার পরিবেশ বিনির্মাণে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্যে দায়িত্বশীলদের প্রয়োজনে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

সিটি নির্বাচনে ‘মাত্র দুইজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে’ বিষয়টিকে এভাবে না দেখে নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পড়ল সেটাকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হিসেবে উপস্থাপন করে ‘নির্বাচন সফল’ দাবি করার মতো চিরায়ত কৌশলকে বাদ দিতে হবে। নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে— ঠিক এই বিষয়টির জন্যে ‘নির্বাচন পুরোপুরি সফল হয়নি’ এমন ভাবনা-জগতে প্রবেশ করে সামগ্রিক নির্বাচনি ব্যবস্থার সংস্কারের পথ রচনায় উদ্যোগী হতে হবে। এটা সম্ভব হলে প্রাণের অপচয়ের মতো ঘটনাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। তা না হলে এই প্রাণের অপচয়গুলো স্রেফ গুরুত্বহীন এক সংখ্যা বলেই নিরূপিত হবে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অমানবিক।

যেভাবেই হোক, যারাই হোক নির্বাচনে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। এই প্রাণের অপচয়গুলো বিচারহীন ও বিকারহীন হয়ে পড়লে সেটা হয়ে পড়বে মানবিকতার পরাজয়। জবাবদিহিকে অবজ্ঞা করে মানুষের প্রাণহানির ঘটনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনকে সফল দাবি করা হলে সেটা হবে লজ্জার। নির্বাচনি সহিংসতায় মানুষের মৃত্যুর যে লজ্জাজনক অমানবিকতার সাক্ষী আমরা এতদিন হয়ে আসছি, এই ধারার ধারাবাহিকতা রোধ করতে হবে। এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, সমর্থকদের দায়িত্বশীলতার পাশাপাশি নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি জরুরি।

মানুষের রক্তকে সিঁড়ি বানিয়ে চেয়ার দখল, মানুষের রক্তকে অবজ্ঞা করে ‘নির্বাচন সফল’ দাবি করা উচিত হবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক