• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: মে ১২, ২০২১, ১০:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : মে ১৩, ২০২১, ০২:৫৬ পিএম

জেরুজালেম

ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের লড়াই

ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের লড়াই

চোখের সামনে অ্যাম্বুলেন্সভর্তি মানুষ, হতাহতদের আর্তনাদ, স্ট্রেচার নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে চলা হাসপাতালের কর্মী ও সেচ্ছাসেবক দল, নিরীহ মানুষদের রক্তাক্ত কাপড় এবং ব্যান্ডেজ মোড়ানো মুখ– গত কয়েকদিন ধরেই এসব দেখছি আমি।

আমি একজন ফিলিস্তিনি স্বেচ্ছাসেবক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। আমার বাসা আল আকসা মসজিদ এবং আল মাকাসেসেদ হাসপাতালের কাছাকাছি। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের এই লড়াইয়ের অংশ হয়ে গেছি আমরা।

সোমবার ইসরায়েলি পুলিশের হামলায় জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ৩৩০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। চিকিৎসার জন্যে অনেককে পূর্ব জেরুজালেম থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে আল মাকাসেসেদ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

আল আকসায় প্রবেশের পরপরই আমি সেদিন মসজিদের ভেতরে থাকা ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্টের মুখপাত্রকে ফোন করেছিলাম। তিনি বললেন, “পুলিশ রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাসের ছুড়ছে। লোকজনকে গুলি করছে। লোকজনের বুকে, মুখে এমনকি মাথায় গুলি করা হচ্ছে।” 

এরপর আমি কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যাই। আহতদের মধ্যে বয়স্ক মানুষ থেকে শুরু করে মহিলা এবং শিশুরাও রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই আমরা রক্তদান থেকে শুরু করে হতাহতদের পরিবারের জন্য খাবার ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করছি।

মূলত আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি বাহিনীর মধ্যে এই সহিংসতা পেছনে রয়েছে শেখ জারারাহ এলাকা এক অতীত ইতিহাস। ১৯৪৮ সাল থেকেই এখানে ফিলিস্তিনি পরিবারদের উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছে ইসরায়েল। সেসময় দেশে প্রায় ৭ লাখ ৭৫ হাজার ফিলিস্তিনিকে নিজ ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েলিরা।

বর্তমানে শেখ জারাহতে যেসব পরিবার রয়েছে তারা ১৯৪৮ সালে উচ্ছেদ হওয়া ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের একটি অংশ। আরব-ইসরায়েলের সেই যুদ্ধের সময় হাইফা এবং জাফায় থেকে তাদের বিতাড়িত করে ইসরায়েলি বাহিনী। পরে ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ২৮ শরণার্থী পরিবারকে এখানে বসতি স্থাপন করার সুযোগ দেওয়া হয়।

কিন্তু ২০০৯ সালে, ইসরায়েলের আদালত এখানে ইহুদীদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিলে তারা ২০ জন শিশুসহ ৫৩ জন শরণার্থীকে বাস্তুচ্যুত করে তাদের বাড়িঘর দখল করে নেয়। 

গত বছর, ইসরায়েলের আদালত শেখ জারারাহে আরও কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে উচ্ছেদ করার রায় দেয়। তাদের মধ্যে চারটি পরিবার এ রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করে। সোমবার সেই রায়ের শুনানি হওয়ার কথা ছিল। পরে সেটি পিছিয়ে দেওয়া হয়।

রমজানের শুরু থেকে ফিলিস্তিনিরা এই পরিবারগুলোর পাশে আছে। তাদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে তরুণরা। কিন্তু গত শনিবার থেকে অবৈধ বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলি ও পুলিশ তাদের আক্রমণ শুরু করে এবং অনেককে আটক করে। এরপরেও ফিলিস্তিনি যুবকরা শেখ জারারাহর পরিবারগুলোর সঙ্গে রমজানে রোজা রেখে আন্দোলন করছিল প্রতিদিন।

আল আকসা মসজিদে রমজানের শেষ দিনগুলি কাটানো আমাদের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। কিন্তু শনিবার থেকে পুলিশ আমাদের শহরে প্রবেশে বাধা দিতে শুরু করে এবং ফলশ্রুতিতেই দুপক্ষ সংঘর্ষে জড়ায়।

শেখ জারারাহর এই পরিবারগুলো এবং আর ইসরায়েলি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে এই লড়াই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। আল আকসা মসজিদ ও গাজায় হামলার জেরেই বিদ্রোহীরা মঙ্গলবার ইসরায়েলে রকেট হামলা চালিয়েছে।

ইসরায়েলি পুলিশের বিরুদ্ধে শেখ জারারাহর বন্ধুদের এই অদম্য প্রতিরোধে আমি আমাদের ভাগ্যকে দেখতে পাই। আল আকসা, গাজা এবং শেখ জাররাহর সঙ্গে স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন এক সুতোয় বাঁধা। আর তাই ২২ বছর বয়সী একটি ছেলে ইসরায়েলি পুলিশের গাড়ীর ওপর হামলা করতে সাহস পায়। বিক্ষোভ থেকে আটককৃতরা মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে থানায় যায়। শেখ জারারাহতেই আমি আমার ভবিষ্যতে দেখতে পাই।

নেতানিয়াহু সরকার যদি মনে করে দিনে দিনে আমাদের এই প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়বে তাহলে তারা ভুল করছে। এটি কেবল শেখ জারারাহ পরিবারগুলির লড়াই না। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমি ও আমাদের ভবিষ্যতের জন্য লড়াই।

তথ্যসূত্র :নিউ ইয়র্ক টাইমস


লেখক : ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজক ও সেচ্ছাসেবক
(২০১২ সালে ‘শেখ জাররাহ, মাই নেবারহুড’ তথ্যচিত্রের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত)