• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: আগস্ট ৩১, ২০২১, ০৯:৪৫ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : আগস্ট ৩১, ২০২১, ০৯:৪৫ পিএম

খাঁচার হড়কা তলে ‘ডানাভাঙা পরী’

খাঁচার হড়কা তলে ‘ডানাভাঙা পরী’
জাগরণ গ্রাফিক্স ডেস্ক

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় কারাবন্দি নায়িকা পরীমণির জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। মঙ্গলবার (৩১ আগস্ট) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ শুনানি শেষে তার জামিন মঞ্জুর করেন। আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

গত রোববার (২৯ আগস্ট) উচ্চ আদালতের নির্দেশে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশ পরীমণির জামিন শুনানির জন্য ৩১ আগস্ট দিন ধার্য করেন। এর আগে গত ২১ আগস্ট দুপুরে এ ঢালিউড অভিনেত্রীকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির কর হলে শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম আশেক ইমাম তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনার ক্রেজ হয়ে থাকা ঢাকাই শোবিজ তারকা পরীমণিকে ঘিরে দীর্ঘ সময় সরগরম ছিল দেশের প্রতিটি প্রান্ত। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, কোথায় ছিলেন না পরীমণি! অতীতে নানা ইস্যুতে আলোচনায় এলেও সাম্প্রতিক সময়ে এমন কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল তার নাম, যা দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ঝড় তুলেছে। যার সূচনা হয়েছিল ৮ জুন রাতে। সাভারের  বিরুলিয়া এলাকায় অবস্থিত ঢাকা বোটক্লাব থেকে।

সে রাতে বোটক্লাবের বিনোদন সম্পাদক ও ব্যবসায়ী নাসির ইউ মাহমুদ কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যাপ্রচেষ্টার শিকার হওয়ার অভিযোগ তুলে, ঘটনার দিন কয়েক পরে নিজের ভ্যারিফায়েড ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন পরীমণি। সেখানে তিনি এই ঘটনায় ন্যায় বিচার প্রাপ্তির আবেদন জানিয়ে ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্ররী বরাবর। এর পরেই শুরু হয় আলোচনার ঝড়। পরীমণির এই ঘটনাভিত্তিক সংবাদে ছেয়ে যায় গণমাধ্যম। শুরু হয় প্রশাসনিক তৎপরতা। দ্রুতই গ্রেফতার করা হয় মূল অভিযুক্ত নাসিরসহ পাঁচ ব্যক্তিকে। এর আগে তাদের গ্রেপ্তারের আগে সাভার থানায় ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার মামলা করেন পরীমণি।

কিন্তু পরবর্তীতে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পরীমণির আবেগঘণ বিবৃতি আর সংবাদ সম্মেলনে দেয়া নানা তথ্যের অসামঞ্জস্যতা যেমন বেরিয়ে আসতে থাকে। তেমনি সামনে আসে নাসির নামক সেই ব্যবসায়ীর নানা অপকীর্তির তথ্যও। সে সময় পরীমণির পাশে খুব শক্ত অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন পুলিশ প্রশাসন ও চলচ্চিত্র অঙ্গণসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক মানুষ। কিন্তু বোটক্লাব ইস্যুতে দেয়া পরীমণির বিভিন্ন তথ্য যখন পুলিশি তদন্ত ও গণমাধ্যমের অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করে এবং গুলশান ক্লাবে ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অজানা তথ্য সামনে আসতে শুরু করে তখন একে একে সরে যেতে শুরু করেন সমর্থকেরা। পক্ষান্তরে, নাসিরকে জেলে পাঠানোর পর ঘটনার পরিসমাপ্তি বিবেচনা করে নিয়ে পরী যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হতে শুরু করেন, ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় কোনঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। বোটক্লাবের ঘটনা প্রসঙ্গে তার আংশিক মিথ্যাচার প্রমাণিত হতেই অনাস্থার পাত্রীতে পরিণত হন পরীমণি। যে পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা শাখার তৎপর 'সুপারম্যানেরা' এবং চলচ্চিত্র অঙ্গণের প্রতিবাদী কন্ঠস্বরগুলো পরীমণির পাশে অবিচল অবস্থানের ঘোষণা দিয়েছিলো, একে একে ফানুসের মতো মিলিয়ে যান তারাও।

ঘটনার ধারাবাহিকতায় সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে গত ৮ আগস্ট। এদিন অবৈধ মাদকের মজুত রাখার দায়ে পরীমণিকে তার গুলশানস্থ বাসভবন থেকে আটক করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত এই অভিযানে পরীমণির বাসা থেকে নিষিদ্ধ মাদক এলএসডি, বিপুল পরিমাণের বিদেশি মদ ও ভয়াবহ মাদক আইস উদ্ধার করা হয়। পরীমণির ড্রয়িংরুমের কাভার্ড, শোকেস এবং ডাইনিংরুম, বেডরুমের সাইড টেবিল ও টয়লেট থেকে উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ মদের বোতল।

আটকের পর পরীমণির বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের করা হয়। পরে তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে র‍্যাব। পরবর্তীতে আদালতে উপস্থিত করা হলে তার ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। গত ১৩ আগস্ট ছয়দিনের রিমান্ড শেষে পরীমণি ও তার সহযোগী দীপুকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। ওইদিন মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত পরীমণিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। গত ১৯ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলাম পরীমণির একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ডকালে পরীমণির দেয়া তথ্যানুসারে প্রকাশ্যে আসে ঘটনাবহুল এই পরিস্থতির সবচেয়ে বিস্ফোরক তথ্য। জানা যায়, পরীমণির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন আলোচিত বোটক্লাব মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গুলশান বিভাগ) গোলাম সাকলায়েন শিথিল। সেই ঘটনার তদন্ত করতে গিয়েই চলচ্চিত্র নায়িকা পরীমণির সঙ্গে তার পরিচয় ও প্রেমের সূত্রপাত। এরপর নিয়মিতভাবেই মামলার বাদী পরীমণির বাসায় যাতায়াত শুরু করেন শিথিল। জিজ্ঞাসাবাদে পরীমণি সর্বশেষ সেই পুলিশ কর্মকর্তার বাসায় দীর্ঘ ১৮ ঘন্টা অবস্থানের কথা স্বীকার করেন। এই ঘটনার জেরে তোলপাড় শুরু হয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ বিভাগে।

সর্বশেষ আজ (৩১ আগস্ট) জামিনে মুক্ত হলেন পরীমণি। অনেকেই ধারণা করছেন, জেল থেকে বাড়ী ফেরা পরীমণি যে কোনো মুহূর্তে আবার জমিয়ে তুলতে পারেন পরিস্থিতি। এদিকে একের পর এক ঘটনার প্রবাহে অনেকটাই আড়ালে চলে গেছে বোটক্লাব কাণ্ড। যে ঘটনাকে ঘিরে এতকিছু সেই বোটক্লাবে সে রাতে আসলেই কি হয়েছিল সেই তথ্য এখনও অজানাই রয়ে গেছে।

পরীমণিকে ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে দেশের পুলিশ প্রশাসনকে। প্রতিটি স্পর্শকাতর ঘটনা ও ঘটনাস্থলের সঙ্গে পুলিশের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তার কারণেই এমন অনাহূত পরিস্থিতি আবির্ভূত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যে বোটক্লাবে শুরু হয়েছিল এই নাটকের সেই ক্লাবের সভাপতি বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ। এমনটাই জানা গেছের ডয়েচ ভেলের প্রতিবেদনে। এদিকে আলোচিত এই ঘটনায় পুলিশের যে 'সুপারম্যান' হয়ে ওঠার রোমাঞ্চকর মন্তব্য করেছিলেন পরীমণি সেখানেও প্রতিটি ক্ষেত্রে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গোয়েন্দা পুলিশের আরেক কর্মকর্তা। যদিও গ্রেফতার হওয়ার দিন বার বার এই কর্মকর্তাকে ফোন করেও তার নাগাল পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন পরী। বোটক্লাব ইস্যুতে পরীমণির পাশে থেকে সংবাদ সম্মেলন, বিবৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কাউকেই গ্রেফতার হওয়ার দিন খুঁজেও পাননি পরীমণি।

পরীমণির প্রসঙ্গে দেশের বরেণ্য সাংবাদিক, শিল্পী-সাহিত্যিকরা ঘোর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। বিশিষ্ট নাগরিকরাও সরব ভূমিকা পালন করেন এক পর্যায়ে। তখন সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল এ নিয়ে। পরীমণির জন্য কেন দেশের মাথাদের এতো উদ্বেগ-উৎকন্ঠা? দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, চলচ্চিত্র, গণমাধ্যম ও শিল্পাঙ্গণের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ একাধিক ব্যক্তি তাদের অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে ধারণা প্রকাশ করেছেন যে, সম্ভবত বোটক্লাব থেকে শুরু হওয়া ঘটনাপ্রবাহ অপ্রত্যাশিতভাবে সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণীর স্পর্শকাতর নানা দিক উন্মোচণের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, যা হয়তো প্রাথমিক অবস্থায় অনুমান করা সম্ভব হয়নি। অভিনেত্রী হলেও পরীমণির বিচরণ শুধু অভিনয় অঙ্গণে সীমাবদ্ধ ছিল না। অভিজাত সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল তার সাবলীল আসা-যাওয়া। যে সত্য সর্বজন জ্ঞাত।
বোটক্লাব কাণ্ডের পর যখন গুলশান ক্লাবসহ নানা পর্যায় থেকে এই অভিনেত্রী চাপের মুখে পড়তে শুরু করেন তখন মরিয়া হয়ে নাসিরদের বিরুদ্ধে পরীমণির সরব হয়ে ওঠাটা বিশেষ শ্রেণীর জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠেছিল বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। যার প্রেক্ষিতে পরীমণিকে কোনঠাসা করা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। আর তারই জেরে হয়তো নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার হতে হয় তাকে।

পরীমণি বিভিন্ন সময় ফেসবুক লাইভে আসলেই তার লিভিং রুমের শো কেসে সাজানো থরে থরে মদের বোতল অহরহ চোখে পড়ত। সেক্ষেত্রে এতদিন পরে এসে কেন সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলো, আরো আগেই কেন সেটা করা হয়নি; এমন অনেক বিষয়েই প্রশ্ন রয়ে যায়। কাশিমপুর কারাগারে 'পাগল হয়ে যাচ্ছি' বলে পরীমণির সেই আর্তচিৎকার হয়তো জানান দেয়, সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে বর্তমান সমাজের তথাকথিত এই অভিজাত গোষ্ঠীর আভিজাত্য আর দম্ভে কাঁটা হয়ে ফুটতে শুরু করেছিলেন পরীমণি। এই কথিত অভিজাত সমাজের এক সময়ের অপ্সরা ডানাকাটা পরী আজ রীতিমতো বিপর্যস্ত। কারাগার থেকে নিরবে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডানাভাঙা এক ক্লান্ত পরীমণি।

সার্বিক দিক বিবেচনায় বলা যায়, এখনও অনেক কিছুই জানা বাকি রয়ে গেছে সে সব ঘটনা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে। তবে আদৌ সেগুলো আর আলোচিত হবে কিনা, প্রকৃত ঘটনা জানা হবে কিনা বা অন্ধকারে ঘাঁপটি মেরে থাকা অজ্ঞাত সত্যগুলোকে আলোর নিচে টেনে আনা হবে কিনা; সে নিয়ে এই মুহূর্তে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলার উপায় নেই। বলাবাহুল্য, এসব ঘটনার পরিণতি কি হবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে এখন পরীমণির পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। পরী যদি ডানা মেলে তবে হতে পারে অনেক কিছুই। অন্তত তার ন্যায্য বিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলেও সেক্ষেত্রে সকল ঘটনার সমাধান করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। আর যদি কারাগারের অন্ধপ্রকষ্ঠ্যে পালক খসে গিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে মর্ত্যের আর দশজন সাধারন মানুষের মতোই সব মেনে নিভৃতে বাকি সময়টুকু কাটিয়ে দিতে হবে।