• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯, ০৫:৩৫ পিএম

নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ

নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ


জননেত্রী শেখ হাসিনা টানা তিনবারের মতো সরকার গঠন করেছেন। তিনি দেশের উন্নয়ন করেছেন এবং উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন জনগণকে। অপরদিকে তাঁর প্রতিপক্ষ যথার্থ সুসংগঠিত ছিল না। ফলে একচেটিয়া বিজয় ছিনিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বিগত ১০ বছরে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে যা উন্নয়ন করেছেন তাতে সাধারণ মানুষ যথার্থ উপকৃত হয়নি। একশ্রেণির মানুষ ‘উপকৃত’ হয়েছে। যেমন ফ্লাইওভার করার ফলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়নি। রাজধানীসহ সারাদেশে যানজট কমেনি। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে মতিঝিল যেতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। দৈনিক ২০ লাখ কর্মঘণ্টা অপচয় হয় যানজটের কারণে। ফলে উন্নয়ন যথার্থ গতি পায়নি। 

যে উন্নয়ন জনমানুষের উপকারে আসে না, সে উন্নয়নের মূল্য কী? রেলের অবস্থা আরও করুন, ব্যবহারের উপযোগী টয়লেটের সংখ্যা অনেক কম। বিনা টিকিটের যাত্রীতে রেলের বগি ঠাসা থাকে। অন্যদিকে রেল কর্মচারীদের সহযোগিতায় যাত্রীরা সেবা পায় না। নতুন সরকার বলেছে, দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। তা হলে আগের সরকারের সময়ে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছিল তাতে সরকারের সমর্থন ছিল? বিগত দিনের দুর্নীতির বিচার হবে কিনা, তা জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। দুর্নীতি আজ সর্বত্র বিরাজমান। দুর্নীতিমুক্ত হওয়ার সুযোগ দৃশ্যমান নয়। প্রধানমন্ত্রী বারবার বলেছেন, “আমি জনগণের সেবক হতে চাইÑ ক্ষমতা ভোগ করতে আসিনি, দুর্নীতি করে অর্থ কামানো আমার রাজনীতি নয়।” তাঁর কথার মূল্য দলীয় নেতাকর্মী ও সরকারি কর্মজীবীরা আমলে নেয়নি। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি চলছে এখনো। প্রধানমন্ত্রীর কথা কতটুকু মূল্যায়িত হবে জানি না। সময় বলবে! হাসপাতালে ডাক্তার নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকে না এবং যারা থাকেন তারা রোগীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন না।

ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগােেলর বাইরে, নকল ওষুধে বাজার সয়লাব, ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়ানোর ফলে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ডাক্তাররা একই ওষুধ বিভিন্ন নামে রোগীদের প্রেসক্রিবশনে লেখেন। রোগীরা প্রতারিত হচ্ছেন, ডাক্তাররা ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন পাচ্ছেন। ০৪/০২/১৯ দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদে বলা হয়েছে, চিকিৎসার কারণে মানুষ হতদরিদ্র হচ্ছে। টকশোতে বিজ্ঞ ডাক্তাররা বলেছেন, চিকিৎসার কারণে মানুষ গরিব হচ্ছে এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা যা আছে, তা সাধারণত বিত্তবানরা পেয়ে থাকেন, গরিবেরা নয়। ক্রিমিন্যালদের উৎসাহ জোগান একশ্রেণির পুলিশ। পুলিশ যদি জনবান্ধব হয় এবং পুলিশি হয়রানি বন্ধ করা হয়, তা হলে দুর্নীতি কমে যাবে। আইনজীবীরা দুহাতে টাকা কামাতে থাকেন নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে, মানুষের কল্যাণে আইনজীবীরা কাজ করেন না। টকশোজীবীরা টকশোতে একতরফা কথা বলে চলেছেন, তাদের কথার মাঝে ন্যায্যতা ও সততা নেই। শিক্ষিত মানুষের চরিত্র নষ্ট হলে কিছুতেই ভালো কিছু হয় নাÑ জাতীয় অগ্রগতি হয় না। স্বাধীন  দেশের শিক্ষিত মানুষ চরিত্রহীন। বিবেক তাড়িত হয়ে শিক্ষিত মানুষ ন্যায্য ও সত্য কথা বলে না। ন্যায়পরায়ণ শিক্ষিত মানুষ না থাকলে চরিত্রবান জাতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক নেতারা চরিত্রবান হবেন ও জাতি গঠনের দায়িত্ব নেবেন, মিথ্যা কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে চরিত্রবান জাতি তৈরি করা যায় না। নীতিনৈতিকতা ও বিবেকহীন মানুষ জাতির বোঝা। কথামালার রাজনীতি জনতার চাহিদা মেটাতে পারে না। জনগণ বারবার প্রতারিত হয়েছে, আর প্রতারিত হতে চায় না। রাজনীতিবিদদের কথা ও কাজে মিল দেখতে আগ্রহী দেশের সাধারণ মানুষ। প্রতিশ্রুতি যথাযথ বাস্তবায়ন চায় জনগণ।

শিক্ষাব্যবস্থায় দারুণ হতাশা বিরাজ করছে। প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষায় অনৈতিকতায় ভরপুর। শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা প্রদানে আগ্রহী নয়। শিক্ষার্থীরা পরিকল্পনা সেভাবে সাজানো উচিতÑ যাদের ঋণ পরিশোধের সুযোগ আছে তারাই গৃহঋণ নেবেন। ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা শিথিল ও সহজ করা প্রয়োজন। গ্রামীণ গরিব জনগোষ্ঠী কখনও ঋণখেলাপি হবেন না। গরিবেরা টাকা মেরে দেয়ার সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি। দেশের সাধারণ মানুষ অতি সহজ-সরল ও সৎ। দেশের মানুষ অনুদান ও ভিক্ষা চায় না, তারা মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চায়। দলীয় কর্মীরা চাঁদাবাজি ও সরকারি কর্মচারীরা যদি দুর্নীতি না করে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে না। দরিদ্রতা দূরীকরণে কর্মসংস্থানের বিকল্প নেই। পত্রিকার ভাষ্য অনুসারে সরকারি চাকরির ৪ লাখ শূন্য পদ রয়েছে। অপরদিকে বেকারের সংখ্যা কোটির উপরে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে অসহায় কষ্টকর মানবেতর জীবনযাপনকারী সম্প্রদায় হলেন ৯০% অশিক্ষিত/স্বল্পশিক্ষিত এবং গরিব মানুষের সন্তান, সাধারণ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। অনগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মিডিয়াতে গুরুত্বের সাথে আলোচনা হয় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে পকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করে মুক্তিযোদ্ধারা। ফলে বাংলাদেশের মানুষ আজ ৪৮ বছর যাবৎ স্বাধীন দেশের নাগরিক। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলার কারণ বোধগম্য নয়। যথাযথ মূল্যায়ন প্রত্যাশা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা। সরকারের কার্যক্রমে ও ২০১৮ এর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার পাঠ করে মুক্তিযোদ্ধারা হতাশ হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন না করে করুণার পাত্র বানানো হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা তাদের অপ্রতুল। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে দিয়েছে, তাই আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা ছিল, বর্তমানে সে প্রত্যাশা হতাশায় পরিণত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অন্য সরকারের কাছে কিছুই আশা করেননি। অন্য সরকার না করলেও আওয়ামী লীগ সরকার করবে না? এমন তো হতে পারে না।

২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে মুক্তিযোদ্ধা সম্পর্কে আশার কথা শোনানো হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে সরকার গঠনের পর ৫ বছরে অক্ষত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা বৃদ্ধি করেছেন একবার ২০০০ টাকা (৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা)। ২০১৬ সাল থেকে আজ অবধি সেই ১০ হাজার টাকা চলমান। প্রতিবছর বাজেট হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি হয় না। ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সম্পর্কে সরকারি একটি সার্কুলার জারি করে  তা আজও   যথাযথ কার্যকর  হয়নি এবং পুনরায় ২০১৮ আরেকটি সার্কুলারের মাধ্যমে চিকিৎসা নিশ্চিতের লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ জমা দেয়া হয়েছে বলে পত্রিকার খবরে প্রকাশ করলেও মুক্তিযোদ্ধারা সুফল পায়নি। প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে ২৮ জুন জাতীয় সংসদে ঘোষণা করেন  মুক্তিযোদ্ধারা ৬০ বছর বয়স্ক হলে বিনা খরচে ট্রেন, বাস-নৌযানে যাতায়াত করতে পারবে। সে বিষয়ে সরকারি কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি আজ পর্যন্ত, ঘোষণার সুফল মুক্তিযোদ্ধারা পায়নি। আমি সে সূত্র ধরে মন্ত্রণালয়ে অনেক চিঠি লিখেছি, ফল পায়নি। টাকা দিয়েও রেলের টিকিট পায় না মুক্তিযোদ্ধারা। রেলে টিকিটের জন্য গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিলে হাসির পাত্র হতে হয়  মুক্তিযোদ্ধাদেরকে। অবাক হয়ে দেখলাম, ২০১৮ সালের আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানিত নাগরিক হিসেবে রেলে, বাসে, লঞ্চে বিনা ভাড়ায় চলাচলের সুবিধা ভোগ করছে ও তাঁদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সরকার পালন করছে এবং এসব সুযোগ অব্যাহত থাকবে! এ বক্তব্য একেবারে অসত্যÑ যা চলমান নয়, তা অব্যাহত থাকে কি করে?

এসব কি নেত্রীর অজানা? মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করে লাভ কি? মুক্তিযোদ্ধারা মর্যাদার সঙ্গে দেশে বসবাস করতে চায়, অমর্যাদায় নয়। জাতির জনকের কন্যার প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা আস্থা হারাবে কেন? মিথ্যার বেড়াজাল কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি নিয়ে টালবাহানা কেন? সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদানের বাড়ি দেবেÑ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিও রয়েছে। মন্ত্রী বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি দেবার প্রতিশ্রুতি দেন, বাড়ির প্রকল্প বারবার নস্যাৎ হয়। টাকার খেলা চলে। বাড়ি দেয়ামাত্র কয়েক হাজার লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রকৃত গরিব মুক্তিযোদ্ধারা তিমিরেই থেকে যায়। যেসব বাড়ি সরকারি খরচে দেয়া হয়, সেগুলো ২ বছরের মধ্য ভাঙতে শুরু করে এবং মন্ত্রী ১৬ হাজার বাড়ি করে দেবার ঘোষণা কয়েক বছরে কার্যকর হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ২০১৪ সাল থেকে সম্মানী ভাতার বিপরীতে গৃহঋণ প্রদানের জন্য বারবার আবেদন-নিবেদন করে আসছি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ফেব্রুয়ারি ২০১৮ একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ের, অর্থবিভাগে প্রেরণ করে এবং ২০১৯ সালের জানুয়ারির ২৩ তারিখে মুক্তিযোদ্ধা  গৃহঋণ সম্পর্কে একটি  সভা  হয় বলে  জানা  গেছে।  এরপর  কি হবে? আজ পর্যন্ত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়নি।

মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের চাকরির কোটাও আজ বিলুপ্তির পথে। মুক্তিযোদ্ধাদের বারবার হতাশ করার দরকার কি? সম্মান না দিলে আপত্তি নেই, কিন্তু অসম্মান করা ঠিক নয়। সকল মুক্তিযোদ্ধাকে সমভাবে দেখা উচিত, নানা ভাগে ভাগ করা সমীচীন নয়। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভা কর্তৃক অনুমোদিত যে ভাষণ পাঠ করেছেন, সে ভাষণে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কল্যাণমূলক কোনো দিকনির্দেশনা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আগামী দিনে সরকারের কল্যাণ কর্মসূচি নেই। মহামান্য রাষ্ট্রপতিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সে কথা কারো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। তার কথার মর্যাদা রাখা উচিত।  রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ৯০০ টাকা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ক্রমান্বয়ে ১০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে ৯০০ থেকে ১০ হাজার টাকায় ভাতা বৃদ্ধি করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সময়ে   সরকারি কর্মজীবীদের  বেতন-ভাতা কতগুণ বাড়ানো হয়েছে?  কি কি সুবিধা দেয়া হয়েছে? নয় বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের কপালে মাত্র এইটুকু?
অক্ষত সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের করুণ অবস্থা যা প্রকাশ করা যায় না। আজ তাদের বৃদ্ধাবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত না হলে মহামান্য রাষ্ট্রপতিসহ অনেকেই রাষ্ট্রীয় আসন অলংকৃত করতে পারতেন না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ৯০% গরিব মানুষের সন্তান ছিলেন। রাষ্ট্র তাঁদেরকে অবহেলা করবে কেন তা বোধগম্য  নয়। 
  
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, বড় বড় মেগা প্রকল্পের কাজ চলছেÑ এসব মাথায় রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা করা উচিত এবং সমপরিমাণ বোনাস, চিকিৎসা, রেশন এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত সুযোগসুবিধা বাস্তবায়ন করা জরুরি। ভাতার বিপরীতে গৃহঋণ প্রদানের ব্যবস্থাও থাকা উচিত।


লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা