• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২১, ১২:২৯ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ৩, ২০২১, ১২:২৯ পিএম

গেম অন

বাঙালির ক্রীড়া আবেগ এখন একমুখী

বাঙালির ক্রীড়া আবেগ এখন একমুখী

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আবেগের বিভাজন ছিল এবং সেটা মুলত দুই ধারায়: মোহামেডান ও আবাহনী। দেশ জুড়ে সেই আবেগের বিকেন্দ্রীকরণ্ও ছিল। কিন্তু রাজনীতির পাকেচক্রে সেই আবেগ এখন একমুখী! ভয়ঙ্কর রকম একমুখী! আর সেটা ক্ষমতাকেন্দ্রীক। সেখানে কে আবাহনী, কে মোহামেডান বোঝা দায়। কে কতবড় ক্রীড়াব্যক্তিত্ব কিংবা ক্রীড়াসংগঠক সেটা বোঝার একটাই উপায়—কে ক্ষমতার কত কাছাকাছি!

এই ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিদঘুটে ক্রীড়াঙ্গনের চেহারাটা প্রকাশ পেতে শুরু করে আশির দশকের শুরুতে—ক্ষমতা দখলকারী অগণতান্ত্রিক একটা সরকার, তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মন্ত্রী-মেয়র-এমপিদের ঢুকাতে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাব আর ফেডারেশনে। আর মাঠের সামান্য ঘটনায় খেলোয়াড়দের পাঠান কারাগারে! তারপরও বাংলাদেশের ক্রীড়া অলিন্দে আবাহনী-মোহামেডানের স্পন্দন অনুভুত হতো। মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মাঠের বাইরে সমর্থকদের বৈরিতা, সব মিলিয়ে দারুণ এক উতুঙ্গ অবস্থা। বাঙালির ক্রীড়া রোমাঞ্চ মানে আবাহনী-মোহামেডান!

কিন্তু রাজনীতি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের দুই বড় ক্লাবের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ওপর ‘পজ বাটন’ প্রেস করে দিয়েছে! অন্যদিকে, নয়া বিত্তশালীরা ক্রীড়াঙ্গনে করপোরেট বিনিয়োগ শুরু করলেন। সেই করপোরেট বিনিয়োগের কাছে হার মেনেছে আবাহনী, মোহামেডান। নামের পাশে তাদের যতই লিমিটেড লেখা থাকুক না কেন, তারা হার মেনেছে রাজনীতির কাছে। এই ক্লাবগুলো না চলছে পুরনো ধারায়, না এগুতে পারছে করপোরেট চিন্তার বাহক হয়ে!

মোহামেডানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যে ভাটার টান বেশ কয়েক বছর ধরে। সাফল্য খরায় ভুগতে ভুগতে ঢাকার সবচেয়ে সমৃদ্ধ ক্লাব মোহামেডান এখন নিঃস্তরঙ্গ। ক্ষমতালোভী আর ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা কিছু লোকের ‘ক্যাসিনো কাণ্ড’ গণমাধ্যমে শিরোণাম হয়েছে বটে, কিন্তু সাফল্য? সেটা বছরের পর বছর অধরাই থাকছে। কারণ, রাজনীতির ঝড়ো হাওয়ায় নিবেদিত প্রাণ ক্রীড়াসংগঠকরাই হারিয়ে গেছেন! মোহামেডানের এই দীনাতা ঘোচানো লোক কোথায়? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর দু’একজন লোককে ভাড়া করে এনে কী আর মোহামেডানের রুগ্ন চেহারা ফেরানো যাবে! সংশয় থাকছে। ক্রীড়ামনস্ক মানুষেরও মনে হয়, ঢাকার ক্লাব নিয়ে তেমন কোন আগ্রহ-কৌতুহল নেই। এই সব ক্লাবের নেপথ্যে কী হচ্ছে তা জেনে তাদের কী হবে!

কিন্তু তারপরও মোহামেডান দেশজ ক্রীড়াঙ্গনে এক সাতমহলা বাড়ির মত। যার সিন্দুকের মধ্যে গোপনে রাখা কত অভিজ্ঞতা, কত অপ্রকাশিত গচ্ছিত আবেগ। যা অনেককে কিছু সময়ের জন্য হলেও কৌতুহলী করে তোলে। অনেকের জীবনের পড়ন্ত বেলায় সেইসব আবেগ অন্যরকম উদ্দীপক হয়ে আবির্ভুত হয়। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘আহ, আমাদের সেই মোহামেডনা! সেখানে কত ঘটনার গায়ে সোনালী রং! কোনটার গায়ে সাদা। কোনটার ওপর পড়ে আছে কালো পোঁচ!’ সেই মোহামেডানে রং ফেরাতে নির্বাচন হচ্ছে। একটু ভুল বলা হলো। বৃহত্তর পরিসরে নির্বাচন শব্দটা এখন যেমন, মোহামেডানেও তেমন। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষ পর্যন্ত হয়তো একটা পরিচালনা পর্ষদ গঠন করা হবে। তারা মোহামেডানের চেহারা পাল্টাতে পারলে, আগামীতে বলা যাবে, মোহামেডানে নতুন যুগের সূচনা হলো।

একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষের যে ভুমিকা, সেখানে বড় ভুমিকা রেখেছিলেন মোহামেডান সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড়-কর্মকর্তারাই। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের বড় তারকার সবাই তো মোহামেডানেরই ছিলেন। জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ হাজরা, সালাউদ্দিন ছিলেন সেই সময়ে মোহামেডানের তারকা। এমন কি দলটার ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিলেন যিনি, সেই তানভীর মাযহার তান্নাও ছিলেন মোহামেডানের। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সেই মোহামেডানের রুগ্ন চেহারা অনেককে বিক্ষুব্ধ করে। হতাশায় ডোবায়।

মোহামেডান নামের অর্থ যাই হোক, বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে গৌরবের মুক্তিযুদ্ধে দারুণ উদ্দীপক হিসেবেই ক্রীড়াঙ্গনে ভূমিকা রেখেছে। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ষাট, আর সত্তর দশকের শুরুতে, কিংবা আশির দশককে ভঙ্গুর অর্থনীতি, বেকারত্ব, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র, গণতন্ত্রহীনতার মাঝে কোটি কোটি মানুষকে অন্তহীন অপার আনন্দ দিয়েছে ক্লাবটা। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ যখন উন্নয়শীল দেশে উত্তরণের সরণিতে, তখন মোহামেডান ঔজ্জ্বল্য হারানো সত্যি সাদা-কালোর এক কোলাজ!

 

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।