• ঢাকা
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৩:৪২ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : এপ্রিল ১৯, ২০২১, ০৩:৪২ পিএম

নূরকে নো-ওয়ান থেকে সাম-ওয়ান করার পেছনে দায়ী কে?

নূরকে নো-ওয়ান থেকে সাম-ওয়ান করার পেছনে দায়ী কে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি নুরুল হক নূর আলোচনায় থাকতে পছন্দ করেন। এজন্যে নানা কৌশল তার। অপরাপর কৌশলের মধ্যে অদ্য আরেকবার আলোচনায় এসেছেন এক অযাচিত ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করে। ন্যক্কারজনক মন্তব্যে নূর বলেছেন, “কোনো মুসলমান আওয়ামী লীগ করতে পারে না।” নূরের অভিযোগ, “আওয়ামী লীগের উগ্রবাদীরা আলেম উলামাদের নিয়ে যেভাবে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, তাদের চরিত্র হরণ করছে, এরা মুসলমান হতে পারে না।” ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাদের উদ্দেশে তার আহ্বান, “যারা নিজেদের মুসলমান দাবি করেন, অন্তত আওয়ামী লীগ কইরেন না।”

নুরুল হক নূরের এই মন্তব্যকে ঐতিহাসিক ন্যক্কারজনক মন্তব্য বলছি কারণ আওয়ামী লীগ ও ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা সেটা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেও এটা চলে আসছে। সত্তরের নির্বাচন বলেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলেন, আর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধিতা যাই বলুন— সবখানেই আওয়ামী লীগ ও ইসলাম ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছিল। অথচ ইতিহাসের কী নির্মম অধ্যায়, সর্বক্ষেত্রেই এই অপচেষ্টাকারীগণ পরাজিত হয়েছে। সব জায়গায় ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগকে জিতিয়ে দিয়েছে দেশের মানুষই।

লক্ষণীয় যে, এইসব অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ‘সহিহ মুসলমান’ প্রমাণে নামতে হয়নি। নিজেদের ঐতিহাসিক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ জিতে এসেছে। ‘নৌকায় ভোট দিলে বউ তালাক হয়ে যাবে’, এমন প্রচার সত্ত্বেও কেউ বিশ্বাস করেনি সেটা। ধর্ম, রাজনীতি, বউ, ভোট সবকিছু স্ব স্ব জায়গায় ছিল; প্রভাবিত হয়নি কেউ অপপ্রচারে। ফল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার জয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান আর ইসলাম ধর্মকে একই সুতোয় বেঁধে জামায়াতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম আর পাকিস্তানিরা প্রচার, গণহত্যা চালালেও ওখানেও জয় পেয়েছে বাঙালিরা, এবং তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগই। ‘ক্ষমতায় গেলে ফেনি পর্যন্ত হিন্দুস্তান বা ভারত হয়ে যাবে’, ‘মসজিদ বন্ধ হয়ে যাবে’, ‘মসজিদে-মসজিদে উলুধ্বনি হবে’; এই প্রচারণাগুলোও ব্যর্থ হয়েছে। এসবের জন্যে আওয়ামী লীগকে অতি-ইসলামি দল হতে হয়নি। এইসব অপপ্রচার অতিক্রম করে এসেছে দলটি। এখানে কাজ করেছে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যার প্রসারে ঐতিহাসিকভাবে কাজ করে এসেছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের ইতিহাসের সঙ্গে এতসব উজ্জ্বল সাফল্যের আখ্যান সেই দলটির বিরুদ্ধে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের সাম্প্রতিক অযাচিত মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে। আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্টরা এই মন্তব্য মেনে নিতে না পেরে নিজেদেরকে ‘নতুন করে মুসলমান প্রমাণে’ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের এই ব্যস্ততার তিনটা দিক রয়েছে। এক. নূর-বিরোধিতা;  দুই. তারা আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক অর্জন সম্পর্কে অজ্ঞতা; এবং তিন. রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলা।

নুরুল হক নূরকে সুযোগ দিতে না চাওয়া বিষয়ক আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্টদের যে অনলাইন কৌশল সেটা আমরা দেখে আসছি দীর্ঘদিন ধরেই। এতে তারা লাভবান হয়নি, উল্টো ‘জিরো থেকে হিরো’ বানানো হয়েছে অখ্যাত নূরকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নূরের উপস্থিতিকে তাকে নেতা পর্যায়ে তুলে এনেছে অনলাইনে আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্টরা আর অফলাইনে ছাত্রলীগ। তারা নূরকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে তার ওপর বারবার শারীরিক হামলা করেছে, আলোচনায় রেখেছে অনলাইনে। এর পথ ধরে কখনো অভিনয়ে, কখনো সত্যিকার অপদস্থ হয়ে সহানুভূতি পেয়েছেন তিনি। এখানে নূরের কৌশলের যোগ ছিল নিশ্চিতভাবেই, ফলে ফল ঘরে তুলতে পেরেছেন তিনি ডাকসুর নির্বাচনে। কোটা সংস্কারের বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্বস্থানীয় কাউকে ডাকসুর নেতা পর্যায়ে নিয়ে আসার যে দায় সেটা ছাত্রলীগ ও আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্টদের রয়েছে। নূরকে ব্যক্তিগতভাবে হেনস্তা করার খেসারত দিয়েছে তারা নির্বাচনে, দিয়ে যাচ্ছে এখনও। ফলে নূর নিজের একটা অবস্থান দাঁড় করাতে পেরেছেন। নিজের কোনো রাজনৈতিক দল না থাকলেও এখন তিনি সরকারবিরোধী একজন নেতা, এবং তার বক্তব্যগুলোও সবখানে আলোচিত হচ্ছে।

“কোনো মুসলমান আওয়ামী লীগ করতে পারে না”—নূরের এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া  কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও জানিয়েছে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য একে ‘পাগলের প্রলাপ’ আখ্যা দিয়েছেন। লেখক বলেছেন, “নূর মানসিক বিকারগ্রস্ততার জায়গা থেকে সব সময় উল্টোপাল্টা কথাবার্তা বলে থাকে। এর দ্বারা তিনি ইতোমধ্যে ছাত্র সমাজের কাছে হাসির পাত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। তার কথায় এখন আর কেউ গুরুত্ব দেয় না।”
ছাত্রলীগের এই প্রতিক্রিয়ায় আমি অবাক হয়েছি। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক নিজে দাবি করছেন নূরের বক্তব্যকে কেউ গুরুত্ব দেয় না আবার তিনি নিজেই সেই বক্তব্যের প্রতিবাদ করছেন। ছাত্রলীগের সেক্রেটারির এই পরস্পরবিরোধিতা তার যোগ্যতাকেই কি প্রশ্নবিদ্ধ করে না? ছাত্রলীগের এই নেতাসহ অপরাপর নেতারা কি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামীবিরোধীদের ধর্মকার্ড সম্পর্কে এতখানিই অজ্ঞ? এরা কি আওয়ামী লীগের অর্জনের ইতিহাস জানে না? এরা ইতিহাস জানলেও কি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার শিক্ষাটাও পায়নি? নুরুল হক নূর কিছু বললেই ছাত্রলীগকে কেন এর জবাব দিতেই হবে? ছাত্রলীগের এই জবাবের প্রবণতা যেখানে একটা বিষয়ভিত্তিক আন্দোলনের নেতাকে ডাকসুর ভিপি পর্যায়ে নিয়ে গেছে সেখানে তাদের ভুল থেকে শেখার কথা ছিল, কিন্তু তারা শেখেনি; উল্টো একই ভুল করে যাচ্ছে বারবার।

আদতে ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শিক রাজনীতির চর্চার অনুপস্থিতি রয়েছে। আদর্শের রাজনীতি শিক্ষার চাইতে সংগঠনটি এখন নির্দিষ্ট ব্যক্তিচর্চায় মনোনিবেশ করেছে। এটা হয়ত নিজেদের অলক্ষ্যেই হচ্ছে, তবু হচ্ছেই তো। ফলে শিক্ষা-শান্তি-প্রগতির স্লোগানধারী ছাত্রলীগ নূর-চর্চায় ব্যস্ত। আদর্শবিচ্যুতির এই প্রমাণ সম্প্রতি পাওয়া গেল আরো একবার, যখন হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হকের নারী কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ হলো তখন দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় একাধিক ছাত্রলীগ নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগ করলেন, কয়েকজন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে বরখাস্ত হলেন। হোক না তারা প্রান্তিক পর্যায়ের ছোট কিংবা মাঝারি পর্যায়ের নেতা, তবু এদের পরিচয় ছাত্রলীগই ছিল; পদত্যাগ ও বরখাস্তের সময়ে এরা ছাত্রলীগ হিসেবেই অভিহিত হচ্ছিল। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর মধ্যে এই আদর্শবিচ্যুতির কারণ ও দায় কেন্দ্রেরই। কারণ তারা সংগঠনের আদর্শের প্রচার ও প্রসারে ব্যর্থ হয়েছে। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সবখানেই তারা ব্যক্তিপূজা আর ব্যক্তিবিদ্বেষে মেতেছিল, এখনও আছে।

নূরের ধর্মকার্ড বিষয়ক নিবন্ধে ছাত্রলীগ ও আওয়ামীপন্থী অ্যাক্টিভিস্টদের নিয়ে এত আলোচনা কেন, এ প্রশ্ন করতেই পারেন। এর কারণ নুরুল হক নূরকে এই পর্যায়ে নিয়ে আসার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে তারাই। নো-ওয়ান থেকে সাম-ওয়ান হয়ে ওঠার পর এখন সরকারবিরোধিতা করতে গিয়ে ধর্মকার্ড খেলছেন নূর। ডাকসুর সাবেক ভিপি হিসেবে তার বেশির ভাগ মন্তব্যই আলোচিত হলেও প্রভাবক হচ্ছে না মূলত তার অন্তঃসারবিহীন রাজনৈতিক চর্চা আর আদর্শের কারণে। আওয়ামী লীগ ও মুসলমান পরিচয় বিষয়ক এই মন্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ নয় সেটা তিনিও জানেন, তবে তার প্রতিপক্ষরা তাকে আলোচনায় রাখবেন বলেই তিনি এমন ঢালাও মন্তব্য করলেন। নুরুল হক নূরের এই ফাঁদে পা দিয়েছে ছাত্রলীগ ও আওয়ামীপন্থী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। এখানেই নূর নিজেকে সফল ভাবতেই পারেন।

টিকে থাকতে হলে নূরকে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধিতা করেই টিকে থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে সক্রিয় ধর্মান্ধ কথিত তৌহিদি জনতা, এরাই তার উদ্দিষ্ট। নূর সেই উদ্দিষ্টজনদের উদ্দেশেই নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। ছাত্রলীগ ও আওয়ামীপন্থী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা এখানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া না দেখালেই বরং নূর আলোচনায় আসতে পারতেন না। কিন্তু তারা সরব হয়ে আদতে নূরকেই সফল করে ফেলেছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে ডাকসুর ভিপি হয়ে যাওয়ার কোনো কিছুতেই নুরুল হক নূর নিজের যোগ্যতায় সফল হননি। তার সাফল্য এসেছে অন্য কারণে, বিশেষত ছাত্রলীগের অযোগ্যতা আর অদক্ষতায়। বারবার আক্রান্ত হয়েছেন বলে সহানুভূতিপ্রাপ্তি ঘটেছে তার, যা কাজ করেছে ভোটেও। এই সময়ে নানা ইস্যুতে তার মন্তব্যগুলো কোনোভাবেই দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সাবেক ভিপির মতো মনে হয় না। অন্যের অযোগ্যতা আর অদক্ষতায় এতখানি ওপরে ওঠে আসা তার। নূরের সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক মন্তব্য নিন্দাযোগ্য। নিন্দা করি এর। কে মুসলমান, কে হিন্দু, কে কী— এই প্রশ্ন যেমন জরুরি নয়, জরুরি নয় এর উত্তর দেওয়াও। আওয়ামী লীগের যে শ্রেণির লোকজন অদ্য নুরুল হক নূরের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রমাণ করতে গিয়ে নিজেদেরকে অতি-মুসলমান প্রমাণে নেমেছেন, তারা ভুল করছেন।

ধর্ম রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়। রাজনৈতিক দলের উদ্দেশ্য ধর্মরক্ষা আর ধর্মপ্রচার নয়। নূর কথিত তৌহিদি জনতাকে টার্গেট করেছেন, টিকে থাকতে এই কৌশল নিতে হয়েছে তাকে। এই কৌশল যে ভুল তার সাক্ষ্য দেয় বাংলাদেশের ইতিহাস। নূর ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। কে জানে সেই শিক্ষা নেওয়ার শিক্ষা কিংবা যোগ্যতা তার হয়ে ওঠেনি এখনও!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক