• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০১৯, ০৬:১৩ পিএম
সর্বশেষ আপডেট : জুলাই ২৩, ২০১৯, ০৮:৩২ পিএম

ভাঙছে জাতীয় পার্টি !

ভাঙছে জাতীয় পার্টি !
জিএম কাদের ও রওশন এরশাদ

সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর মাত্র ৯ দিনের মাথায়ই ভাঙনের সুর উঠেছে তারই প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টিতে। এরশাদের অবর্তমানে দলের নেতৃত্ব নিয়েই মূলত এ ভাঙনের আওয়াজ উঠলো দলটিতে। সোমবার (২২ জুলাই) রাতে দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে (গোলাম মোহাম্মদ কাদের) পার্টির চেয়ারম্যান মানতে অস্বীকার করে গণমাধ্যমে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশান এরশাদসহ অন্য নয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নেতার বিবৃতির মধ্যদিয়ে এ ভাঙন ষ্পষ্ট হয়। 

বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ (২) এর ‘খ’ ধারায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে জিএম কাদেরকে অবহিত করা হয়। এতে আরও বলা হয়, জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদের যেভাবে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করছেন তা পার্টির গঠনতন্ত্রের ২০ (২) এর ‘ক’ ধারার বরখেলাপ।

জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এরশাদের অর্তমানে জিএম কাদের নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া দলের গঠনতন্ত্র বিরোধী। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান থেকে তাকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে হলে দলের প্রেসিডিয়ামের বৈঠক ডেকে সবার সম্মতিক্রমে দায়িত্ব নিতে হবে। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর মাত্র তিনদিনের মাথায় হঠাৎ করেই একটি সংবাদ সম্মেলনে জিএম কাদেরকে পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা দলটির নেতাকর্মীদের কাছে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাছাড়া এটা জাপার গঠনতন্ত্রের সরাসরি লঙ্ঘনও বটে।

পার্টির একাধিক প্রেসিডিয়াম সদস্য দৈনিক জাগরণকে বলেন, শুধু আমাদের বাংলাদেশেই নয় এ উপমহাদেশের বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি হচ্ছে উত্তরাধিকারের রাজনীতি। পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি। 

তারা আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই এ দলের হাল ধরার চেষ্টা করেছেন। আবদুল মালেক উকিল, আবদুর রাজ্জাক, জহুরা তাজউদ্দিন, মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ আরও অনেকেই আওয়ামী লীগকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নেতাকর্মীরা তাদের গ্রহণ করেনি। তারা চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর পরিবার থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব আসুক। অবশেষে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের হাল ধরার পর নেতাকর্মীরা এ নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে। ঠিক একইভাবে বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের হত্যাণ্ডের পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার দলটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণের ভোটে তিনি প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু দল দাঁড়াতে পারেনি। বিএনপিকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে গৃহবধূ থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে দলের হাল ধরতে হয়েছে। ভারতে গান্ধী পরিবার এখনও কংগ্রেসের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। পাকিস্তানে নেওয়াজ শরিফের রাজনীতি আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ হলেও দলটির নেতৃত্ব রয়েছে তারই পরিবারের হাতে। এসব দিক বিবেচনা করলে ‘পল্লীবন্ধু’ এরশাদের অবর্তমানে জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব আসতে হবে তার পরিবার হতে। সেটা অবশ্যই তার স্ত্রী বা সন্তানদের কাছ থেকে। 

জাপা নেতারা আরও বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এদেশের নয় বছরের শাসক ছিলেন। যে যেভাবেই দেখুক না কেন তিনি এদেশের জনগণ ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। কিন্তু এরপরও বিরোধীদলের আন্দোলনের মুখে তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও পরবর্তী সরকার তাকে কারাগারে নেয়। জাপার যখন শোচনীয় অবস্থা তখন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ রাজপথে পল্লীবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন করেছেন। পুলিশের লাঠির আঘাত সহ্য করেছেন। পুলিশ তাকে গুলিও করেছে। তখন জিএম কাদেররা তো রাজনীতিতেই আসেননি। এমনকি ভাইয়ের মুক্তির জন্য কোনোদিন রাজপথেও নামেননি। এখন হঠাৎ করেই পার্টির চেয়ারম্যান দাবি করলেই তো নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারে না। 

জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মানতে অস্বীকারের মধ্যদিয়ে দলটি ভাঙনের মুখে পড়ল কিনা জানতে চাইলে জাপার অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুস সবুর আসুদ দৈনিক জাগরণকে বলেন, জিএম কাদেরকে গঠনতন্ত্র মেনে চেয়ারম্যান হতে হবে। পার্টি পরিচালনায় তো জাতীয় পার্টির একটি লিখিত গঠনতন্ত্র আছে। পার্টির ফোরাম যাকে কাউন্সিলের মধ্যদিয়ে দায়িত্ব দেবে তিনিই নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু স্যারের (এরশাদ) মৃত্যুর তিনদিনও পার হতে পারেনি তিনি নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা দিলেন। এটাতো নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারে না। 

তিনি বলেন, আমরা বিবৃতির মাধ্যমে তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে একটি ওয়ার্নিং দিয়েছি। এখন তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ দেখে আমরাও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব।

আসুদ আরও বলেন, জাতীয় পার্টিতো ইতোমধ্যেই চার/পাঁচটি ভাগে ভাগ হয়ে আছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আছে। মঞ্জুর সঙ্গে মিজানুর রহমান চৌধুরীও ছিলেন। মরহুম নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আছে। কাজী জাফর আহমেদ ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বেও জাতীয় পার্টি ছিল। ডা. মতিনের নেতৃত্বেও জাতীয় পাটি আছে। যেমন ছিল হুদা-মতিনের নেতৃত্বে বিএনপি। এসবতো হারিয়ে গেছে। তারা বেগম জিয়ার নেতৃত্বেই ফিরে এসেছে। আসতে বাধ্য হয়েছে। ভবিষ্যতেও জাপার ক্ষেত্রে এমন যদি কিছু হয়, তাহলে নেতাকর্মীরা যার নেতৃত্ব মেনে নেবে সেই মূল জাপার নেতৃত্ব দেবেন। এমনও হতে পারে যারা পাল্টা জাপা করবে তারা ভবিষ্যতে রওশন এরশাদের নেতৃত্বেই ফিরে আসবে। 

জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যান হিসেবে না মানার বিবৃতিতে জাতীয় পার্টির ভাঙনের মুখে পড়ল কিনা জানতে চাইলে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন দৈনিক জাগরণকে বলেন, কোনোদিনই জাতীয় পার্টি ভাঙবে না। ভাঙার প্রশ্নই আসে না। আমরা গঠনতন্ত্রকে প্রাধান্য দিয়েছি। গণতন্ত্র মেনে চলার কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। 

জাপা সূত্র জানায়, গত ২০ জুলাই শনিবার গুলশানে ভাবী রওশনের বাসায় যান দেবর জিএম কাদের। তিনি জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালনে রওশনের সহযোগিতার পাশাপাশি আশির্বাদ কামনাও করেন। জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভাবী রওশন এরশাদ তাকে আশির্বাদ করে দিয়েছেন। কিন্তু রওশন এরশাদ সূত্রে জানা যায়, রওশন তার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছেন, কেউ আমার বাসায় আসলে তাকে কি আমি ধূর ধূর করে তাড়িয়ে দেব। আর সবচেয়ে বড় কথা জিএম কাদের আমারও পরিবারের একজন সদস্য। তাই তিনি আমার বাসায় আসতেই পারেন। সেখানে রাজনীতির কোনো বিষয় জড়িত থাকতে পারে না।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চেয়ারম্যানের পলিটিক্যাল সেক্রেটারী সুনীল শুভ রায় দৈনিক জাগরণকে বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ২০ (১) এর ‘ক’ ধারাবলে জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গঠনতন্ত্র মোতাবেক এ দায়িত্বপালন ঠিক আছে। 

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন,  আমি শুনেছি তারা এ ধরণের একটি বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু বিবৃতি পড়ে দেখেনি। 

তিনি বলেন, আসলে কে কি বলল এটা বিষয় নয় । আমাদের দলীয় গঠনতন্ত্রেই পরিস্কার করে লেখা আছে।  এরশাদ, জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদ একই সূঁতোয় গাঁথা। কিছু মানুষ মৃত্যুর আগমূর্হুত পর্যন্ত বিভ্রান্ত ছড়াবে। এটাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু মনে করি না। আমি মনে করি সবাই ঠিক আছে। কিছু মানুষ জিএম কাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে। কিছু মানুষ রওশন এরশাদকে বিভ্রান্ত করতে পারে। 
দলের ভাঙন প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে আবু হোসেন বাবলা বলেন, এটা অসম্ভব। আমাদের চেয়ারম্যান (এরশাদ) সবার সামনে জিএম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। এটা নিয়ে বিভ্রান্তির কিছু নেই। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমাদের মহাসচিব জিএম কাদেরকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়। 

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আমাদের যা বক্তব্য আমরা গতকাল বিবৃতির মাধ্যমেই তা বলে দিয়েছি।

জাতীয় পার্টির নতুন করে টানাপোড়েনের বিষয়ে দলের অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ বলেন, পার্টি চলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। দলের চেয়ারম্যান (এরশাদ) জীবিত অবস্থায় তার অবর্তমানে দল পরিচালনা করার জন্য গঠনতন্ত্রের ২০/১-ক ধারা মোতাবেক তার অনুজ জিএম কাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তার অবর্তমানে জিএম কাদেরই হবেন পার্টির চেয়ারম্যান। একই গঠনতন্ত্রে রওশন এরশাদকে বিরোধীদলের উপনেতা বানানো হয়েছে। উনি বিরোধীদলের নেতা হবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে ভুল বুঝাবুঝির কিছু আছে বলে আমি মনে করিনা।

জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো বিভেদ নেই বলে দাবি করেছেন দলটির চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) জিএম কাদের (গোলাম মোহাম্মদ কাদের)।  মঙ্গলবার দুপুরে জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টিতে কোনো বিভেদ নেই। জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। নেতৃত্বের প্রশ্নে জাতীয় পার্টিতে কোনো দ্বন্দ নেই। চেয়ারম্যান হিসেবে রওশন এরশাদ ও অন্য নেতাদের বিবৃতির প্রসঙ্গে জিএম কাদের বলেন, বিবৃতিটি হাতে লেখা ও কাঁচা। এটা বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমাদের পরিবারে পিতৃতুল্য ছিলেন, বেগম রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মত। 

জিএম কাদের বলেন, পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান পল্লীবন্ধু এরশাদের নির্দেশনায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছি। এখনো পল্লীবন্ধুর নির্দেশনাতেই চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করছি। জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ গঠনতন্ত্র অনুসরণ করেই চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। তারা যে নামেই সম্বোধন করবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। জাতীয় পার্টিতে কাজ করাটাই আসল কথা। তিনি বলেন, কোনো সমস্যা থাকলে আমরা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করবো। 

টিএস/বিএস 

আরও পড়ুন