• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ২, ২০২১, ০৮:৫১ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ৩, ২০২১, ১০:২৭ এএম

বাজেট ২০২১-২২

এবারও কি তামাক কোম্পানির মুনাফা বাড়াবে সরকার?

এবারও কি তামাক কোম্পানির মুনাফা বাড়াবে সরকার?

করোনার মধ্যে দ্বিতীয় বাজেটের আকার কত লাখ কোটি টাকার হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি কত ধরা হলো কিংবা বাজেটের রাজস্ব আদায়ের ঘাটতি কত ইত্যাদি বিষয়ে লেশমাত্র আগ্রহ নেই জনগণের। সাধারণ মানুষের একটাই চিন্তার-আগ্রহের বিষয় হলো বাজেটে প্রস্তাবের পরদিন থেকে কোন কোন পণ্যের দাম বাড়বে। জীবন যাত্রার ব্যয় কতটা বাড়বে। নির্দিষ্ট আয় দিয়ে কিভাবে বাড়তি খরচ সামাল দেবেন তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকে দেশের সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে নাভিশ্বাসে থাকা মানুষ জানে, যে সব পণ্যের দাম জাতীয় রাজস্ব বোর্ড– এনবিআর বৃদ্ধির প্রস্তাব করেনি সেগুলোর দাম বাড়তে শুরু করে বাজেটের অজুহাতে। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সুযোগ খোঁজে জনগণের পকেট কাটার, কোম্পানিগুলোর  মুনাফা নিশ্চিত করতে। বিপত্তি হয় তখন, যখন দেখি কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা তামাক ব্যবসায়ীদের লাগামহীন মুনাফা বৃদ্ধিতে কৌশল করে, রাজস্ব কমার জুজুর ভয় দেখিয়ে রাজনীতিবিদসহ নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্ত করে। বছরের পর বছর সরকারি কর্তাদের সুবিধায় অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ফেঁপে বড় হওয়া ব্যবসার নাম হলো সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের ব্যবসা।

অর্থনীতি বিটের ১২ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি এককভাবে সরকারের সবচেয়ে সুবিধা পেয়েছে তামাক ব্যবসায়ীরা। ধারণা করছি অতীতের মতোই আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটেও ‘কোম্পানীর সুবিধায় সিগারেটের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব’ দিতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর তথা অর্থমন্ত্রণলায়। প্রসঙ্গত: বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে বহুজাতিক তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার রয়েছে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে বিড়ি-সিগারেট-গুল-জর্দার দাম ঠিক করে দেয় যে এনবিআর, সেই এনবিআরই রাজস্ব আদায় করে। বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যেখানে, তামাক চাষের পর কৃষক প্রক্রিয়াজাত তামাক পাতা কত দামে বিক্রি করবে তাও ঠিক করে দেয় কৃষি মন্ত্রণালয় তথা বাংলাদেশ সরকার।

বাজেটকেন্দ্রিক এ আলোচনাতে কিভাবে কোম্পানির প্রেসক্রিপশনে সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয় সে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। বাংলাদেশে সিগারেটের চারটি স্তর রয়েছে। দামের ভিত্তিতে নিম্নস্তর, মধ্যম, উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরের বিভক্ত করে রাখা হয়েছে। প্রসঙ্গত অ্যাডভোলেরাম ও বহুস্তরভিত্তিক সিগারেটের এই জটিল কর কাঠামো বাংলাদেশসহ হাতে গোণা দু’একটি দেশে আছে। কারণ জটিল বহুস্তরভিত্তিক কর ব্যবস্থায় কোম্পানিগুলোর কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ থাকে অনেক বেশি। তাই জনস্বাস্থ্য  রক্ষায় কর বৃদ্ধিতে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সিগারেটের কর কাঠামোর পরিবর্তন করে সহজীকরণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও সেই মান্ধাতার আমলের কোম্পানির প্রেসক্রিপশনেই চলছে। অনেকটা ডিজিটাল যুগে এনালগ পদ্ধতির মতো।

প্রস্তাবিত বাজেটে সিগারেটের চার স্তরের মধ্যে সম্ভাব্য দুটি উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরে দাম বাড়ানো হতে পারে ৫ টাকা ও ৭ টাকা। সিগারেটের কোনো স্তরের সম্পূরক শুল্ক বা এসডিসহ কর বাড়ানো হবে না হয় তো। আগেই বলেছি, সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের দাম ঠিক করে দেয় এনবিআর। ফলে কর হার না বাড়িয়ে সিগারেটে দাম বাড়ানোর এই পদ্ধতির কারণে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে যেমন, তেমনি সিগারেট কোম্পানির মুনাফা বাড়ছে হু হু করে। বিষয়টি সহজ করে বললে এভাবে বলা যায়, প্রিমিয়াম স্তরের ১০ শলাকার এক প্যাকেটে সিগারেটের দাম ১২৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকার করার প্রস্তাব করা হতে পারে। এখানে তাহলে দাম বাড়বে ৭ টাকা। এই বাড়তি ৭ টাকার মধ্যে সরকার রাজস্ব পাবে ৫ টাকা ৬৭ পয়সা। আর কোন ধরনের বাড়তি খরচ ছাড়াই কোম্পানির থাকবে ১ টাকা ৩৩ পয়সা। ফলে বিনা খরচে কোম্পানির মুনাফায় যোগ হবে প্রায় দেড় টাকা। আপনার হয়তো মনে হবে এ আর এমন কী বেশি? হ্যাঁ অনেক বেশি কারণ প্রতিদিন গড়ে ২৩ কোটি স্টিকের বেশি সিগারেট বিক্রি হয় বাংলাদেশে, টাকার অঙ্কটা নেহায়েত কম নয়। আর এই পদ্ধতিতে মূল্যবৃদ্ধির কারণেই জনগণ যে বাড়তি টাকা দেবে সিগারেট কিনতে তার একটা অংশ চলে যাচ্ছে সিগারেট কোম্পানিগুলোতে। ফলে তাদের মুনাফা বাড়ছে রকেট গতিতে। মোদ্দা কথা, সরকার তামাক কোম্পানির ব্যবসা বাড়াতে কাজ করছে বলেই সমস্ত খরচ এমনকি ট্যাক্স-ভ্যাট দেয়ার পরও সিগারেট কোম্পানির বার্ষিক মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২৯ শতাংশ। এমনকি ২০১৮ সালে ৩ শতাংশ উৎপাদন কমার পরও বহুজাতিক তামাক কোম্পানির বিএটির মুনাফা ২৮ শতাংশ বেড়েছিল। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকসহ কোনো ব্যবসাতেই কর পরবর্তী এমন অস্বাভাবিক মুনাফা করার রেকর্ড আছে বলে জানা নেই।

যদিও তামাক নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনকারীরা বলছেন, সিগারেটসহ তামাকজাত পণ্যের ওপর নির্দিষ্ট কর বা স্পেসিফিক ট্যাক্স বাসানোর। অর্থাৎ দাম না বাড়িয়ে যদি মধ্যম স্তরে ৫ টাকা এবং উচ্চতর ৭ নির্দিষ্ট কর বা স্পেসিফিক ট্যাক্স বাসানো হতো তাহলে পুরো টাকাটাই সরকার রাজস্ব পেতে। এতে রাজস্ব আয় বাড়ত বহুগুণে। অন্যদিকে কর বাড়ানোর কারণে দাম বৃদ্ধি হওয়ায় জনগণের দেয়া টাকার সবই কোষাগারে যেত। সাথে দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ধূমপান সেবন কমিয়ে দিত। কিন্তু এনবিআর বা অর্থমন্ত্রণালয় হাঁটছে উল্টো পথে।

২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এমনকি তামাকের সহজ কর কাঠামো তৈরির নির্দেশনাও দিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা এনবিআরসহ প্রজাতন্ত্রের সকল প্রতিষ্ঠানের কাছে অবশ্যই পালনীয়-করণীয়। কিন্তু সেই নির্দেশনা পালন তো দূরে থাক, উল্টো পথে হাঁটছে এনবিআর-অর্থ মন্ত্রণালয়। এমনকি তামাকের চাষসহ তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতেই উঠেপড়ে লেগেছে সরকারি সংস্থাগুলো! 

প্রস্তাবিত বাজেটে বিড়ি-জর্দা-গুলসহ তামাকজাত পণ্যের ওপর যদি বাড়ান না হয়, তাহলে তা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। কারণ এসব পণ্য ব্যবহারকারীরা দরিদ্র মানুষ, যাদের অনেকেই নারী। তাই জনস্বাস্থ্য, জনস্বার্থ, পরিবেশগত ক্ষতিসহ সবমিলিয়ে সকল তামাকজাত পণ্যের ওপর নির্দিষ্ট কর বা স্পেসিফিক ডিউটি আরোপ এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক: সাংবাদিক

sinhasmp@yahoo.com