• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২১, ০৩:৫৬ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৮, ২০২১, ০৩:৪৮ এএম

পরীমণি পুরুষতন্ত্রের বিকৃতির শিকার

পরীমণি পুরুষতন্ত্রের বিকৃতির শিকার

কি ভয়ানক নির্মম হয়ে গেছে আমাদের এই দেশ, এই সমাজ, একের পর এক ভয়াবহ সব নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে! যার কোনোটাই বিকৃতি ও বীভৎসতার বিচারে কম নয়, বরং নানা ফরমেটে, নানা কায়দায়, নানা শ্রেণির নারীকে টার্গেট করে করে নির্যাতন করা হচ্ছে। এবং তার চেয়েও বড় আশঙ্কার কথা হল এইসব ঘটনার একটা বড় অংশ থেকে যাচ্ছে বিচারহীন, শাস্তিহীন, প্রতিকারহীন। উল্টো চোখের সামনে দেখছি অভিযুক্ত অপরাধীকে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে। আইনের শাসনের এমন করুণ কদর্য রূপ আর কি কখনও দেখেছে বাংলাদেশ?

মুনিয়া হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমণিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার যে ঘটনাটা ঘটে গেল, সেই ঘটনাটি একটা স্বাধীন দেশের আইন কানুন সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা সবকিছুতে এক লহমায় এক বিস্ময়বোধক চিহ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে আবারও। পরীমণির মতো একজন উচ্চবিত্ত, সমাজে পরিচিত মুখ, প্রভাব প্রতিপত্তিসম্পন্ন নারীকেও যদি ধর্ষণচেষ্টার মামলা করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখতে হয়, সংবাদ সম্মেলন ডাকতে হয়, তাহলে আসলে আমরা ঠিক কোথায় অবস্থান করছি? কোন সে নরকে?

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পরীমণিকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় রচনা লিখে চলেছে ওরা কারা? সিনেমা নাটক শিল্প সাহিত্যের নামে নারীকে ফাদে ফেলে বিকৃত যৌনাচারের ফাঁদ পাতছে, ওরা কারা? টাকা দিয়ে কিনে নিচ্ছে টেলিভিশনের স্লট, সংবাদ পাঠিকা হওয়ার টোপ ফেলে মুনিয়ার মতো মেয়েদের ঢাকা শহরের যৌনবিকৃতির চক্রের ভেতরে এনে আটকে ফেলছে ওরা কারা? টাকা দিয়ে সবাইকে কিনে নিচ্ছে যে আনভীর, নাসির নামের লোকগুলো, তাদেরকে আমরা কেন প্রতিরোধ করতে পারছি না? কেন আমাদের মুখের জবান আটকে যাচ্ছে দিন শেষে? কেন আমাদের মুখ বাঁধা? হাত বাঁধা? কেন আমাদের বিবেক দূর নির্বাসনে স্তব্ধ বসে আছে একা!

মাত্র কিছুদিন আগে টিকটক হৃদয় বাবু গ্যাং একটি মেয়েকে যৌন নির্যাতন করেছিল, যার ভিডিও দেখে মাত্র একদিনে তাদের সনাক্ত করে ধরে আনার কাজটি সম্ভব করেছিল পুলিশ। অথচ এই মুনিয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত আনভীর চোখের সামনে ঘুরছেন, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের নির্বাচন শেষে মিডিয়ার সামনে বড় বড় বক্তব্য দিচ্ছেন, আর তার পায়ের নিচে হাঁটু গেড়ে বসে আছে সাংবাদিকরা। না, কেউ একটিবার তাকে প্রশ্ন করার সাহস পায়নি- আপনি এখানে কেন? আপনি তো একটি হত্যা মামলার আসামি, আপনি কেন নির্বাচন করছেন? কোন নিয়মের বলে?

পরীমণির আসামী আটক হয়েছেন। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ নামের বিকৃতি লোকটি যদিও টিভির সামনে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু তার ভিডিও পাওয়া গেছে। মাতাল, কুৎসিত লোকটির চিৎকার শুনেছি আমরা। পরীমণির আর্তনাদ ও কান্না আমরা শুনেছি। এখানে চাইলেই ক্ষমতাবান বিকৃত পুরুষেরা যে কোনো নারীকে হস্তগত করতে পারে, বিপদে ফেলতে পারে, ধর্ষণ করতে পারে। এরপর হাসতে হাসতে চলে যেতে পারে কাউকে তোয়াক্কা না করে।

এ কোন সমাজ গড়ে উঠল? এ কোন নোংরা কারাগারে আটকে পড়লাম? নারীকে নিয়ে খেলেই চলেছে নোংরা পুরুষতন্ত্র। পুরুষের লাজলজ্জা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। একদল অসভ্য বর্বর ক্ষমতাবান যৌনলোলুপ পুরুষ অপকর্ম করেই চলেছে। আর একদল যৌনকাতর, কিন্তু সুযোগের অভাবে কিছু করতে না পারা বিকৃত পুরুষের দল ফেসবুক জুড়ে যৌনতাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সহযোগি কিছু নারীও।

পরীমণি, আপনার সাহস ও ধৈর্য্যকে সাধুবাদ জানাই। প্রশংসা করি আপনার মনোবলের। এটা যেন অটুট থাকে। লড়াই কেবল শুরু। আরো বহুদূর যেতে হবে। পাশে আছি। আর পরীমণির পাশে থাকা নারী নাট্যকার চয়নিকা চৌধুরী, আপনাকে সাধুবাদ জানাই পরীমণির পাশে থাকার জন্য। তবে এক্ষেত্রে আপনার উদ্দেশ্যে আরেকটু বলতে চাই, একদিন আপনার স্বামী অরুণ চৌধুরীর বিরুদ্ধেও একের পর এক যৌন হয়রানির অভিযোগ এসেছিল। তখন আপনি সেইসব নির্যাতিতা নারীর পাশে দাঁড়ানোর মতো ব্যক্তিত্ব অর্জন করতে পারেন নি। কিন্তু এখন আপনি একজন নারীর পাশে আছেন। হয়তো সে সময় অরুণ চৌধুরীদের মোকাবেলা ও প্রতিরোধ করতে জানলে আজকের আনভীর আর নাসিরদের বাড় এতটা বাড়ত না।

যাই হোক, সমাজ নিয়ে আমার আর কোন প্রত্যাশা নেই। কিন্তু পরীমণির মতো সাহসী মেয়েরা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। ওর আত্মপ্রত্যয়ী চোখমুখ, কথা বলার ভঙ্গী আমাকে স্বপ্ন দেখায়। পুরুষতন্ত্রে পুরুষ তো এমনই বিকৃত চিরকাল। এ তো নতুন কিছু নয়। নতুন হল, পরীমণিদের সাহস, তেজ, বুদ্ধিমত্তা আর সচেতনতা। এটাই নতুন। সমাজ হয়তো তাই ভড়কে গেছে। চমকে গেছে। এই চমকানোর বাকি আছে আরো। আরো হাজারো পরীমণি তৈরি হচ্ছে, জেগে উঠছে। আর কতকাল এই বিকৃতি সইবো আমরা? না আর না। প্রস্তুত হোক পুরুষতন্ত্র, প্রস্তুক হোক নির্যাতিত পুরুষ; সচেতন, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী ও শক্তিমান নারীর কাছ থেকে প্রতিঘাত আসতে শুরু করেছে। আরো আসবে। এবং দিনশেষে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবে পুরুষতন্ত্রের অসভ্য দেয়াল, যৌনকাতর শিশ্নসর্বস্ব সিস্টেম গুড়িয়ে যাবে সকল নারীর পদাঘাতে।

 

লেখক: সম্পাদক, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর

আরও পড়ুন