• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৬:৩৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২১, ০৬:৩৩ পিএম

অভিজিৎ হত্যার বিচার

এই রায়ের কী অর্থ দাঁড়ায়? : বন্যা আহমেদ

এই রায়ের কী অর্থ দাঁড়ায়? : বন্যা আহমেদ

ছয় বছরের দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর অবশেষে বিচার পেয়েছি আমরা। সংবাদমাধ্যমকে এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকার দিতে না পারায় আমি দুঃখিত। তাই আমাদের প্রতিক্রিয়া আর যেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রয়োজন, সেটা এই বিবৃতিতেই উল্লেখ করছি।

২০১৫ সালে আমার প্রয়াত স্বামী অভিজিৎ রায় এবং আমি আমাদের জন্মভূমি বাংলাদেশে আসি। মূলত বইমেলায় অংশ নিতেই দেশে আসা হয়েছিল। সেইবার বইমেলাতে অভির দুটি বই প্রকাশিত হয়। ঠিক সেখানেই আমাদের ওপর উগ্র ইসলামপন্থী জঙ্গিরা হামলা চালায়। অভি মারা যায়, আর আমি কোনো রকমে বেঁচে যাই। তারপর আরও এক বছর দেশজুড়ে এমন হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে।

আজ (১৬ ফেব্রুয়ারি) আদালত সেই হত্যার রায় ঘোষণা করলো। অভিজিৎকে হামলাকারীরা বই প্রকাশ করার জন্য কিংবা বিজ্ঞান, দর্শন আর ধর্ম নিয়ে ব্লগ লেখার জন্য হত্যা করেছে কি না, সেটা বিচার করেছেন তারা। এই রায় আমার বা আমাদের পরিবারের জন্য কোনো সান্ত্বনার বাণী না। আমরা এমন কিছুর আশাতেও ছিলাম না।
আমি এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী এবং নিজেও হামলার শিকার। অথচ গত ছয় বছরে বাংলাদেশের একটা মানুষও তদন্তের স্বার্থে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। জানুয়ারিতে সরকারপক্ষের আইনজীবী সবার সামনে বললেন, আমি নাকি মামলার প্রতক্ষ্যদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিতে চাইনি। যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যাচার। সত্যটা হলো, বাংলাদেশ সরকার কিংবা এই বিচারকাজে জড়িত একটা লোকও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।

এবার রায় নিয়ে আমার মতামত জানাচ্ছি :
মামলার প্রধান দুই আসামি সেনা কমান্ডার সৈয়দ জিয়াউল হক, আর হামলাকারী জঙ্গিগোষ্ঠীর সমন্বয়ক আকরাম কেউই গ্রেপ্তার হয়নি। গত সপ্তাহে একই বছরে হামলায় নিহত অভির বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যার রায়ের সময় আমরা জানতে পারলাম যে, জিয়াউল হক আমাদের ওপর হামলার পর আরও আট মাস ধরে দেশের মুক্তমনা লেখক আর প্রকাশকদের হত্যার পরিকল্পনা করেছে। অথচ বাংলাদেশ সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
আজকের দিনে কোনো সভ্য দেশে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে রেহাই পাওয়া যায় না। কিন্তু ২০১৬ সালে মুকুল রানা ওরফে শরিফ নামের একজনকে ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়। আমাদের ওপর হামলা চালানো জঙ্গিদের মূল হোতা ছিল এই শরিফ।

ক্রসফায়ারে মারা যাওয়ার আগে শরিফ কয়েক মাস পুলিশের হেফাজতে ছিল। তাহলে কেন তাকে হত্যা করা হলো?  সে যদি বেঁচে থাকতো তাহলে কি সে অভিজিৎ হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে পারতো না?

দীপন হত্যার বিচারের সময় এক আসামি তার স্বীকারোক্তিতে বলেছে, “২০১৫ সালে ব্লগার, প্রকাশক আর সমকামীদের হত্যার জন্যে প্রচুর টাকা ঢালা হয়েছে।” আমি জানতে চাই, এই বিপুল অংকের টাকা কোত্থেকে এসেছে, তা কি কেউ তদন্ত করেছে? এই অর্থায়ন পেছনে কারা আছে বা হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা যারা, তাদের মুখোশ যদি উন্মোচিত না হয় তাহলে এই বিচার থেকে কী আশা করা যায়?

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অভি এবং আমি বিজ্ঞান লেখকদের আমন্ত্রণে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়েছিলাম। সেই অনুষ্ঠানের আয়োজকরা আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে বসিয়ে রাখেন। সন্ধ্যার দিকে তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথেই আমরা হামলার শিকার হয়েছি। অভির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে? তাহলে এই রায়ের কী অর্থ দাঁড়ায়?

মৌলবাদের মূল আর শাখাপ্রশাখাকে বাঁচিয়ে রেখে শুধুমাত্র সামনের সারির কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে অভি কিংবা অন্য ব্লগার, প্রকাশক আর সমকামীদের সেইসব ধারাবাহিক হত্যার বিচার করা সম্ভব না। আর তাই এই রায় আমার পরিবার কিংবা অন্য পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না।

(মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত ইংরেজি লেখা থেকে অনূদিত)

লেখক : নিহত অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী ও হামলার শিকার