• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২, ২০২১, ০৮:২৮ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৩, ২০২১, ১০:২০ এএম

করোনাকালের বাজেট ও আমাদের প্রত্যাশা

করোনাকালের বাজেট ও আমাদের প্রত্যাশা

বিশ্বে করোনার তাণ্ডব চলছে প্রায় ১৫ মাস ধরে। গত ৩১ মে পর্যন্ত বিশ্বে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ কোটি ১৪ লাখের বেশি এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৪ হাজারেরও বেশী। বাংলাদেশেও শনাক্তের সংখ্যা ৮ লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১২ হাজার ৬১৯। করোনার আঘাত শরীরকে যেমন ভোগায়, ঠিক তেমনি লকডাউন অর্থনীতিকে ঘায়েল করে। লকডাউনের ক্ষত যে কত গভীর ইতিমধ্যে তার প্রমাণও মিলছে। করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কালো ছায়া নেমে এসেছে। মোটাদাগে প্রভাব পড়েছে আমদানি-রপ্তানি আয়, কর্মসংস্থান, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে দারিদ্র। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন করোনা ভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বের দারিদ্রের হার বেড়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশে দাঁড়াবে।

গত বছরের মতো এ বছরও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত অর্থনীতিকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশের মাননীয় অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন। এ অর্থ বছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধারণা করা হচ্ছে ৬ লাখ ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা, যা গত বছর ছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার। এ বছর বাজেটের আকারটি ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় স্থির মূল্যে ৯৮.৭১ গুণ বড়। তবে জিডিপির হিসাবে বাজেট বাড়েনি। বরং কিছুটা কমেছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটটি ছিল জিডিপির ১৭.৪ শতাংশ এবং আগামী বছর জিডিপির আকার ৩৪ লাখ ৭৩ হাজার ৯ শত ১১ ধরলে তা জিডিপির ১৭.৩৫ শতাংশ হয়। তারপরও করোনার অভিঘাতে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের জন্য এটি হবে একটি সম্প্রসারণমূলক বাজেট। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের অন্যতম দিক হচ্ছে ব্যাংক ঋণ নির্ভর বিশাল আকারের ঘাটতি বাজেট যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ।

ঘাটতির আকার হচ্ছে ২ লাখ ১৩ হাজার ৮০২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৬.১ শতাংশ। গতবছর এ ঘাটতি ছিল জিডিপির ৫.৮ শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৭৮ যা জিডিপির ১১.২ শতাংশ। এ ধরনের বিশাল আকারের ঘাটতি বাজেটের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে অনেকের মধ্যে মত পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে ঘাটতি বাজেট প্রাসঙ্গিক। আর মন্দাকালে তো আরো প্রাসঙ্গিক। আইএমএফের রীতিনীতিতে (convention) উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় জিডিপির ৫ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি বাজেট করা যায়। আর বিশেষ পরিস্থিতিতে দুই-এক বছরের জন্য তার বেশিও ঘাটতি বাজেট করে আক্রান্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও গতিশীল করা যেতে পারে।

করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে ছন্দপতন হয়েছে। এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ছন্দপতনের চিহ্ন উঠে এসেছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও অক্সফামের জরিপে উঠে এসেছে, করোনার প্রভাবে দেশের ৬২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য বলছে, করোনায় নতুন করে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে নেমে গেছে। (প্রথম আলো ৩০ মে ২০২১)। এছাড়াও বিআউডিএসের অন্য জরিপে উঠে এসেছে যে, করোনার আগে মোট বেকার ছিল ১৭ শতাংশ এবং করোনায় যোগ হয়েছে আরো ১৩ শতাংশ।

অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কঠিন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী অর্থ বছরের বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সামাজিক নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে উত্থাপিত হতে যাচ্ছে। অন্যবারের বাজেটের মতো অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে বাজেটে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সঠিকভাবে মনোযোগ (address) দেয়া হয়েছে কিনা? উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে অন্যান্যবারের মতো অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ানো ঠিক হবে না।

উৎপাদণশীল খাতের বিনিয়োগ শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারী বিনিয়োগের পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া পর্যুদস্ত বিশ্ব অর্থনীতির কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআর) যে ভাটা পড়ছে তার গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। মনে রাখতে হবে বিনিয়োগ বাড়ানো হলে ভোগ উৎসাহিত হবে, তাতে উৎপাদনও বাড়ে। এতে জাতীয় আয় বাড়ে। ফলে সঞ্চয়ও বাড়ে, আর এর অর্থ বিনিয়োগ বাড়ায়। বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি।

স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে সবাইকে টিকার আওতায় আনতে হবে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে পারলে কর্মসংস্থানের পরিবেশ নিরাপদ হবে এবং বিনিয়োগ বাড়বে। নতুন করে সৃষ্ট দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তার কর্মসূচীতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। এছাড়া দেশের ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ হিসাবে কর ব্যবস্থা সংস্কারে গুরুত্ব দয়া উচিত। ব্যাংক ঋণ নির্ভর ঘাটতি বাজেট কমানোর জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত এবং গতিশীল হতে হবে।

বাজেট খাতওয়ারী বরাদ্দের গুণগত ব্যয় নিশ্চিত করে গৃহীত প্রকল্পসমূহ যেন নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয় তার তদারকি জোরদার পদক্ষেপ এ বাজটে থাকা উচিত। অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। পরিশেষে করোনা সংকটকালীন বাজেট বাস্তবায়ণের মাধ্যমে সকল শ্রেণির জীবন-জীবিকা যেন নিশ্চিত হয়। এই বাজেটের মাধ্যমে আমরা চাই গরীব ও মধ্যবিত্ত যেন স্বস্তিকর জীবনের আশ্বাস পায়।

 

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়