• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০১৮, ০৭:৫৭ পিএম

অরিত্রী নেই, পড়ে আছে তার স্মৃতি

অরিত্রী নেই, পড়ে আছে তার স্মৃতি
অরিত্রী নেই, তবে স্মৃতি রয়ে গেছে। অরিত্রীদের বাসায় অরিত্রীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তার শোকাহত পিতা; ছবি- দৈনিক জাগরণ

 

শান্তিনগর পীর সাহেবের গলিতে ঢুকতেই ডানপাশে অরিত্রীদের বাসা। বৃহস্পতিবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে সেখানে গিয়ে বাসা খুঁজে পেতে কোনো বেগ পেতে হলো না। বাসাটি এখন সবার কাছেই অতি চেনা।  

অরিত্রীর পরিবার বাসার একেবারে উপরের (৮ম) তলায় থাকে। বাসায় ঢুকেই বসার ঘর। পুরো বাসাটিতেই যেন অরিত্রীর ছোঁয়া লেগে আছে। বসার ঘরে একটা বড় সেলফ। ছোটখাটো একটা লাইব্রেরি বলা যায়। দেশি-বিদেশি নানা বইয়ে ঠাসা সেলফ। 

পরিবারের বাকি সদস্য; বাবা মা ও ছোট বোনের সঙ্গে অরিত্রী ;ছবি : দৈনিক জাগরণ

একটু ভেতরে ডান পাশের কোনায় একটি ঘর। ওটাই ছিল অরিত্রীর ছোট জগত। ঘরে ঢুকলেই অরিত্রীর নানা সৃজনশীল কাজের নমুনা পাওয়া যাবে। দেয়ালে পেইন্ট করা- নীল জলরাশির মধ্যে সামুদ্রিক মাছ- যেন জলের নীল জগৎ। 

ওর ঘরেও বড় একটা আলমারিতে রাখা ইংরেজি নানা উপন্যাস। দুটো পড়ার টেবিল। এর একটিতে পড়তে বসতো অরিত্রি। পড়ার টেবিলে ক্লাসের বই ছাড়াও রয়েছে তার ব্যবহৃত চশমা, হেয়ার ব্যান্ড, পারফিউমসহ নানা জিনিস। আলমারির একপাশে রাখা প্রিয় ব্যাগ। ঘরের মাঝামাঝিতে বিছানা। এর সামনেই আরেকটি বড় আলমারি। ব্যবহৃত সব কাপড় সেখানে রাখা। রুমের সঙ্গে বিশাল ওয়াশরুম। অরিত্রির পছন্দে নানান কারুকাজে সমৃদ্ধ টাইলস লাগানো হয়েছে ওয়াশরুমে। সব ছিল অরিত্রীর পছন্দে করা। এখন অরিত্রী নেই। তবে তার পছন্দে তৈরি জিনিসগুলো আছে।

বাবা দিলীপ অধিকারী এগুলো দেখেন সযত্নে। সদ্যই স্মৃতি হয়ে গেছে। কখনো মিটিমিটি হাসেন, আবার কখনো মূর্ছা যান কান্নায়।  

ছোট্ট অরিত্রীর যখন যা মন চাইতো তখনই তা করতো। পড়ালেখায় যথেষ্ট ভালো ছিল। ক্লাসে রোল ১৫'র মধ্যেই থাকতো। বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি কোরিয়ান ভাষায় কথা বলতে পারতো সে। শিখেছিল কোরিয়ান নৃত্য। সখের বশে গিটার বাজানো রপ্ত করছিল অরিত্রি। মনের সুখে প্রায়ই প্রিয় গিটার বাজাতো। নির্দিষ্ট কোনো স্বপ্ন ছিল না তার। তবে বছর খানেক আগে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয় তাকে ডাক্তার বানাতে চায় সবাই। শুরুতে অরিত্রি দ্বিধায় থাকলেও পরে পরিবারের চাওয়াকে নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নেয়। 

দিলীপ অধিকারী দৈনিক জাগরণকে বলেন, আমি ব্যবসায়ী। তাছাড়া আমাদের পরিবারে বেশিরভাগই সরকারি চাকরিজীবী। আমাদের পারিবারিক একজন চিকিৎসক আছেন, সম্পর্কে পিসি হন। তিনি আমাদের বংশের একমাত্র ডাক্তার। সম্প্রতি অবসর নিয়েছেন। আমরা চাইছিলাম অরিত্রি ডাক্তার হোক। এটা তাকে জানিয়েছিলাম। সে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে এবং একসময় বলে সে ডাক্তারি পড়বে। যেহেতু বাংলাদেশে  ডাক্তারিতে সুযোগ পেতে প্রচুর প্রতিযোগিতা হয় এবং সুযোগ কম সে ক্ষেত্রে অরিত্রি আমাকে জানিয়েছিল বিদেশ থেকে হলেও সে ডিগ্রি নেবে। সে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিল। স্বপ্ন পূরণে সে সব চেষ্টাই করছিল। 


অরিত্রীর ব্যাগ, যে ব্যাগে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যেত অরিত্রী ;ছবি : দৈনিক জাগরণ

তিনি বলেন, তারমধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার একটা প্রবণতা ছিল। সে তার বন্ধুদের অর্গানাইজ করতো। বাসায় নিয়ে আসতো। সবাইকে নিয়ে খেতো। কোনো অনুষ্ঠান হলে সেটার আয়োজন সে করতো। বই পড়ার অভ্যাস ছিল খুব। বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্য। বার্ষিক পর্রিক্ষা শেষ হলে আমাকে নিয়ে লাইব্রেরিতে নিয়ে যেতো। ১৫-২০টা ইংলিশ উপন্যাস পড়তো। খাটে হেলান দিয়ে সেগুলো পড়তো। তাকে দাফন করার সময় আমরা অনেকগুলো বই সেখানে দিয়ে দিয়েছি। ও কোরিয়ান ভাষা শিখেছিল। গিটার বাজানো শিখেছিল। প্রায়ই বাজাতো। খুব প্রাণবন্ত ছিল মেয়েটা আমার। নাচ-গানও করতো। 

ওইদিনের ঘটনা স্মরণ করে দিলীপ অধিকারী বলছিলেন, অরিত্রি শিক্ষকদের কাছে খুব অনুরোধ করছিল যেন তাকে পরীক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষকরা কোনোভাবে মানছিলেন না। বিশেষ করে প্রভাতী শাখার শিক্ষক আমাদের সঙ্গে খুব বাজে ব্যবহার করেছেন। আমার স্ত্রী অসুস্থ্য। কিছুদিন আগে মাইল্ড স্ট্রোক করেছেন। তারপরও  তাকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমা চেয়ে বিষয়টা সমাধান করাতে স্কুলে গিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম মেয়েটা যেন পরীক্ষা দিতে পারে। কিন্তু তারা আমাদের কোনো কথাই শুনতে চাননি। খুব রূঢ় আচরণ করেছেন। 

তিনি বলেন, এ পরিস্তিতি খুব কঠিন। সন্তানের লাশ কাদে নেওয়া যে কত কষ্টের তা হয়তো বলে বুঝাতে পারব না। অরিত্রির চাচাতো ভাই ওর ডাইরিতে লিখেছে যে হাতে  তোকে বড় করলাম সে হাতে দাফন করলাম। এসব আসলে অনেক কষ্টের। সহ্য করা কঠিন।

 
অরিত্রীর বেডরুমে থাকা টেবিল, এই টেবিলে বসেই পড়ালেখা করতো সে ;ছবি : দৈনিক জাগরণ

মেয়ের আত্মহত্যার পেছনে নিজেরও দায় রয়েছে উল্লেখ করে দিলীপ অধিকারী বলেন, অভিযোগ কাকে করব?এখানে অামারও ব্যার্থতা আছে। স্কুলে মোবাইল অ্যালাউ না। তারপরও সে কীভাবে নিয়ে যায়। বিষয়টা আমার নজরদারি করা উচিত ছিল। বাবা হিসেবে আমি ব্যার্থ।  তবে আমার মনে হয় সব শিক্ষকদের আরো নার্সিং করা উচিত। স্টুডেন্টদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করা উচিত তা শেখানো দরকার।

শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নেওয়া ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাদের কী হলো আমি জানতে চাইনা। আমি নিরিপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যেন থাকতে পারি সেটা চাই। 

"আমি আজ অরিত্রির স্মরণসভায়ও বলেছি সবাই কান্না করলেও আমি আমার মেয়েকে পাব না। কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে যেন কোনো রাজনীতি না হয়। "

শিক্ষার্থীরা তাদের ছয়দফা দাবির মধ্যে গভর্নিং বডির অপসারণেরও দাবি তুলেছে। যদি গভর্নিং বডি অপসারণ হয় তাহলে কী স্কুলের যে সমস্যাগুলো আছে তা সম্পূর্ণরূপে সমাধাণ হবে? বিষয়টি জানতে চাইলে দিলীপ অধিকারী বলেন, আমরাই তো ভোট দিয়ে গভর্নিং বডি বানিয়েছি। যখন যে ক্ষমতা পায় তখন হয়তো তার মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে। আর এবারের কমিটি দীর্ঘদিন পরে হয়েছিল।  

অরিত্রির নামে একটি পাঠাগার করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এলাকায় আমার অর্থায়নে একটি মন্দির করা হয়েছে। সেখানে একটি পাঠাগারও বানানো হচ্ছে। এই পাঠাগার অরিত্রির নামে নামকরণ করার জন্য আমার দাদা খুব করে চাইছেন। আমি উনাকে বলেছি এটা কমিটির সঙ্গে কথা বলে তারা চাইলে করতে পারেন।

 
অরিত্রীর বেডরুম, এই রুমটির প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে অরিত্রীর স্পর্শ; ছবি : দৈনিক জাগরণ

আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির লক্ষে আন্দোলনের ইচ্ছা আছে জানিয়ে দিলীপ অধিকারী বলেন, এমন পরিকল্পনা আছে। আমার বন্ধু-বান্ধব, পরিবার এবং অরিত্রির সহপাঠীদের সহযোগীতা পেলে সবাইকে নিয়ে আত্মহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করব। 

গত রোববার (২ ডিসেম্বর) পরীক্ষা চলাকালীন স্মার্টফোনের মাধ্যমে নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রি অধিকারী (১৫) নকল করেছেন বলে অভিযোগ আনে ভিকারুননিছা নূন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় সোমবার (৩ ডিসেম্বর) তার বাবাকে ডেকে এনে অপমান করা হয় বলে অভিযোগ উঠে। বাবার অপমান সহ্য করতে না পেরে মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেন অরিত্রীর বাবা দিলীপ অধিকারী। বিষয়টি জানাজানি হলে ক্ষোভে ফুসে ওঠে তার সহপাঠী। সঙ্গে যোগ দেন স্কুলের অভিভাবকরা। অরিত্রির সহপাঠীদের দাবির প্রেক্ষিতে স্কুলে প্রিন্সিপাল নাজনিন ফেরদৌসসহ তিন শিক্ষিকাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। আর আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ এনে দিলীপ অধিকারীর পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর গোয়ন্দা পুলিশ বরখাস্ত হওয়া শিক্ষিকা হাসনা হেনাকে গ্রেপ্তার করে। তিনি এখন কারাগারে আছেন।