• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২১, ০৫:৪৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১২, ২০২১, ০৫:৫৬ পিএম

করোনাকালে পাহাড়ে সাংগ্রাই ও কিছু প্রস্তাবনা

করোনাকালে পাহাড়ে সাংগ্রাই ও কিছু প্রস্তাবনা

সাম্প্রতিককালে পাহাড়ে নববর্ষ মানে র‌্যালি, পানি খেলা, খাওয়া-দাওয়া আর ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার করা। ছেলেবেলায় যে ধরনের নববর্ষ উদযাপন করতে দেখেছি, তেমনটি আর দেখা যায় না। সাংগ্রাই দিনে খুব ভোরে উঠে ফুল সংগ্রহ করে বড়দের দিতাম। সকালের দিকে ঝুড়িতে পরিমাণমতো ধান নিয়ে পুরো পাড়া ঘুরে বাড়ির উঠানে ছিটিয়ে দিতাম গৃহপালিত পশুপাখিসহ অন্য প্রাণীদের উদ্দেশে। আমাদের সময়ে সাংগ্রাই শুরু হতো এভাবেই। নতুন জামা-কাপড় পরার আনন্দ, মজার মজার রান্না তৈরিতে পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা আর নিজ পাড়ার পাশাপাশি অন্য পাড়ায় দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে আনন্দ খুঁজে পেতাম।

অনেকে পানি ছিটাত ঘর থেকে ঘরে গিয়ে। আমরাও বালতি ভর্তি পানি নিয়ে রোদদুপুরে পানি ছিটাতাম। যুবক-যুবতী কিংবা নিকট আত্মীয়রা মিলে পাড়ার বয়স্কদের স্নান করিয়ে দেওয়ার প্রথাও ছিল। গ্রামে গ্রামে খেলাধুলা চলত। খেলাধুলার পাশাপাশি অনেকে একে অপরের অনুমতি নিয়ে পানি ছিটিয়ে দিত। খুব বেশি ভালো সম্পর্ক হলে একে অপরকে পুরোপুরি ভিজিয়ে দিত। তবে পানি ছিটানোটা কখনো লোক দেখানো ছিল না। তবে ইদানীং স্ব স্ব সংস্কৃতিভেদে নানা রকমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বদলে র‌্যালি আর পানি খেলা নববর্ষের প্রধানতম আকর্ষণ হয়ে দেখা দিয়েছে, অন্তত গত দুই দশক থেকে। জেলাভেদে জনগোষ্ঠীভিত্তিক কিছু সংগঠনই এসব কাজে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। সারা বছরে এ সংগঠনগুলোকে দেখা না গেলেও সাংগ্রাইভিত্তিক র‌্যালি আর পানি খেলার আয়োজনে এদের আগ্রহ চোখে পড়ে।

আমাদের এই সংগঠনগুলো কেন পানি খেলা আর র‌্যালিতে অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছে বলা মুশকিল, তবে আপাতদৃষ্টে সাংগ্রাইভিত্তিক এ দুই আয়োজনেই সংগঠনের সঞ্চিত পয়সা খরচ করার সুযোগ বেশি থাকে পাশাপাশি আগ্রহীরাও এ দুই কাজে অর্থ ব্যয় করতে চায় বলেই ধারণা। তাই এখন মিডিয়াসহ নানা কোম্পানিও পানি খেলাতে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করতে চায়। মিডিয়ায় প্রচারের সুযোগ থাকে বলে বিশেষ করে মারমারা এ দুই কাজে অধিক মনোযোগী হয়ে উঠেছেন।

গত দুই দশক থেকে নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন করার ফলে বর্তমান তরুণ সমাজও নিজেদের চর্চিত মূল্যবোধ সব ভুলে র‌্যালি আর পানি খেলানির্ভর সাংগ্রাই উদযাপনে মনোনিবেশ করেছে। তরুণদের এমন আগ্রহকে সংগঠনগুলো লুফে নিয়েছে। তাই করোনার সময়েও সাংগ্রাই করা চাই, সেটা নির্ধারিত তারিখে করা না গেলেও, বিকল্প তারিখ খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। তার মানে যেভাবেই হোক পানি খেলা হওয়া চাই!

র‌্যালি আর পানি খেলা আয়োজন করতে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের লোক জমায়েত করতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না। তরুণ, বৃদ্ধ সবাই সংগঠনটির পরিচয়, কার্যক্রম, ভূমিকা ভুলে আবেগতাড়িত হয়ে অংশগ্রহণ করে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পরিচিতি বাড়ে, কোথাও কোথাও গুরুত্বও পায়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে নেতা-কর্মীদের ইজ্জত বাড়াতে ফেসবুকে পোস্ট দেয়, মারমাদের সংস্কৃতি, মারমাদের আনন্দ, মারমাদের সাংগ্রাই বলে পরিচয়, প্রদর্শন করতে ভুল করি না।

আমরা প্রশ্ন করতে পারি, মারমারা নিকট অতীতে সাংগ্রাই র‌্যালি আর জমা করা পানি সারাক্ষণ ছিটাত কি?  স্কুল ও কলেজজীবনে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির কিছু উপজেলায় সাংগ্রাইয়ে পানি খেলা হতে কখনো শুনিনি। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লেখকদের লেখায় মারমা পাড়া থেকে ফানুস ওড়ানোর কথা পাওয়া গেলেও পানি খেলার কথা পাওয়া যায় না। পানি খেলা আয়োজন করতে গিয়ে আয়োজকদের দর্শনার্থী সামলানোর ব্যর্থতা নিয়ে প্রতিবছর বিতর্ক শোনা যায়। তারপরও গত কয়েক দিনে অনেক তরুণকে ফেসবুকে ঘোষণা দিতে দেখেছি, সাংগ্রাই এ ‘পুণ্য’ পানি যেভাবে হোক ছিটাতে হবে, অনুষ্ঠিত হতেই হবে, দেরিতে হোক তা-ও হতেই হবে!

ফেসবুক পোস্টগুলো দেখে আমার প্রশ্ন জাগে, সংগৃহীত অর্থ দিয়ে খাল-নদীর পানি পাহাড়ে তুলে ক্যামেরার সামনে ছোড়াছুড়ি করলেই কি পুণ্য পানি হয়? আমরা কি আদৌ আমাদের জন্য খেলছি? নাকি দর্শনার্থী, পর্যটক, মিডিয়া কিংবা আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যই খেলছি? অনুষ্ঠিত পানি খেলায় কারা, কোন শ্রেণির মারমা, কোন শ্রেণির তরুণ-তরুণীরা অংশগ্রহণ করে? র‌্যালি আর পানি খেলার মধ্যে প্রাপ্তিই বা কী? এমন সব বিষয় আলোচনার দাবি রাখে।

আমরা কি আয়োজকদের দেখানো পথে হাঁটব? নাকি আমাদের হারিয়ে ফেলা মূল্যবোধগুলো ধারণ, পালন করার মধ্যে নিজেদের মহামূল্যবান মূল্যবোধগুলো টিকিয়ে রাখব? এ প্রশ্ন করা দরকার।

বাংলা সিনেমায় প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নায়ক নায়িকাকে নদীতে নামিয়ে ভিজিয়ে দিতে, গানের দৃশ্য ধারণ করতে বৃষ্টিতে ভিজিয়ে নারীকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যৌন আবেদনময়ী করে তোলার একটি চল আছে। আমরা মারমারাও তরুণীদের পানি খেলার নামে ক্যামেরার সামনে আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা করছি প্রতিনিয়ত। এতে তরুণদের কী লাভ জানি না, তবে মিডিয়া কিংবা নানা কোম্পানির অনেক লাভ হয়, তা বুঝতে পারি।

পানি খেলানির্ভর আয়োজনের প্রতি আগ্রহী হওয়ার বদলে, করোনার সময়ে আমরা ভিন্ন উপায়ে কীভাবে সাংগ্রাই উদযাপন করতে পারি এবং তার ভেতর দিয়ে কীভাবে মারমা সমাজ, আদিবাসী সমাজকে উপস্থাপন করা যায় সে উপায় খোঁজা দরকার।

গত বছরও মহামারিতে চংক্রান, বিষু, বৈসাবি করা যায়নি। এ বছরও হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বৈসাবিকে ঘিরে পাহাড়ে জুমচাষিদের বেচাবিক্রি বাড়ে। তাদের কিছুটা চাঙ্গা হওয়ার সুযোগ থাকে। পরপর দুই বছর বেচাবিক্রি না হওয়ায় জুমচাষের অর্থনীতিতে মঙ্গা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া এ সময়টা শুধু জমি প্রস্তুতির সময় বলে, জুমে তেমন কিছু থাকে না। ঘন বন আর ছড়াগুলো নানাভাবে নষ্ট করে ফেলায় পানিও তেমন নেই, আগের তুলনায় খাদ্য সংগ্রহও খুব একটা হয় না। ফলে জুমচাষিদের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখনই।

পরিচিত মুখ চিত্রশিল্পী জয়দেব রোয়াজা ফেসবুকে আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, “আমরা জুমে ফলমূল খেতে যাই, ধান পাকলে ছবি তুলতে যাই, জুমিয়া জুমচাষিদের কঠিন সময়ে আমরা কিন্তু যাই না। তাদের কাছে গেলে খেতে দেয়, বিশ্রাম নিতে সহায়তা করে। তাদের অভাবের সময়ে, খারাপ সময়েও আমাদের সমান আগ্রহ নিয়ে যাওয়া দরকার। তাদের কাছে ৫০০ টাকা অনেক টাকা।” আমি জয়দেব রোয়াজার সাথে একমত। করোনার সময়ে তথাকথিত পুণ্য পানি না ছিটালেও চলবে। আমাদের সংস্কৃতি মরে যাবে না। ভালো কাপড় পরে পুণ্যপানিতে ভিজে ফেসবুকে পোস্ট না দিলেও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হারাবে না।

জুমচাষিরা জুম করতে না পারলে, জুমে ভালো ফলন না হলে আপনার আমার সংস্কৃতিতে আগুন লাগবে। ভাতের থালায় মারফার বদলে শসা, জুম মরিচের বদলে পেট জ্বালাপোড়া করানো লম্বা লম্বা মরিচ আসবে। র‌্যালি আর পানি খেলার জন্য আমাদের বরাদ্দকৃত সময় ও অর্থ চাইলেই জুমচাষিদের জন্য ব্যয় করতে পারি। করোনা মহামারির এই সময়ে সাংগ্রাই, বৈসাবি হোক মদ খেয়ে চোখ লাল করার বদলে জুমের বীজ সংগ্রহ করার কাজে সহযোগিতা করার। নতুন কাপড় পরে, কপালে সানগ্লাস তুলে ছবি পোস্ট করার বদলে এই সময়ে জুমচাষির সাথে বসে পাতায় মোড়ানো খাবার খেলেই বরং বেশি ভালো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এতে আমাদের বিঝু, বৈসুক, বিষুর আনন্দ কোনো অংশে কমবে না, আমাদের সংস্কৃতি হারানোর ভীতি জাগবে না। অনেক পাহাড়ে এখন জুমে বীজ বোনারও সময়। জুমে বীজ বোনার কাজেও আপনি কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারেন।

এক বছরের অধিক সময় ধরে স্কুল বন্ধ। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকবে জুমচাষিদের সন্তানরা, দুর্গম পাড়ার শিশুরা। সেই সব শিশুর পড়ালেখায় ফেরাতে আপনার মেধা ও পরিকল্পনা কাজে লাগানো যায়। আমাদের জনগোষ্ঠীভিত্তিক সংগঠনগুলো যদি করোনার সময়ে এমন সব পরিকল্পনা নিয়ে চংক্রান, বিঝু, বৈসু পালনে আগ্রহী না হয়ে শুধু র‌্যালি আর পানি ছিটানোতে আগ্রহী হন, সেসব সংগঠনসমূহকে আমাদের সংগঠন বলতে পারি না।

মারমা সমাজে নিয়মিত কোনো কবি নেই ফলে কবিতাও নেই। নিয়মিত লেখক নেই, তাই নিয়মিত বই নেই, ফলে সাহিত্যও নেই। গবেষকও নেই। সমাজ টিকে থাকার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোকে বাদ দিয়ে নিয়মিত পানি খেলা আর র‌্যালি করলেই কি সাহিত্য সংস্কৃতি বাঁচবে? কোনটা জরুরি— নিয়মিত সাহিত্যচর্চা নাকি লোক দেখানো পানি খেলা?

জুমের সৌন্দর্য, প্রেম, ভালোবাসা, আনন্দ নিয়ে অনেক গান, নাটক রচিত হয়েছে। কিন্তু জুমচাষিদের দুঃখ কষ্ট, বেদনা, বঞ্চনা নিয়ে গান নেই। জুমিয়া নারীর নির্জন একাকী পথ পাড়ি দেওয়ার বর্ণনা নেই। সন্ধ্যার সময়েও কয়েক টাকার সবজি বিক্রি করতে না পারার, নারীটির মলিন মুখের বর্ণনা নিয়ে একটি গানও রচিত হয়নি।

করোনা মানুষকে ঘরে বসে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। আপনি আমি মিলে সাংগ্রাই, নববর্ষ, বিহু, বৈসাবি নিয়েও নতুন করে ভাবতে পারি।

 

লেখক: উন্নয়নকর্মী