• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৭:৩৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৮, ২০২১, ০৭:৩৮ পিএম

বাঁশখালী হত্যাকাণ্ড: বন্দুকের পেছনে কে?  

বাঁশখালী হত্যাকাণ্ড: বন্দুকের পেছনে কে?  

আবার শ্রমিকের জীবন গেল বাঁশখালীতে। ইতোমধ্যে পাঁচজন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটেছে, আশংকা করা হচ্ছে আহত আরও কয়েকজনের মৃত্যু ঘটতে পারে। আহত প্রায় ৫০ জন। পঞ্চাশ জন মানুষকে আহত এবং পাঁচজনকে হত্যা করতে কত রাউন্ড গুলি বর্ষণ করতে হয়েছে তার খবর এখনও পাওয়া যায় নি। এস আলম কর্তৃপক্ষের নিয়োগ করা নিরাপত্তা বাহিনী, আনসার বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হাতের নিশানা এত নিখুঁত নয় যে এক গুলিতে একজনকে আহত করতে বা হত্যা করতে পারে। ধারণা করা যায় শতাধিক রাউন্ডের বেশি গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। অর্থাৎ ছোটখাট একটা যুদ্ধ হয়েছে বাঁশখালি গণ্ডামারা কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। এ এক অসম যুদ্ধ। একদিকে অস্ত্রধারী সরকারি, আধা সরকারি এবং প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী এস আলম কর্তৃপক্ষ নিয়োজিত বেসরকারি বাহিনী, অন্যদিকে নিরস্ত্র শ্রমিক। অবশ্য নিরস্ত্র বললে ভুল হবে তাঁরা সবাই ছিল বঞ্চনা জনিত ক্ষোভের অস্ত্রে সজ্জিত।

সৌন্দর্য আর সম্পদে পরিপূর্ণ এক জনপদ বাঁশখালী। যারা বাঁশখালীতে গিয়েছেন তাঁরা দেখেছেন প্রকৃতি কি অকৃপণ হাতে সাজিয়ে দিয়েছে বাঁশখালীকে। একদিকে বঙ্গোপসাগর অন্যদিকে মাঝারি আকারের পাহাড়, মাঝখানে সমতলভুমি। ধান, মাছ, পান, সুপারি, সবজি, লবন, ফল মুল, কাঠ, বনজ সম্পদ কি নাই বাঁশখালিতে। সেই বাঁশখালিতে আজ শ্রমিকের জীবন হারানোর শোক এবং পুলিশি হয়রানির আতংক। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টে পুলিশের শ্রমিকদের সংঘর্ষের ঘটনায় বাঁশখালী থানায় দুটি মামলা হয়েছে। শনিবার (১৭ এপ্রিল) রাতে মামলা দুটি করা হয় বলে জানিয়েছেন বাঁশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিউল কবীর। এর মধ্যে একটি মামলা পুলিশ বাদী হয়ে, অন্যটি বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে করা হয়েছে বলে তিনি জানান। দুটি মামলার মধ্যে  একটিতে  পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা ও হামলার অভিযোগে করা হয়েছে। ওই মামলায় অজ্ঞাত দুই থেকে আড়াই হাজার জনকে আসামি করা হয়। অন্য মামলাটি করেছেন এসএস পাওয়ার প্ল্যান্টের চিফ কো অরডিনেটর  ফারুক আহমেদ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রে  লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরের অভিযোগে করা ওই মামলায় ২২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪০-৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। যে শ্রমিকরা নিহত এবং আহত হয়েছে তাদের পক্ষ থেকে কোন মামলা করা হয়েছে কিনা সে খবর এখনও পাওয়া যায় নি।        

সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে বাঁশখালীতে এ ধরণের হত্যাকাণ্ড ও পুলিশি হয়রানি নতুন নয়। স্থানীয় জনগণের দাবী উপেক্ষা করে সমুদ্র উপকুলে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহনের সময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেপরোয়া গুলিবর্ষণে ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল ৪ জন নিহত ও বহু গ্রামবাসী আহত হয়েছিলেন। সেদিন গ্রামবাসীদের দাবী বা কষ্টের কথা রাষ্ট্র শুনতে চায় নি। আবাদি জমি ধ্বংস হবে, প্রকৃতি বিনষ্ট হবে, সামুদ্রিক মৎস্য প্রজনন এলাকা নষ্ট হবে, লবন চাষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে, কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কালো ধোঁয়া গ্রাস করবে বাঁশখালির সবুজ শ্যামল পরিবেশ, বিপন্ন হবে মানুষের জীবন—এসব কোন কথা বা যুক্তি গ্রহণযোগ্য হয়নি মুনাফার লালসার কাছে। রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা শুধু নয়, সকল রকম সহায়তা করেছে বিপুল ক্ষমতাধর এস আলম গ্রুপকে। যে কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি আজো।

২০১৭ সালেও এক জনঅসন্তোষ তৈরি হয়েছিল এখানে। সবকিছুকে কঠোর হাতে দমন করে বাঁশখালী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকো থ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এখানে অর্থায়ন করেছে। দেশী বিদেশী সব মিলিয়ে এখানে প্রায় ছয় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। 

এবারের অসন্তোষের কারণ কী? বিদ্যুৎপ্লান্টে সংঘর্ষের নেপথ্যে পুলিশের অতি উৎসাহী ভূমিকাকে দায়ী করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শ্রমিক জাহেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘রমজানে আমরা আমরা ১০ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা ডিউটির দাবি জানিয়েছিলাম। ৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে আমরা সুন্দরভাবে ইফতার এবং নামাজ পড়তে পারবো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের দাবি মেনে না নেওয়ায় আমরা শুক্রবার থেকে কাজ না করার ঘোষণা দিই। এরপর শনিবার (১৭ এপ্রিল) পুলিশ জোর করে আমাদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করতে গেলেই সংঘর্ষ হয়।’

জাহেদুল ইসলাম বিদ্যুৎপ্লান্টে রিগার হিসেবে কাজ করছেন। শনিবার সকালে কেন পুলিশের সঙ্গে আপনাদের সংঘর্ষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা মোট ১০টা দাবি জানিয়েছিলাম। রমজানে কর্মঘণ্টা কমাতে হবে। অনেকের দুই মাসের বেতন বাকি ছিল, আবার অনেকে নায্য পাওনা পেতো না। তাদেরকে বেতন, ন্যায্য পাওনা দিতে হবে। এসব দাবিতে শনিবার আমরা কাজ করা থেকে বিরত থাকার ঘোষণা দিই। সকালে কাজে যোগ না দিয়ে শ্রমিকরা এসব দাবি নিয়ে কথা বলছিল। পুলিশ এসে শ্রমিকদের বলে তোমরা কাজে যাও, ডিউটি করো। তোমাদের দাবি পূরণ করা হবে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে পুলিশ একটি প্রাইভেটকারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর কোনও কারণ ছাড়াই পুলিশ আমাদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। পরে শ্রমিকরা ইট-পাটকেল ছুড়তে শুরু করলে পুলিশ অরিজিনাল গুলি করা শুরু করে। আমরা পুলিশকে ইট পাটকেল ছুড়ে মারা ছাড়া আর কিছুই করিনি।’ একথার প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায় নিহত ও আহতদেরকে দেখে।

প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত রিপোর্টে উল্লেখিত হয়েছে যে, বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক সওগাত ফেরদৌস বলেন, ‘আহত অবস্থায় অনেককে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এর মধ্যে চারজন মারা গেছেন।’ তিনি জানান, নিহত চারজন হলেন আহমেদ রেজা (১৮), রনি (২২), শুভ (২৪) ও মো. রাহাত (২২)। আর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর মো. রায়হান (১৮) নামের এক শ্রমিককে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত শ্রমিকেরা হলেন আমিনুল ইসলাম (২৫), মো. আমির (২৪), মো. দিদার (২১), মো. বিল্লাল (২৬), মো. আযাদ (১৮), মো. কামরুল (২৬), শিমুল (২৮), শাকিল (২৩), মোরাদ (২৫), মিজান (১৮), রাহাত (২৮), হাবিবুল্লাহ (১৮), হাসান (৪০) ও অভি (২০)। একই হাসপাতাল ভর্তি হওয়া আহত পুলিশ সদস্যরা হলেন মো. ইয়াসির (২৪), আহমদ কবির (২৬) ও আসদুজ্জামান। তিনজনই গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির কর্তব্যরত উপপরিদর্শক (এসআই) শীলাব্রত বড়ুয়া বলেন, শ্রমিকেরা গুলিবিদ্ধ হন। আর পুলিশ সদস্যদের জখম হয়েছে ইট ও পাথরের আঘাতে। ইট পাথরের বিরুদ্ধে গুলি বর্ষণ কেন? কার নির্দেশে কে চালাল গুলি? কে জবাব দেবে?

শ্রমিকদের সব দাবী যে সঠিক তা নাও হতে পারে। তাহলে শ্রমিকদের দাবী উত্থাপিত হলে তা সমাধানের পথ কী? শ্লোগান দিলে শো কজ নোটিশ, মিছিল করলে মারধোর আর ইট ছুড়লে বুলেট এই কি হবে সমস্যা সমাধানের পদ্ধতি? এস আলম নামক প্রতিষ্ঠানের উত্থান এবং বিকাশ যারা গত দু দশকে প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা নিশ্চয় এর বিপুল আর্থিক ক্ষমতা ও দানবীয় শক্তির পরিচয় জানেন। রাষ্ট্রের সকল রকম সহায়তা পেয়ে যে বিশাল আকার ধারণ করেছে এই প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সহজ কথা নয়। বুকের মধ্যে কতখানি বিক্ষোভ জমা হলে ১৫/১৬ হাজার টাকা বেতনের শ্রমিকরা প্রতিবাদ করতে সাহস পান তা একটু ভেবে দেখা দরকার।  

ইতোমধ্যে নিহত শ্রমিকদের জন্য ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। স্বাধীন দেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। ৫০ বছর পর ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল বকেয়া বেতন, কর্ম সময় নির্ধারণের কথা বলতে গিয়ে জীবন দিল যে শ্রমিক তাদের জীবনের মুল্য নির্ধারিত হয়েছে ৩ লাখ টাকা। বাঁশখালীর শ্রমিক হত্যা কি দানবীয় উন্নয়ন আর মানবিক বিপন্নতার এক টুকরো ছবি হয়ে থাকলো? এই ছবি আমরা রাখবো কোথায়? বন্দুক তাক করে শ্রমিকদের উপর গুলি বর্ষণের ছবি হয়তো দেখা যাবে কিন্তু বন্দুকের পিছনে যে শক্তিধরেরা আছেন তাদেরকে দেখবে কে?    

লেখক: বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য