• ঢাকা
  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মার্চ ২৫, ২০২১, ০৪:৪৭ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মার্চ ২৫, ২০২১, ০৫:০০ পিএম

হায়, স্বাধীনতা!

হায়, স্বাধীনতা!

আমি নিতান্ত আদার ব্যাপারে ব্যস্ত থাকি, আমার ব্যবসায় সাহিত্য। আমার মুখে বড় বড় কথা শোভা পায় না। স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ যখন করেছি তখন তো একটি দায়ও বহন করতে হবে। তাই নিচের এই দুয়েকটি জিজ্ঞাসা।

প্রথম জিজ্ঞাসা: “পঞ্চাশ বছরের স্বাধীনতা” কথাটা কি সম্পূর্ণ সত্য? আমার তো তা মনে হয় না।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনতা থেকেও আমাদের দেশ, আমাদের জনসাধারণ দীর্ঘদিন দীর্ঘরাত মুক্তির সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রামের কাহিনিটা সম্পূর্ণ ভুলে গেলাম কেন আমরা? ভুলে গিয়ে কি ষোল আনা সত্য বলা যায়?

এ বছর (২০২১ সাল) আধা-ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর, একথা অকাট্য সত্য সন্দেহ নাই, এ বছরকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বলা যায় মাত্র সেই অর্থে। তাই “স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর” কথাটা আমার মনে হয় বড়জোর একটা অর্ধসত্য মাত্র । আর কে না জানে অর্ধসত্য অসত্যেরও অধম।

আমার মনে পড়ছে, ১৯৭২ সালে আমাদের দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফাও এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন । তাঁর কথা স্মরণ করছি:

“এখন সকলেই উপলব্ধি করেছেন, উনিশশ’ সাতচল্লিশের দেশ বিভাগ একটা প্রকাণ্ড রাজনৈতিক ভ্রান্তি। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ বা তাঁর পূর্বের নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের দ্বিজাতিতত্ত্ব আসলে মনগড়া জিনিস বাস্তবের সঙ্গে তার কোনও সংযোগ নেই। তবু বাংলার মুসলমানেরা পাকিস্তান চেয়েছিল তার একটি সাক্ষাৎ কারণ তো নিশ্চয়ই ছিল। বাংলার মুসলমানেরা হিন্দু ভূস্বামী এবং বর্ণহিন্দু শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অনুকম্পার পাত্রে পরিণত হবেন বলে আশঙ্কা করেছিলেন। তাই বাংলার মুসলিম সম্প্রদায় পশ্চিমা সন্তানদের সঙ্গে আঁতাত গড়ে পাকিস্তান দাবি তুলেছিলেন। চব্বিশ বছর পর দেখা গেল, যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি, সেই জিনিসটিই আগাগোড়া ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের জনগণের মন-মানস যে উপাদানে গঠিত হয়েছে তা হিন্দুর হোক, মুসলমানের হোক, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং আদিবাসী যে সম্প্রদায়েরই হোক না কেন তাই-ই আমাদের বাংলার সংস্কৃতি।”  (আহমদ ছফা রচনাবলি, ষষ্ঠ খণ্ড, ২০০৮, পৃ. ২১৫)

পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের দাবিটি ছিল আগাগোড়া ভিত্তিহীন। অথচ বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরেও আমরা একটা কথা কেন বুঝতে পারছি না?

সাম্যের দাবিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা কিভাবে নতুন এই অসামান্য অসাম্য প্রতিষ্ঠা করলাম? “সামাজিক ন্যায়বিচার” কথাটাও কি আজ সম্পূর্ণ প্রহসন নয়? “মানবিক মর্যাদা”র জায়গায় আজ এদেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে মানবজীবন অধঃপতিত, ঘৃণ্য ও পরাজিত।

গরিবের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা: বাংলা কি আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির লোকের ভাষায় পরিণত হয় নাই? সরকারি ঘোষণা অনুসারে, আজও শতে ছাব্বিশজন মানুষ নাম দস্তখত করতে পারে না। একথা কি সত্য নয়? আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ কোথায় নেমেছে? তা কি ভাষায় প্রকাশ করা যায়? দেশের রাজধানী শহর ঢাকা কি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম পাঁচ শহরের সহোদর নয় আজ? কয়লা পোড়ার পর দেশের প্রাণবায়ু কলুষিত হবে, নিঃশ্বাস নেওয়ারও অবকাশ থাকবে না। জেনেশুনে এই পাপ করার দুর্বল বুদ্ধিটা কে দিল আমাদের?

বুদ্ধিজীবী কাণ্ডারিগণ কি কখনো এসব কথা ভেবে দেখেছেন? এদেশের শতকরা পাঁচজন মানুষের জীবনেও আজ স্বস্তি নাই। কেন নাই?

মাসিক পাঁচ বা ছয় হাজার টাকা মজুরি দিয়ে উন্নয়নের গল্প ফাঁদতে লজ্জা হয় না আপনাদের?  অশ্লীল সম্পদের বিকট প্রদর্শনীর নাম “উন্নয়ন” রাখলেও এই নগ্ন সত্যের কোন হেরফের হয় না। “উন্নয়ন” মানে মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি নয়, গড় আয়ুর পারদে খানিক ওঠানামার সিঁড়ি নয়, কয়টা বছর শুধু স্কুলে-মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার হিশাবও নয়।

পঞ্চাশ বছরে সর্বনিম্ন আয় কত বাড়লো হিশেব করুন, তারপর বলুন, কতটুকু উন্নয়ন হলো। গড় আয়ের শাক দিয়ে কেন নিম্নতম মজুরির মাছ ঢাকা?

তাই সাধ হয় পঞ্চাশ বছর আগে আহমদ ছফা যে কথা বলেছিলেন সে কথাই নতুন করে বলি। প্রকৃত উন্নয়ন তখনই চোখে পড়ে, যখন গোটা দেশের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ অপকর্ষের দিকে তাকাই। ১৯৭২ সালে আহমদ ছফা দেখেছিলেন, “দেশ দেশের হিশেবে চলে, সমাজের দারিদ্র্য বেড়েছে, অজ্ঞতা দিনে দিনে পাষাণের মতো কঠিন আকার ধারণ করছে। সবল দুর্বলকে অত্যাচার করছে।” (পূর্বোক্ত, পৃ. ২১৮)

অধমের শেষ জিজ্ঞাসা এই: আজ হলপ করে বলেন দেখি, এ অবস্থার পরিবর্তন কতটুকু হয়েছে?  স্বাধীনতা খুব ভালো জিনিশ। পঞ্চাশ বছরও খুব কম সময় নয়। মনে রাখা দরকার, সমাজ আরো বড় জিনিশ। কমপক্ষে হাজার বছরের একটা সমাজ আমাদের। এখন মনে হয় আমরা সমাজটাকে পাশ কাটিয়ে কেবল রাষ্ট্রক্ষমতার পূজা করছি। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই। সামাজিক সংকটের কোন সমাধান না করলে আমাদের দুর্ভাগ্য বাড়তেই থাকবে। আমরা কেবল এক সাম্রাজ্যের খোলা থেকে অন্য সাম্রাজ্যের চুলায় পড়বো, মানুষের মুক্তি হবে না, একথা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। শুধু জানেন না আমাদের ইংরেজিনবিশ বুদ্ধিমানরা। এই জিজ্ঞাসা না করে তাঁরা আজ একান্ত বাধিতই করছেন আমাদের। কিন্তু কেন করছেন? কেন একটা মিথ্যাকে ঢাকার জন্য পঞ্চাশটা মিথ্যাচারে সত্যের কদর্য রূপটা ঢাকা? 

২০১২ সালে দেশের একজন সেরা কবি বলেছিলেন “জাতি আজ ক্রসফায়ারের অপেক্ষায়”। কবি নির্মলেন্দু গুণ দাবি করেছিলেন, মাদকের পর ধর্ষণের দণ্ড হোক “ক্রসফায়ার”। তিনি কি খেয়াল করেছিলেন তাঁর কথার অনেক অর্থ হয়? সত্যই জাতি আজ আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা সে প্রশ্নই দেখা দিয়েছে। একেই কি বলে ক্রসফায়ার?

জনসাধারণের ইচ্ছা যদি জাতির একমাত্র রক্ষাকবচ হয়ে থাকে, তবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর নতুন একটা সন্ধ্যায় উপনীত হয়েছি বলেই মনে হচ্ছে। ধন্যবাদ।

 

লেখক: চিন্তাবিদ ও শিক্ষক