• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২১, ১০:৫৮ এএম
সর্বশেষ আপডেট : জুন ১৪, ২০২১, ১০:৫৮ এএম

গেম অন

হায় সাকিব! হায় বিসিবি!!

হায় সাকিব! হায় বিসিবি!!

ক্রিকেট মাঠে প্রতিবাদ জানানোর ভাষা একটাই— পারফরম্যান্স। অস্ত্র দুটো— বল আর ব্যাট। কিন্তু ঢাকার ক্রিকেটে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সাকিব যা করলেন, তা নিয়ে দীর্ঘ চর্চা চলছে, গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এবং সেটা ক্রিকেটগ্রহ জুড়ে। তিনি যা করেছেন তা দেশজ ক্রিকেটে ‘স্টাম্পকাণ্ড’ হিসেবেই লেখা থাকবে।  

কী করেছিলেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত এই অলরাউন্ডার! নেট দুনিয়ার নাগরিকদের দেখা হয়ে গেছে। অন্যরা জেনে গেছেন। সঙ্গে জেনেছেন, সাকিবের ৫ লাখ টাকা জরিমানা আর ৩ ম্যাচের নিষেধাজ্ঞার খবর। জরিমানা, নিষেধাজ্ঞা এটা সাকিবের জন্য অবধারিত ছিল। আর এটা তার জন্য নতুন কিছু নয়। সাকিব আল হাসান কতবার নিষিদ্ধ হলেন আর কতবার জরিমানা গুনলেন, সেটা তার নামের পাশে স্কোরশিটের মত করে লিখে যেতে হচ্ছে!

সাকিবের ‘স্টাম্পকাণ্ড’ কী?— আগামী দিনের কোনো ক্রিকেট পাঠক জানতে চাইতেই পারেন। হয়তো গুগলে সার্চ দিলে বা ইউটিউবে ক্লিক করলেই পেয়ে যাবেন। তবু মনে হচ্ছে, গোটা কয়েক শব্দ ক্যাচমার্ক হিসেবে লিখে রাখা দরকার। 

আবাহনী অধিনায়ক মুশফিকের বিরুদ্ধে তার (সাকিব) এলবিডাব্লিউর আবেদন নাকচ করে দিয়েছিলেন আম্পায়ার। সাকিব সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে স্টাম্পে লাথি মারলেন! এরপর বৃষ্টির কথা বলে আম্পায়ার খেলা বন্ধ করলেন। উত্তেজিত সাকিব ছুটে গিয়ে তিনটি স্টাম্প তুলে ফেললেন! ক্রিকেট নামক খেলাটার সঙ্গে কিংবা ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে যা একেবারেই বেমানান। ক্রিকেটগ্রহে অন্যকোনো দেশে অতীতে এমন ঘটনা ঘটেছে কী না তা নিয়ে ক্রিকেট ইতিহাসবিদরা ঘাটাঘাটি শুরু করেছেন। অতীতে নজির থাকুক বা না থাকুক, এই ঘটনায় সাকিব গোটা বিশ্বে ‘শিরোনাম’ হয়ে গেছেন। এবং সেটা বাজে ভাবে! একই দিনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সাউথ আফ্রিকার কুইন্টন ডি ককের সেঞ্চুরি, পিসিএলে মাথায় বলের আঘাত পেয়ে আন্দ্রে রাসেলের স্ট্রেচারে করে মাঠ ছাড়ার ঘটনাকে ছাপিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটসহ সব জায়গায় শিরোনাম— সাকিব!

ওই ঘটনার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেটা অনেক কৌতূহল জাগানো। “... দেশ-বিদেশ থেকে এতো ফোন আসছে, আমিতো লজ্জায় ফোনই ধরছি না!...।” আসলে বাংলাদেশ ক্রিকেটে গত কয়েক বছরে যা ঘটছে তাতে লজ্জিত হওয়ারই কথা সভাপতির। একটা ক্রিকেট বোর্ডে প্রতিবছর সাধারণ সভা হওয়ার কথা। কিন্তু গত চার বছরে একটাও হয়নি! তার অর্থ ক্রিকেট বোর্ড পরিচালকদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। সেটা করতে হয় এজিএমে। কী দরকার এসব এজিএম করার! হয়তো বলা হবে করোনার কারণে। কিন্তু করোনা তো বছর দেড়েকের ঘটনা। তার আগে? আর করোনাকালে ভার্চুয়ালি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন পর্যন্ত হচ্ছে। থেমে নেই আইসিসির সভা। কিন্তু বোর্ডের এজিএম হয় না! করোনাকালে জৈবসুরক্ষা বলয়ে খেলোয়াড়, কোচদের রেখে টি-টোয়েন্টি লিগ করা হচ্ছে। উদ্যোগটা ভালো। কিন্তু সেখানে কি আইন মানা হচ্ছে! যদি তা-ই হতো, তাহলে সাকিব আল হাসান কীভাবে হোটেল থেকে মোহামেডানের এক কর্মকর্তা কাম বোর্ড পরিচালকের অফিসে গিয়ে চুক্তি সই করলেন! বোর্ড সভাপতি আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “কোটি কোটি টাকা খরচ করে লিগ করছি। এরকম হলে প্রয়োজনে বন্ধ করে দেবো!” সাকিব আল হাসানকে কি সেবার সতর্ক করা হয়েছিল, কেন তিনি জৈবসুরক্ষা বলয় ভেঙে মোহামেডানের ঐ কর্মকর্তার অফিসে গেলেন? কিংবা ঐ বোর্ড পরিচালকের কাছে কি জানতে চাওয়া হয়েছে, কেন তিনি সাকিবকে তার অফিসে স্বাগত জানালেন!

ক্রিকেটারদের করোনা থেকে রক্ষার জন্য জৈবসুরক্ষা বলয়ে রাখা হলো, তাহলে মাঠে কীভাবে আবাহনীর সমর্থকরা সেদিন ঢুকলেন? বিষয়গুলো সত্যিই লজ্জার। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে ফোন ধরার চেয়ে না ধরাই ভালো।

তারপর পরও ধন্যবাদ দিতে হবে বিসিবি সভাপতিকে, তিনি বলেছেন— লজ্জায় ফোন ধরছেন না! কিন্তু তার বোর্ডের অনেক পরিচালক এই ‘লজ্জা’ শব্দটাকে অনেক আগে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে এসেছেন। সেইসাথে ‘স্বার্থ-সংঘাত’ এই শব্দ যুগলকে অভিধান থেকে মুছে দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডে এসেছেন তারা। একজন পরিচালক কীভাবে একাধিক ক্লাবের কোচ হলেন? কোন নৈতিকতায়? তিনিই আবার জাতীয় দলের কখনো ম্যানেজার, কখনো টিম লিডার! তিনিই আবার গেম ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান। ক্রিকেট অপারশেনস কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান! সেই সঙ্গে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট বিপিএলে বোর্ড সভাপতি যে কোম্পানিতে চাকরি করেন, সেই প্রতিষ্ঠানের কেনা দলের কোচ! বিষয়গুলো সত্যিই কি লজ্জার? নাকি অসামান্য প্রতিভাবান করিৎকর্মা এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব বঙ্গ ক্রিকেটে।

বোর্ড সভাপতি অবশ্য আশার কথা শুনিয়েছেন, তিনি ‘রুট অফ কজেস’ খোঁজার পক্ষে। একটা কমিটিও করা হয়েছে। সেখানে যারা সদস্য তাদের অধিকাংশ বিসিবির পরিচালক। এবং যে ক্লাবটার দিকে ক্রিকেটমহল আঙুল তুলছে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে, সেই ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে তারা। সঙ্গে বিসিবির বেতনভুক্ত এক ম্যাচ রেফারি আর প্রধান নির্বাহী। তাদের পক্ষে কি সত্যিই ঘরোয়া ক্রিকেটের অনিয়ম-অন্যায় খুঁজে বের করে প্রতিবেদন দেয়া সম্ভব হবে?

সাকিব ‘স্টাম্পকাণ্ড’-এ যা করেছেন, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু এটা সত্য, তিনি যা করেছেন তাতে একটা ঝাঁকুনি লেগেছে দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে। কিন্তু হেলে পড়েছে সাকিব এবং তার পূর্বসূরিদের ধুলো-ঘাম-রক্ত ঝরানো পরিশ্রমে গড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট অট্টালিকার একটা অংশ। আবার সাকিবের এই প্রতিবাদ দেখে মনে হয়েছে, এই ধরন তো বাঙালির নিজস্ব। অধিকার আদায়ের কত আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালি লাঠি মিছিল করেছে। আর সাকিব ক্রিকেট মাঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্টাম্প তুলে ফেলেছেন! স্টাম্পে লাথি মেরেছেন। এই লাথিকে প্রতীকী ধরে নিতে পারেন আপনি। সাকিব হয়তো একাই দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা একটা পরিকল্পিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চেয়েছেন। রুখে দাঁড়াতে চেয়েছেন। কিন্তু এত জটিলতা আর অন্ধকারের মধ্যে থেকে ন্যায়ের মশালে আগুন জ্বালানোর কাজটা মাঠে অন্যভাবে করতে পারতেন সাকিব। 

নিজে অন্যায় করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা যায় না। আবার সাকিবের অন্যায়ের বিচার করতে বসে ঐদিন মাঠে ঘটে যাওয়া অন্য অন্যায়গুলোকে এড়িয়ে গেলে আগামীর ইতিহাস অন্যদেরও ক্ষমা করবে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বিচারে যদি অন্যকোনো অন্যায়কে সমর্থন করে যাওয়া হয়, তাহলে আগামীর পৃথিবী তাদেরও আবর্জনা বাক্সে নিক্ষেপ করতে পারে।

শুক্রবার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামের ম্যাচটা আবাহনী বনাম মোহামেডান, নাকি সাকিব বনাম সুজন অর্থাৎ ‘এস’ বনাম ‘এস’, নাকি সত্যিই অন্যায় বনাম প্রতিবাদের ম্যাচ ছিল? তবে এই টি-টোয়েন্টি ম্যাচটার গায়ে ট্যাগ লাইন যা-ই লাগানো হোক না কেন, ক্রিকেট নামক খেলাটা ছিল না।

এই ম্যাচে সাকিবের জরিমানা হয়েছে। তিনি নিষিদ্ধ হয়েছেন। মোহামেডান জিতেছে। তবে ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেটের। আবার লাভও হয়েছে সেই বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই। গত ক’বছর ধরে ঘরোয়া ক্রিকেটে যা হচ্ছে, তার খানিকটা বেরিয়ে এসেছে। আর এবারের লিগে যা হলো তাতে সবচেয়ে অতৃপ্ত থাকবে একজনের আত্মা। লিগের নামের আগে যার নামটা যোগ করে দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। সবার মনে রাখা উচিৎ, ক্রিকেটে সব কিছুর জবাব দেওয়ার একটাই জায়গা। মাঠের মাঝখানের বাইশ গজ। কিন্তু ঢাকার লিগের অনেক কিছুর ফয়সালা হয়ে যায় মাঠের বাইরে! বঙ্গবন্ধুর আত্মা তৃপ্তি পাক, খেলাটা সেভাবে কেউ খেলতে চাইলেন না। পরিচালনাও করতে চাইলেন না। এটাই সবচেয়ে লজ্জার।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট